নারীর শরীর ও তাঁর যৌনতা

শেখ তাসলিমা মুন:

এ শিরোনামে লেখাগুলোর এটি আরও একটি দরকারি বিষয়। যে শব্দগুলোকে মুক্ত করা জরুরি। নারীর শরীর সহস্র বছর ধরে একটি সাব্জেক্টের মত অবজেক্টও। যাকে বিষয়বস্তু যেমন করা হয়েছে, করা হয়েছে নিষিদ্ধতার এক অন্ধকার অঞ্চল। এ নিষিদ্ধতার চোরাবালিতে নারী শরীরের উপর সন্ত্রাস বেড়ে চলেছে বল্গাহীনভাবে।

একটি সমাজ কাঠামো, রাষ্ট্র তার শিক্ষানীতি উন্নয়নের মাধ্যমে বদলে যেতে পারে অনেকাংশে। রাষ্ট্র যতদিন মোল্লাদের ক্ষমতার উৎস মনে করবে, ততদিন একটি রাষ্ট্র এবং সে দেশের নাগরিকদের তারা পেছনে ফেলে রাখবে। একটি দেশের গণতন্ত্র যত শক্তিশালী, সে দেশের মোল্লা ও পুরোহিত শ্রেণীর ক্ষমতা তত কম। ক্ষমতালিপ্সুতার কাছে তাদের যে অরাজকতাগুলো লালন করতে হয় তার ভেতর একটি অন্যতম হলো মৌলবাদ এবং কুসংস্কার। মানুষকে হাজার বছর ধরে এর অন্ধকারে রাখা যায় সহজে। দেখা যায় এ মৌলবাদ ও ধর্মের অন্ধকারত্বে যে সমাজ গড়ে ওঠে সে সমাজ সব থেকে পশ্চাদপদ সমাজ এবং জনগোষ্ঠী। এ পশ্চাদপদতার প্রধান বলি সেজন্য নারী হয়ে ওঠে। নারীর অবস্থান সেসব সমাজে সবচাইতে নাজুক হয়ে ওঠে। মূলত একটি সমাজ কতটা উন্নত সেটি দেখতে নজর দিতে হবে সে দেশের নারীদের অবস্থান কী সেটির উপর। যে সমাজ নারীর অবস্থানে যত বেশি এগিয়ে, সে সমাজ তত বেশি এগিয়ে।

কিন্তু বিষয়টি কি কাজ এবং প্রচেষ্টা ছাড়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে? সেটা ভাবার অবকাশ আমাদের নেই। এগুলোর জন্য দেশের অন্ধকার দিকগুলো কী কী সেগুলো চিহ্নিত করা আগে দরকার। দেখতে হয় কী কারণগুলো এই পশ্চাদপদতার কারণ এবং তা থেকে উত্তরণকে আটকে আছে। যদি সেগুলো চিহ্নিত করা যায়, তাহলে তার সমাধানের কাজগুলো অনেক সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। সমস্যা হলো পশ্চাদপদ রাষ্ট্র কৌশলে এ বিষয়গুলো এড়িয়ে যায় শুধু ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক একচ্ছত্রতা কায়েমের জন্য। যে কোন অব্যাবস্থায় সেজন্য নারীর ভাগ্য স্থায়ীভাবে বন্দী হয়ে যায়। রাজনৈতিক সুবিধাবৃত্তি গ্রাস করে নেয় নারীর ভাগ্য।

একটি দেশ মূলত একটি হোমোজেন গ্রুপে গঠিত নয়। এটি এমনকি উন্নত দেশেও সম্ভব নয়। একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা, বিশ্বাস, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির মানুষ থাকে। এটিকে ইতিবাচক শক্তিতে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, সে বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রগুলোর সদিচ্ছা তো নাই-ই, বরং এগুলোকে নেগেটিভ শক্তিতে রূপান্তর করে একে অপরের শত্রু হিসেবে নিজেদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রাখে।

উন্নত দেশে আমি দেখেছি, অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া জনগণের জন্য তথ্য ও কর্মসূচি সরবরাহ করার অভিপ্রায়ে অবিরতভাবে প্রকল্প নেওয়া হয়। সমাজের উন্নত চিন্তার গোষ্ঠীকে জনগণের কাছে আস্থাশীল অবস্থানে আসতে হয় এ কারনে যে তারা একটি সামগ্রিকের জীবনে বড় ভূমিকা রাখে, যা একটি সামগ্রিক ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।

এখানে উন্মুক্ত শিক্ষানীতি অবশ্যই একটি বড় ভূমিকা রাখে। ধর্ম মানুষের মনের একটি বড় বিষয়। সাধারণ মানুষ ধর্ম এবং ঈশ্বর ভাবনা থেকে বেরুতে পারবে না। তাদের সেটি একটি আশ্রয়। ঈশ্বর তাদের অবলম্বন। এদিকটি অনেক উন্নতভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, যদি একটি দেশের শিক্ষা উন্নত হয়। প্রতিটি শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মকে একটি মৌলবাদ প্ল্যাটফর্মে পরিণত না করে তাকে যদি কন্সট্যান্ট একটি গবেষণাকেন্দ্রে পরিণত করা যায়, তাহলে ধর্মের মূল মেসেজ বজায় থাকে সম্পূর্ণভাবে এবং ধর্ম মানুষের জীবনে মৌলবাদ অন্ধকার নয়, বরং একটি একটি আলোকিত অধ্যায় হয়ে উঠতে পারে।

