কেন কন্যাসন্তান চাই না আমি!

সুচিত্রা সরকার:

কন্যা সন্তানের জন্য কেন আয়োজনের ঘনঘটা কম, আজ বুঝলাম! কন্যাসন্তান হবার আশংকায় কেন ভ্রুণ হত্যা, আজ বুঝলাম! কেন বাবা-মা পরিবারের কন্যাসন্তানটির সামনেই পুত্রসন্তানকে বেশি যত্নে রাখে- সেও আজই বুঝলাম!

অদ্ভুত এক সত্যের মুখোমুখি আমি! দাঁড়িয়ে আছি গহীন অরণ্যে, একদম একা! আমিও তো নারী! মায়ের কন্যা সন্তান! আমারও কি এমনই হবে! আমিও কি মাকে ফেলে দিয়ে, শ্বশুরবাড়ি-বর-সন্তানদের বেছে নেবো?

স্মৃতিটা সত্যিই ঝাপসা! পুরান ঢাকার ওয়ারিতে দিদিমাদের বাসা! মনে আছে একবার সবাই মিলে গিয়েছিলাম! ঘরগুলো মনে নেই! মানুষগুলোও স্মৃতির মতোই ঝাপসা! শুধু মনে আছে দিদিমার নীল চোখের কথা! আধখান ছাদের কথা!

বাবা বললেন, রজনীগন্ধা ফুলের গাছ আছে ছাদে, যাও দেখে এসো! অবাক আমি! বাবা যে ফুলের গোছা মায়ের জন্য আনে, সে ফুলের গাছ! তারচে বড় কথা, রজনীগন্ধা আমারও ভীষণ প্রিয় ফুল!

একবার রজনীগন্ধার চারা এনে বাবা ভাড়াবাড়ির উঠানে লাগিয়েছিল! গাছ কি আর গাছ থাকলো! রীতিমত ঝোপঝাড় হয়ে গেল! ফুল আর ফোটে না! পরে এক পড়শি আবিষ্কার করলেন, এটা ফুল ঝাড়–গাছ! যাই হোক! সে গাছ সুবাস ছড়ালো না! আমরা কয়েকমাস ফ্রিতে ঝাড়– পেলাম! প্রতিবেশীরাও!

রজনীগন্ধা নিয়ে আমাদের যখন এই অবস্থা, কারো ছাদে রজনীগন্ধা আছে, শুনলে, না চমকে উপায় আছে?

স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে দেখলাম, একটা রজনীগন্ধার ডাঁটা! মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে!

সেই থেকে আমার মুগ্ধতা ওয়ারির দিদিমার বাড়িটার প্রতি! দিদিমার মেয়ে বড় মাসির (নামটা নেয়া গেল না, যদি সংসার ভাঙে! দুই মেয়ে নিয়ে কই যাবে মাসি?) প্রতি!

যত বড় হয়েছি, বার্তা বাহক পোঁছে দিয়ে যেত সংবাদ তাদের!

দিদিমার সংসার বড় হচ্ছে! কোল আলো করে পুত্রসন্তান এসেছে দিদিমার! জৌলুস বাড়ছে! ইত্যাদি, ইত্যাদি!

তারপর আমরা জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম! নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে রইলাম! জৌলুস এড়িয়ে চলি! তবু আমাদের ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঠিক পৌছায়! নিয়মিত বড়মাসিদের খবর পাচ্ছিলাম!

বড় মাসি, ভালো বর পেয়েছে! শাশুড়িকে চোখে হারায়! ‘ওষুধ-পথ্য’ কোন কিছুর কমতি নেই! যত্নআত্তির সীমা টানতে জানে না ‘জামাই বাবা জীবন!’

তখনও জানতাম না, চাঁদের ‘মরা আলোর’ খোঁজ দিতে নেই! তাতে চাঁদের গায়ে কলঙ্ক লাগে!

হঠাৎ গত পরশু অপরূপ নীল চোখের দিদিমা, আমার বাসায় উপস্থিত! আত্মহত্যার চাইতে নাকি, অন্যের বাসায় কাজ করে খাওয়াও ভালো।

হতভম্ব, বিহ্বল আমি। কী হলো? রজনীগন্ধা! জৌলুস! নীল-নয়নার অহংকার! সব কোথায় হারালো? ছয় সন্তানের গর্বিত জননী, আজ মৃত্যুই কি তাঁর একমাত্র অবলম্বন?

