ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:
গত দুই সপ্তাহের খবরগুলোতে চোখ রাখলে বোঝা যায় দেশের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। পদ্মা – যমুনা – মেঘনা – ব্রহ্মপুত্র – বুড়িগঙ্গা – সুরমা- করতোয়া – আত্রাই – শীতলক্ষ্যা – রীতিমতো ফুঁসছে প্রধান নদ – নদীগুলো। উত্তরাঞ্চল ডুবেছে আগেই। পানিতে ভাসছে দিনাজপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা। কুড়িগ্রামের নয়টি উপজেলার প্রতিটি গ্রাম মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। নতুনভাবে প্লাবিত মধ্যাঞ্চল। ঝুঁকিতে আছে দক্ষিণাঞ্চলও। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যানুযায়ী, দেশের ২৭ জেলায় সাড়ে ৫৭ লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এবং মৃতের সংখ্যা একশ ছাড়িয়েছে।
বিভিন্ন অঞ্চলে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। বন্যা কবলিত অনেক এলাকার সাথে সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ডুবে গেছে ফেরী ঘাট, ত্রাণের জন্য হাহাকারের খবরও আমাদের অজানা নয়।
মানুষের দুর্ভোগ অসহনীয় পর্যায়ে। ভয়াবহতার মাত্রায় এবারের বন্যা ‘৮৮ এর বন্যাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
এখনো পর্যন্ত আমরা যারা শুকনো ও নিরাপদ স্থানে আছি তারা আসলে খবর পড়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি দেখে ঠিক কতটুকু অনুধাবন করতে পারছি , পচা, নোংরা, দূষিত পানিতে ভাসছে, মানবেতর দিন পার করছে – খড়কুটো নয়, পোকামাকড় নয় – ওরা মানুষ? চারিদিকে থৈ থৈ পানিতে ভাসছে শিশু থেকে বৃদ্ধ – সকল বয়সী মানুষ। সেইসাথে প্রবল স্রোতের টানে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, উঠোন, সংসার, আসবাব, হাঁড়িপাতিল, বিছানা – বালিশ, লোটা- কম্বল, স্কুল – কলেজ, বইখাতা, ক্ষেতের ফসল, গবাদিপশু – জীবন-জীবিকা – দৈনন্দিন।
গতকালের প্রথম আলোতে কুড়িগ্রাম জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি খবর ছাপা হয়েছে। ঘরে পানি উঠতে শুরু করেছে। বিছানাপত্তর, বাসনকোসন যে যা পারছে, আঁকড়ে রাখার চেষ্টা চলছে – এ অবস্থায় প্রসববেদনা শুরু হয় আনোয়ারার। এদিকে পানি বেড়েই চলেছে। মা এবং ভাবীর সাহায্যে চৌকির ওপরে প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় আনোয়ারার। রাতটুকু কোনোরকমে পার করে পরদিন সকালে একদিন বয়সী শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে নৌকায় উঠতে হয় আনোয়ার পরিবারকে। আশ্রয় বলতে সড়কের ওপরে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি ছাপড়া। এর মাঝে নবজাতক শিশুটি একবার মার কোল থেকে পড়ে গিয়েছিল পানিতে। বাচ্চাটা ভালো নেই সেই থেকে।
এ তো মোটে একজন আনোয়ারার কথা আমরা জানলাম। আরো কত শত আনোয়ারাদের এমন কঠিন যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই সর্বনাশা বানের জল তার হিসেব কে রাখে?