ধর্মকে একটি নরখাদকের ভূমিকায় এনেছে অশিক্ষা এবং সুবিধাবাদী অসাধুরা। ধর্ম এবং ঈশ্বরকে অমানবিক বীভৎস করে তুলেছে আর এক ধরনের জ্ঞানহীনরা। অথচ এদের হাতে ধর্ম এবং ঈশ্বরকে ছেড়ে দেওয়ার কথা কিন্তু একটি আধুনিক রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না। কিন্তু কেন সেটি হয়েছে, হচ্ছে, সেটি সামান্য চিন্তা করলেই আমাদের সবার কাছে পরিষ্কার হবে। এগুলো সুচিন্তিতভাবে তাদের কাজ, যারা একটি জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে রাখতে চায়, যারা একটি জনগোষ্ঠীকে অকল্যাণে নিমজ্জিত রাখতে চায়, একটি জনগোষ্ঠীর মেরুদণ্ড ভেঙে রাখতে চায়। আর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হয় না। একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার, এ অকল্যাণের সমস্ত প্রক্রিয়া ঘটানো হয় পুরুষের হাত দিয়ে। এভাবেই পুরুষতন্ত্র প্রোথিত করা হয়।

হাজার বছর ধরে ধর্ম ঈশ্বর রাষ্ট্র আইন সমাজ পরিবার মূল্যবোধের রচয়িতা পুরুষের উপর প্রবর্তিত। এটি চলছে হাজার বছর ধরে। আর তাদের হাতেই নারীর ভাগ্য নির্ভর করে আছে। তারাই নারীকে মূল্যায়িত করছে, অবমূল্যায়িত করছে বা পুরস্কৃত করছে। এখন এই কেউ বলবেন এই পুরুষ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ছাড়া নারীর উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব? এই গোষ্ঠীর শিক্ষার এবং মানসিকতা পরিবর্তন না করে কিভাবে সমাজ রাষ্ট্র আইন বিচার ধর্ম পরিবার নারীর পক্ষে আনা সম্ভব? এ বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।

নারীর বেরিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ শুধু নারীর উপর অর্পণ করে যে পরিবর্তন আমরা পাচ্ছি তা নারীর দুর্দশাকে এতো বেশি প্রকট করে তুলছে, নিয়ত তা কেবল নারীর বাঁচা মরার যুদ্ধে পরিণত করে অন্য নারীর কাছে ভীতিকর করে তোলা হয়। আর ‘নবীর পথে বুড়ির কাঁটা’ দেওয়ার মতো রাশি রাশি কাঁটা পড়ে যাওয়া তো থেমে থাকছে না। নারীকেই সে কাঁটা একটি একটি করে সরিয়ে পথ চলতে হচ্ছে। সে পথ চলা কতটা দুরূহ, রক্তাক্ত, মন্থর, তা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধিবৃত্তির দরকার আজ আর নেই।

ফ্যাক্ট হলো, এ কাঁটাগুলো পুরুষকেই সরাতে হবে। যেদিন এটি সম্ভব হবে, সেদিন এ সমাজ এক ভিন্ন সমাজ হয়ে উঠবে। আর সেটির জন্য আমাদের শিক্ষাকে উন্মুক্ত করতে হবে। শিক্ষার প্রত্যেকটি বিভাগকে প্রত্যেকটি বিভাগ থেকে আলাদা করতে হবে। ধর্ম দর্শন বিজ্ঞান বিষয়গুলোকে একে অপরের কাছে শত্রু করে তোলা চলবে না। বিষয়গুলোকে নিষিদ্ধ করাও চলবে না। আর শিক্ষা ব্যাবস্থাকে মোল্লাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া তো চলতেই পারে না, যা আমাদের দেশে বেশ কয়েক দশক ধরে চলছে।

আমি আগে উল্লেখ করেছি, নারীর শরীরের উপর সন্ত্রাসের কথা। এ ভায়োলেন্সের অনেকটা কারণ একটি সমাজে নারীর শরীর এবং সেক্সুয়ালিটিকে পাপ জোন করে রাখা। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ নারীর দেহকে কম বা বেশি পাপের আধার করে রেখেছে। মজার বিষয় যৌনতার সমস্ত বিষয়টি যেন একক নারী দেহের বিষয় হয়ে উঠেছে। নারী দেহকে করে তোলা হয়েছে যৌন বিস্ফোরক। যেন এ দেহটি সিন্দুকাবদ্ধ করে রাখলেই সামগ্রিকভাবে যৌনতাকে বন্ধ করে রাখা হবে।

