নারী ধারণাটি কি কোন মনোলিথ?

অনুপম সেন অমি:

পশ্চিমা নারীবাদীরা আমাদের এই অঞ্চলের/উপমহাদেশের নারীবাদী ভাবনাকে একটা নির্দিষ্ট মডেলে দেখে। তাদের মত করেই তারা আমাদের সকল নারী শ্রেণিকে “থার্ড ওয়ার্ল্ড উইম্যান”—এই এক পদবীর কাতারে নামিয়ে আনে। আর এই এক টার্ম দিয়েই সংকুচিত করে নেয় ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও শ্রেণিসত্তার নারীদের। এই সংকোচন রাজনীতিতে আমাদের বিচিত্র নারী সমাজ ও তাদের শ্রেণিকে আমলে না নিয়েই, তাদের আত্ম, শ্রেণি, ধর্ম ও বর্ণ পরিচয়কে একটি একরৈখিক মাত্রায় নামিয়ে ফেলা হয়।

“তৃতীয় বিশ্বের নারী”—এই অভিধায় আমাদের বহুরৈখিক ইতিহাসে বিচিত্র নারী শ্রেণির যে সংগ্রাম তার অবলুপ্তি ঘটে। তাদের আলোচনা দেখলে মনে হতে পারে যেন শুধু অর্থনৈতিক বিচারে এই অনুন্নত জাতি রাষ্ট্রগুলোর নারী সংগ্রাম এক ও অভিন্ন। রাষ্ট্রের এই উন্নয়ন রূপরেখার উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই নারীবাদী বিশ্লেষণ/তত্ত্ব তাই আমাদের নিজেদের নারীবাদ বোঝার জন্য একটা অস্বচ্ছ মডেল।

এই মডেলটা নয়া-উপনিবেশবাদী। কেননা তাদের অঞ্চলে যে নারীবাদের ধারণা বিকাশ লাভ করেছে, তা মোটেও এরকম নয়। সেখানে “নারী” বলতে তারা সবাইকে বুঝায় না। সব শ্রেণিবিন্যাসকে স্বীকার করেই সেখানে নারীবাদী আলোচনা করা হয়। নারীর এরকম মনোলিথিক ধারণাটা আমাদের এখানকার জন্য বানানো মডেল। এটা আলোচনা/বিশ্লেষণের সুবিধার জন্যই হয়তো এই প্যাটার্নে তৈরি করা হয়েছে। এই প্রকল্প/প্রয়াস আমাদের ইতিহাস তাদের মতো করে তাদের বয়ানে পাঠ করবার চেষ্টামাত্র।

এখন লক্ষ্য করার বিষয় হলো, আমাদের এই অঞ্চলে নারীবাদ/নারীদের নিয়ে অধিকাংশ প্রকাশিত লেখারও একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পশ্চিমা মডেলের অনুকরণেই হোক/আর না বুঝেই হোক, এখানে “নারী” বলতে আমরা দেশের সব নারীকেই বুঝিয়ে থাকি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং শ্রেণি নির্বিশেষে। যেন সব নারীদের সমস্যাই এক। এমন তো হওয়ার কথা না।  

এই যে একটা শ্রেণি, যে শ্রেণিতে হয়তো লেখক নিজেই অবস্থান করেন, সেই নির্দিষ্ট শ্রেণিকে গোটা আপামর নারীজাতির সমস্যা মনে করাটা অথবা কেউ মনে করলে, সেই আলোচনা/বিশ্লেষণ সঠিক হতে পারে কি? যদি ধরেও নেয়া হয় এই সংকোচনপন্থা শুধু আলোচনা করার সুবিধার্থেই করা হয়, তাতেও একটা শ্রেণিগত বিপত্তি দেখা দিতে পারে। কেননা যখন কেউ ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি-পেশার, ধর্মের, ভাষার এবং জাতির নারী সকলকে রিডিউস করে একটা “মনোলিথিক”/সিঙ্গুলার অথবা একরৈখিক নারী-সমাজে পরিণত করে, তখন একদিক থেকে সমাজের যে বহুত্ব সেটাকেই পরোক্ষভাবে কিন্তু অস্বীকার করা হয়।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেন এই পশ্চিমা রাজনীতির ফাঁদে (অ/সচেতনভাবে) পা দিয়ে রেখেছি? আমাদেরও আলাপে/বিভিন্ন লেখায় এই সাধারণীকরণ ঘটতে দেখা যায়।  যেন আমরা মোটাদাগে বলে ফেলতে চাই একটা শ্রমিক নারী ও মধ্যবিত্ত নারী এবং একটা পাহাড়ি নারী ও উচ্চবিত্ত নারী সর্বদাই একই রাজনীতি ও অর্থনীতি দ্বারা পরিপুষ্ট। এমনকি তাদের আপাত অবস্থানে যে স্থানিক বৈচিত্র্য অর্থাৎ একেক শ্রেণির স্থানগত অবস্থানও যে ভিন্ন, তাও আলোচনার বাইরে রেখেই, আমরা নারীবাদের টনিক খুঁজতে চাই। এই বিশেষ প্রক্রিয়া আমাদের বোধের জগতে পশ্চিমাদের অব/চেতন দখলদারিত্বকেই বুঝায়। এটা এক ধরনের রিডাক্সনিস্ট/সংকোচনপন্থী চিন্তা-প্রক্রিয়া। একাধিক বহুধা-বিভক্ত গোষ্ঠী/দলকে একটি একক সমগোত্রীয় দল/গোষ্ঠী হিসেবে সংকুচিত করে ফেলা।