প্রাণটুকু হাতে নিয়ে বেঁচে থাকা সর্বশান্ত মানুষগুলো অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিয়ে পার করছে প্রতিটি মুহূর্ত। প্রয়োজন মেটাবার মতো টিউবওয়েল ও টয়লেটের অভাবে নারী ও শিশুদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও ইউনিসেফ থেকে মোটা প্লাস্টিক শিট দিয়ে আপাতত টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে দিনরাত মানুষের লাইন।
মশা, পোকামাকড় আর সাপে কাটার ভয় তো আছেই। পানিতে ডুবে, সাপের কামড়ে মৃত্যু হচ্ছে মানুষের। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। সব মিলিয়ে জনজীবনে এক কঠিন বিপর্যয় নেমে এসেছে। চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে মানুুুষ ও গবাদিপশু। যারা ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণ করছেন – অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সাথে তাদের তালিকায় মেয়েদের জন্য স্যানিটারি প্যাড, তুলার প্যাকেট আছে কিনা জানতে চাইছি।
খবর দেখছি, পড়ছি, শুনছি, লিখছি – সবই শুকনো খটখটে নিরাপদ জায়গায় বাস করে। বন্যা কবলিত অঞ্চলগুলোতে কীভাবে বেঁচে আছে পানিবন্দী অসহায় মানুষগুলো ভাবতে পারছিনা।
ইতিমধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে অনেকেই এগিয়ে আসছেন । আসাটাই মনুষ্যত্বের পরিচয়। তারপরও শুরু থেকে দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে আরো বেশি তৎপরতা প্রত্যাশিত ছিল। দেশের অর্ধেক মানুষ পানিবন্দী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ, দুর্গত এলাকায় পর্যাপ্ত ও দ্রুত ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী বলেছেন, তিনি ত্রাণ দেবার নামে সেল্ফি তুলতে যাননি। সেটাই স্বাভাবিক। সেটাই হওয়া উচিৎ। জনগণ এমন দায়িত্বশীল আচরণই আশা করে প্রতিটি আক্রান্ত এলাকার জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাল যাচ্ছেন দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমগ্র জীবন নিবেদিত হয়েছিল জনগণের কল্যাণে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস,তাঁর কন্যা জাতির জনকের আদর্শ অনুসরণ করে জনগণের পাশেই থাকবেন।
বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ক্ষতিগ্রস্ত, বিপর্যস্ত জনজীবন স্বাভাবিক ও চলমান করতে আরো অনেক সহযোগিতা প্রয়োজন।
সামনে কুরবানি ঈদ। কুরবানির টাকা বাঁচিয়ে বন্যার্তদের দেবার কথা বলাতে অনেকেই অন্যদের বিরাগভাজন হচ্ছেন। পক্ষে – বিপক্ষে অনেক যুক্তি। কুরবানির সাথে বিশাল ত্যাগের মহিমা জড়িয়ে আছে। কিন্তু খুবই দুঃখজনক যে আজকাল অনেকের কাছেই কুরবানি একটা লোক দেখানো, প্রতিযোগিতার মতো – যার সাথে কুরবানির ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও ভাবগাম্ভীর্যের মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কুরবানির অর্থ পাড়ার সব লোকের চক্ষু চড়কগাছ করতে সবচেয়ে দামি গরুটা কিনে এনে নিজের ক্ষমতা আর আধিপত্য জাহির করা না।
আল্লাহকে গভীরভাবে অন্তরে ধারণ করে, ভালোবেসে বান্দার প্রাণাধিক প্রিয় কোনকিছুকে বিনা শর্তে, বিনা প্রমাণে, বিনিময়ে কোনো প্রতিদানের আশা না করে নিঃস্বার্থভাবে সঁপে দেয়ার নাম কুরবানি। কুরবানি ইবাদত। কুরবানি তো গরিবের হক আদায়ের। সেখানেই ত্যাগের মহিমা।
অথচ আমরা কী দেখি? নামমাত্র বাটোয়ারা সেরে কুরবানির মাংস ঠেসে এক ফ্রিজে তো চলেই না, বাড়তি ডিপ ফ্রিজটারও দরজা পারলে রশি দিয়ে বাঁধার উপক্রম! এ আবার কেমনতরো ত্যাগ স্বীকার?
আমি জানি না দেশের লক্ষ লক্ষ পানিবন্দী মানুষের অসহায় আহাজারি আর কঠিন দুঃসময়ে এবারের ঈদ কতটুকু আনন্দ বয়ে আনবে! কারা কুরবানি দেবে, কারা পাবে আর কারাই বা খাবে?
মানুষগুলোর এখন গোশত খাওয়া জরুরি নাকি পুনর্বাসন জরুরি? যারা যথাযথ তাৎপর্য মেনে কুরবানি দিতে পারবেন তাদেরই দেয়া উচিৎ। সেইসাথে আপনার রোজকার বাড়তি বিনোদন থেকে খরচ বাঁচিয়ে লক্ষ লক্ষ বানভাসি মানুষের
পাশে এসে দাঁড়ান। দয়া করে না, কর্তব্য মনে করে। কে বলতে পারে, কাল হয়তো আপনি, আমি যে কেউ প্রকৃতির কাছে এমন অসহায় হয়ে পড়তে পারি!