দিদিমার জীবনের গল্পটা লম্বা! কেটে- ছেঁটে বললে বলতে হয় এই- দাদুর একদিন দু’-চোখ অন্ধ হয়ে গেল! আর তাতে বড় কোম্পানির মোটা অংকের চাকরিটা গেল! তারপর সংসার চালাতে গিয়ে দিদিমার গয়না, জমিজমা সব বিক্রি করতে হলো! বড় মাসি এম.এ পাশ করলো। ছোট মাসি বি.এ। তিন ছেলে কোনরকমে টেনে-টুনে ইন্টারমিডিয়েট।

বড় মাসি পাশ করেই চাকরিতে ঢুকে গেল! সংসার চালাতে হবে! ছোট ছোট ভাইদের মানুষ করতে হবে! সংসারে বড় সন্তানের অনেক দায়িত্ব! তাই বয়স চল্লিশের দোরে পৌঁছালেও বিয়েটা আর করা হলো না! এদিকে ছোট মাসির মোটা টাকা পণে বিয়ে হয়ে গেল! মাসির ছোট দুই ভাই কোনোমতে চাকরি জুটিয়ে নিল!

বয়স যখন চল্লিশ, বড় মাসি প্রেমে পড়লেন! অতঃপর বিয়ে!

বরপক্ষের শর্ত একটাই! কোনো দাবি নেই! শুধু মেয়েকে সাজিয়ে দিতে হবে! আর বিয়েতে বরপক্ষ আসবে দেড়শ জন! তাদের ‘ভরপেট’ তৃপ্তি সহকারে খাওয়াতে হবে!

ততদিনে দিদিমার ঝুলি শূন্য! শুধু পুরান ঢাকার ওয়ারির সেই দু-কাঠার বাড়িটা আছে (সরকারের কাছে লিজ দেয়া ছিল)! তবু মেয়েটাকে তো পার করতে হবে! ঘরে বসিয়ে রাখলে তো চলবে না! মেয়ে হয়ে জন্মেছে! স্বামীর ঘর তো করতেই হবে!

কিন্তু বাড়ি বিক্রি করলে, তিন ছেলেকে নিয়ে দিদিমা থাকবে কই! মাসি তখন একটা হাসপাতালে প্যাথোলজিস্ট হিসেবে চাকরি করে। বেতন তেইশ হাজার।

সিদ্ধান্ত হলো, বড় মাসির বিয়ের পর, দিদিমারা একটা ভাড়াবাড়িতে উঠবে। বাসার ভাড়া মাসি দেবে। মামার বেতন সাড়ে ছয় হাজার! এদিয়ে কোনোমতে সংসারটা চলে যাবে!

বাড়ি বিক্রি! ঘটা করে বিয়ে! বরপক্ষ মোটামুটি তুষ্ট! সেসব জোগাড় কীভাবে- কী, এসব বরপক্ষের না জানলেও চলে!

দিদিমা, তিন ছেলেকে নিয়ে উঠলেন দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট বাসায়! ভাড়া সাত হাজার! বড় মাসি বরকে না জানিয়ে, পাঁচ হাজার করে টাকা দিতেন! আর বললেন, বাকিটা তোমরা চালিয়ে নাও।
এভাবে নির্বিঘ্নে ছয় মাস।

পরের মাসে লেগে গেল ধুন্ধুমার! মাসির বর, মাসির অফিসে গোয়েন্দাগিরি করে জানতে পারলো, মাসির বেতন আঠারো হাজার নয়! তেইশ হাজার!

বাড়িতে ফিরে জবাবদিহি। ‘তোমার বেতন তো শুনলাম তেইশ হাজার! সংসারে পনেরো হাজার টাকা দাও! বাকি তিন, তোমার হাতখরচ! বাকি পাঁচ কী করো! কোথায় খরচ করো! জবাব চাই!’
বড় মাসি বললেন, মাকে দিই! মায়ের বাসার ভাড়া!

পুরুষসিংহ গর্জে উঠে! এ বাড়িতে থাকতে হলে, মাকে টাকা দেয়া চলবে না! ওরা চলুক ওদের মতো। তোমার ওদের নিয়ে চিন্তা এখন আর করতে হবে না!

অগত্যা মাসি, সংসারে বিশ হাজার দিয়ে, তিন হাজার নিজের হাতখরচের জন্য রাখতো! আর এই টাকাটা খরচ না করে, মাকে দিয়ে আসতো!

গোয়েন্দা বর (মূল পেশা প্যাথোলজিস্ট, গোয়েন্দা শুধু বউয়ের খবর জানতে), জানতে পেরে ঘোষণা করলেন, চাকরি ছেড়ে দাও! চাকরি করার দরকার নাই!