আমাদের নারীবাদের (অথবা নারীবাদ বলে যা কিছু ভেবে নিই আমরা) মোড়কে এই পশ্চিমা আধিপত্য অস্বীকার করার উপায় আর থাকলো না। এই হেজিমোনির প্রভাব কাটিয়ে না উঠতে পারলে আমরা হয়তো কোন শহুরে/মধ্যবিত্ত নারীবাদী ধারণাকেই ভ্রান্তভাবে “সর্বস্তরের নারীবাদ” হিসেবে উৎপাদন অথবা সব কিছুর মহৌষধ ভেবে প্রদর্শন করে যাবো। এই “শ্রেণি/জাতি-সচেতনতা বিবর্জিত নারীবাদ” যেমন নিজের অজান্তেই কলোনাইজ করে ফেলে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর সংগ্রামের ইতিহাস ও রাজনীতিকে, তেমন অন্যান্য সামাজিক/অর্থনৈতিক শ্রেণিতে অবস্থানরত নারীদের “এজেন্সি’কেও অবলুপ্ত করতে চাই। উপনিবেশ হয়তো এখানে এখন আর নেই, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশের আমদানি হয়তো আমরা এহেন চিন্তা-প্রক্রিয়ার উৎপাদনের ভেতরেই করছি।

পশ্চিমের নারীবাদী ধারণা/তত্ত্বকে অনুকরণ/প্রধান মনে করি বলেই, ওদের বুদ্ধিবৃত্তিকে ওদের মতো করেই আমাদের সমাজ কাঠামোতে ব্যবহার করছি/করতে চাইছি। এই রিডাকশনিজম/সংকোচনবাদ পুরুষতন্ত্রের ধারণার ক্ষেত্রেও চলমান দেখি। পুরুষতন্ত্রের ধারণাকেও “মনোলিথিক” একটা জায়গায় দেখতে পাই বিভিন্ন আলোচনায়।

“পুরুষ” ধারণাটাও “নারী” ধারণার মতো কোন এক একক সত্তা হিসেবে বুঝানোর চেষ্টা দেখি। তসলিমা নাসরিনের ও অন্যান্য অনেকের লেখাতেও একই আওয়াজ পাওয়া যায়। পুরো সমাজ কাঠামোতে যেন লড়াইটা কেবল “নারী” নামক একক কোন সত্ত্বার সাথে “পুরুষ” নামক একক কোন সত্ত্বার হচ্ছে। সমাজ-কাঠামোতে শোষক-শোষিত শ্রেণির বাইনারির মতো— যার ধারণা মার্ক্সিজমে আমরা পাই। মার্ক্সিজম এই দুই বাইনারির বাইরে আর্থ-সামজিক কাঠামোর লড়াই বিবেচনা করতে অভ্যস্ত না। তবে কি দুই শ্রেণির বাইরে আর কোন কিছু থাকতে পারে না?

একইভাবে এখানেও (নারীবাদী ভাবনায়) শুধু মনোলিথিক/সিঙ্গুলার “নারী” ও “পুরুষ” ধারণার অভিব্যক্তিও শোষিত-শোষকের বাইনারির মতোই আলোচনা/সমালোচনায় উঠে আসে। এটাতো শুধু সাধারণীকরণ ও সরলীকরণই না; বরং নানামুখী শ্রেণির অস্তিত্বকে এবং বিশেষত প্রান্তিক গোষ্ঠীর অবস্থান ও অস্তিত্বকেই অনুচ্চারিত রাখে।