অথচ যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠে নারী এবং পুরুষের উভয়ের শরীরের মিলনে। কিন্তু সেখানে সকল নিষিদ্ধতার ভার বহন করে নারী। যৌন সম্পর্কে নারী দেহকে একটি পাপ ও নিষিদ্ধতার অবজেক্ট করে তোলা হয়। এটি নিয়ে আজকের নারী এবং পুরুষ কেন ভাববে না, এটাই আমাকে যুগপৎ বিস্মিত করে। এ অবস্থানে নারী কিভাবে অসম্মানিত বোধ না করে থাকতে পারে? এ অবস্থানে পুরুষকে যৌন সন্ত্রাসী হিসেবে তৈরি যেমন করা হচ্ছে, আবার প্রকারান্তরে পুরুষকে একটি নেতিবাচক গোষ্ঠীতে পরিণত এবং স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে এভাবে যে, নারীর দেহ না ঢেকে রাখলে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, তারা এমনই পশু শ্রেণীর একটি শ্রেণী। যেকোনো পুরুষের জন্য এ অবস্থান লজ্জা এবং অসম্মান দিতে যথেষ্ট বলে আমি মনে করি।

কিন্তু উন্নত চিন্তার পুরুষেরা সেটি অনুভব করছে না। প্রিভিলেজড পুরুষ তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে এই ভেবে যে তারা ‘উন্নত শ্রেণীর’। এ সমস্যা তাদের নয়। এ সমস্যা অনুন্নত পুরুষের। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে তারা নিজেদের ‘উন্নত পুরুষ’ মনে করে অন্যদের ‘মন্দ পুরুষ’ এবং ‘আমাদের কিছু করার নেই’ মনোভাবে নিজেদের সুবিধাবাদী জীবন যাপনে মনোনিবেশ করছে। আর যার প্রেক্ষিতে পুরুষদের নিজেদের তথা একটি কালেক্টিভ পুরুষ সমাজের মানন্নোয়নে তারা কোন ভূমিকাই রাখছে না। আমি বিশ্বাস করি, এ শ্রেণীর পুরুষের সুবিধাবাদী মানসিকতা, মাইন্ডসেট, অশিক্ষা, জ্ঞানহীনতা, তথ্য অভাব, মানসিক দুরবস্থা সবচাইতে বেশি আর সেজন্য নারীর হেনস্থা এবং দুর্দশার কোন পরিবর্তন আমরা করতে সক্ষম হচ্ছি না।

নারীদেহ, যৌন ও প্রজনন না জেনে পুরুষ কীভাবে একটি সুস্থ ও সুখী যৌন জীবনের অধিকারী হতে পারে, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। এটা তো একটি বঞ্চনা। পুরুষেরই বঞ্চনা। পুরুষকে কেন নারীর দেহকে সন্ত্রাস কায়েম করে যৌন সুখ অর্জন করতে হবে? আর সে সুখ কি সে আসলেই পায়? পেতে পারে?

কোনদিন কোন অবস্থাতেই নয়। আমাদের এ অন্ধকার নষ্ট সমাজ তাদেরকে এভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে। এ অন্ধকারত্ব তাদের কিশোর বয়স থেকে অপরাধী করে গড়ে তুলছে। এরা ছড়িয়ে পড়ছে জীবনের সকল অঞ্চলে। সকল ক্ষেত্রে। এরা পরিবারে স্বামী বাবা ভাই চাচা মামা খালু। অফিসে বস, বাসে যাত্রী, সংসদে সাংসদ, মাঠে রাজনিতিক, বিদ্যালয়ে শিক্ষক, অপরাশেন টেবিলে ডাক্তার বা মুদির দোকানে দোকানদার। এরা মনের ভেতরে বহন করছে উন্মত্ত অপ্রেসড যৌনচিন্তা, অসুস্থ অপুষ্ট, অস্বাস্থ্যকর যৌনচিন্তা। যাদের জীবনে একটি সুস্থ যৌন উপভোগের অভিজ্ঞতা নেই। নিরন্তর অসুখী অসুন্দর যৌন উন্মত্ততা তাদের ভেতর জন্ম দিচ্ছে একেকজন ধর্ষকের। তারা সকল জায়গায় তার নাগালের ভেতরের নারীকে করছে সে উন্মত্ততার শিকার। সে নারী শিশু হতে পারে, কিশোরী বা বয়স্কা। কেউ বাদ যাচ্ছে না।

নারী এবং পুরুষের শরীরের এ অধ্যায় উভয়ের জন্য জানা একটি জরুরী বিষয়। অধ্যয়ন জরুরি। যা তাদেরকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অবস্থানে আনবে। একে অপরের সম্পর্ক সুস্থ হবে। একে অপরের যৌন জীবনে উভয়ের ভূমিকায় আনন্দিত এবং সুখী হবে। নারীর প্রতি সন্ত্রাস অবধারিতভাবে কমে আসবে।

স্টকহোম, সুইডেন
১৩ আগস্ট, ২০১৭

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.