সেটা বিয়ের দু’বছর পরের কথা। মাসির মেয়েটা সবে এক বছরের! চাকরি ছাড়লো। তাতে করে দিদিমার সংসার আর চলে না। দিদিমার সংসারে অশান্তি শুরু হলো। মামাদের ওই সাড়ে ছয় হাজারে কি আর হয়!
মাসি লুকিয়ে একটা ক্লিনিকে চাকরি শুরু করলো। মাত্র সাতদিন। এরপর গোয়েন্দা ব্যাটা ধরে ফেললো হাতে-নাতে। কিছুদিন পর আরো একটায়। সেটাও লুকিয়ে।

পুরুষসিংহ এবার অন্য পথ ধরলেন। মেয়েকে নিয়ে অফিসের কোয়ার্টারে উঠলেন। এবং সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন, যদি মায়ের সংসার চালাতে হয়, তবে মেয়ে আর স্বামীকে হারাতে হবে। এই সংসার করা চলবে না।

অগত্যা! অগত্যা! অগত্যা!

চিরকালের ধনী কন্যা দিদিমা কীভাবে সংসার চালিয়েছে, তাঁর চোখের জল ছাড়া আর কেউ জানে না! ধার করে করে ‘সংসারটা’ যখন গলাজলে ডুবে গেল, ছেলেরা গর্জে উঠলো!

‘আমাদের ভবিষ্যৎ নেই? আমাদের পথে বসিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছো! মাথার ছাদটাও কেড়ে নিয়েছো মেয়ের জন্য! এখন মেয়েও তো আমাদের দেখে না!

আরো কত ঝগড়া! বৎসা! মারামারি! কাটাকাটি! বড় ছেলেটা বাড়ি ছেড়ে দিল! একটা দোকানে কাজ শুরু করলো ‘পেটে ভাতে’!

সম্প্রতি পাওনাদাররা আলটিমেটাম দিয়েছে কোরবানি ঈদের আগে পুরো টাকা না দিলে ‘দড়ি দিয়া বাঁধিয়া’ নিয়ে যাবে!

ছেলের পুরো রাগ এসে পড়লো মায়ের ওপর।
অতঃপর! ‘প্রচণ্ড গর্জনে আসিল একি দুর্দিন, দারুণ ঘনঘটা, অবিরল অশনিতর্জন।’

নীলনয়না বৃদ্ধা বাড়ি ছাড়লেন এক কাপড়ে! ‘মৃত্যু বড় কঠিন! তাই জীবনেরে ভালবাসিলেন তিনি!’
আর বাড়ি ফিরবেন না! কেউ তাঁর নয়! পুত্র-কন্যা কেউ নয়! ঠাঁই নিলেন আমাদের বাড়িতে!

সন্তানেরা কেউ তার খোঁজ জানে না! তিনিও গুমড়ে মরেন! সন্তানদের কাছে ফিরে যেতে চান! কিন্তু উপায় তো নেই কোনো! নীল চোখ গড়িয়ে যেন বিষাক্ত জল গড়ায়!

যে চোখ জোড়া আমার কাছে প্রবল আকর্ষণের ছিল, সেই চোখে চোখ রাখতে পারিনা! কেঁপে উঠি!
তিনি যেন আমায়ও একটা সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন! কন্যাসন্তান জন্মায় বোঝা হয়ে! তাকে বড় করো। মানুষ করো! যোগ্য করে গড়ে তোলো পরের ঘর আলো করার জন্য! তোমার নিদানকালে, সে একফোঁটা জল দেবার অধিকারও রাখে না! নারীর সব সিদ্ধান্ত পুরুষের! নারী জন্ম নেয়, পরের বাড়ির সম্পত্তি হবার জন্য।

গত তিনদিনে দিদিমা ঘরময় ঘুরে বেড়ায়! বিড়বিড় করে কীসব! প্রতিধ্বনি হয়, ‘কন্যাসন্তান জন্ম দেয়া পাপ, বড় পাপ। বোঝা! দায়! পৃথিবী থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করো এই পাপগুলোকে!’

আমি শিওরে উঠি! অজান্তে আমিও বিড়বিড় করি, ‘কন্যাসন্তান চাই না!’

(নিবন্ধটি সরলীকরণ করবেন না পাঠক! অনুভব করার চেষ্টা করুন হৃদয় দিয়ে।)

২০.০৮.২০১৭
দারুস সালাম, ঢাকা
দুপুর ১.০৫ মিনিট

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.