আবার মনে রাখা দরকার এই শোষিত ও শোষকের অবস্থানও কোন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। সমাজের কোন একটি শাখায় একজন শোষক মানেই অন্যখানে সে শোষিত হবে না, এমনটাও না। ধরা যাক, যে নারী তার গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে শোষিতের ভূমিকা নিচ্ছেন, সেই কিন্তু অন্যখানে তার পরিবারে অথবা অন্য কোন ব্যক্তির দ্বারাই অবহেলিত, নির্যাতিত হতে পারেন। অন্যদিকে আছে শ্রেণির কথা। যেমন একজন উচ্চবিত্ত নারী যে পোশাকী স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারেন, অন্য শ্রেনিতে থেকে এই চর্চা কষ্টকরও হতে পারে। এক্ষেত্রে যে পুরুষতান্ত্রিক শোষণকে আঘাত করার কথা বলা হচ্ছে, তার অবস্থান তো একেক জায়গায় একেক রকম। এজন্যই এক পক্ষের কাছে যখন পোশাকের স্বাধীনতা পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে, অন্য পক্ষ (যে তার শ্রেণি ও সংস্কৃতিগত কারণেই এই অধিকার ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছে) সেই আন্দোলনে শামিল হতে চায় না।

আমি বলছি না এটা কোন শ্রেণিগত বিরোধ। কিন্তু শোষণের বয়ান তৈরি করার আগেই নির্ধারণ করা তো উচিত কোন শ্রেণি কোন উপায়ে শোষিত, এবং শোষণের অস্তিত্ব সেই শ্রেণিতে কোন পর্যায়ে অবস্থান করে/করছে। অন্যথায় সবাইকে এক কাতারে ফেলে যে নারীবাদের অনুশীলন হচ্ছে, তাতে অতিসাধারণীকরণ চলতেই থাকবে।      

সহজ কথা হলো, একমাত্র সেক্সুয়াল পরিচয়কেই যদি বিবেচনায় রাখা হয়, তবেই সব নারীকে “নারী” হিসেবে এক শ্রেণিতে দেখা যায়। অর্থাৎ তাবৎ বিশ্বের সব নারীই লৈঙ্গিক পরিচয়ে নারী। এইভাবে দেখলে আর কোন পরিচয় আমরা সামনে আনতে পারবো না। ধর্মীয়, ভাষিক, জাতিগত ও বর্ণগত পরিচয় তখন গৌণ হয়ে উঠে। “পুরুষ” ধারণাটির ক্ষেত্রেও বিষয়টা একইরকম। কিন্তু আমরা যখন সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে একজন ব্যক্তির জেন্ডারকেই প্রধান করে তুলি, তখন অন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভাষিক পরিচয় গুরুত্ব বহন করে না আর।

এছাড়াও এই প্রক্রিয়ায় “ইউনিভার্স্যাল উইম্যান” এর ধারণা আমলে নিলে বিশ্লেষণ সীমাবদ্ধ হয়ে যায় এবং “নারী” ধারণাটিই স্বকীয় ইতিহাস ও রাজনীতি বিচ্যুত অবজেক্টে পরিণত হয়। মনে হতে পারে, এই সিঙ্গুলার এবং অবজেক্টে পরিণত হওয়া নারীদের সবাই ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও একই সংগ্রাম/নির্যাতনের বয়ান নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে। বাস্তব কথা হচ্ছে, এরকমটা করে না/করার কথাও না।   

সকল নারীদের এক কাতারে ফেলতে পারলে হয়তো আলোচনা সহজ হতে পারে, নারীবাদী ভাবনার সহজিয়া তরিকাও হয়তো হতে পারে এই সিঙ্গুলার/মনোলিথিক/একরৈখিক “নারীর” ধারণার বিস্তার করা, কিন্তু এটি একটি সীমাবদ্ধ নারীবাদ/এরকমের কিছু একটা ভাবনা-প্রক্রিয়া।  

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের পাহাড়ি নারীটাকে, তার ইতিহাস, ভাষিক পরিচয় মেনে নিয়েই তার জন্য তার কথা বলার মতো টেক্সট তৈরি করতে হবে। অন্যথায় সেওতো এই সিঙ্গুলারিটিতে মিশে যাবে। যদিও নারী হিসেবে তার/তাদের নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাস এবং তাদের ভাষিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসও সম্পূর্ণ আলাদা। এখন শহুরে ও মধ্যবিত্তের নারীবাদী ধারণা (যেটা পশ্চিমা হেজিমনিতে আক্রান্ত) দিয়ে তার ইতিহাস বয়ান করা সম্ভব না। তার কন্টেক্সটে তাকে আলোচনায় আনতে হবে; কোন বিশেষ নারী শ্রেণির আলোচনায় তাকে ঢুকিয়ে ফেললেই হবে না। অন্য শ্রেণির ক্ষেত্রেও বিষয়টা তাই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.