শাশ্বতী বিপ্লব:
মেয়েটির নাম সুমী। বয়স কত হবে, ১৮/১৯ এর মতো। সিলেটের মেয়ে। বাবা ছোট বেলায় ছেড়ে গেছে। মা আবার বিয়ে করেছে। সেই ঘরে ছেলেপুলে আছে। সেখানে সুমীর জায়গা হয় না। একটা পার্লারে কাজ করতো। পাশাপাশি পত্রিকা/ ফ্যাশন ম্যাগাজিনে ছোটখাটো মডেলিং। ভীষণ মিষ্টি একটা মুখ। মোবাইলে ধরে রাখা মডেলিং এর ছবিগুলো থেকে চোখ ফেরানো যায় না। গানও গাইতো ভালো। স্বপ্ন ছিলো মিডিয়ায় কাজ করবে। একদিন তাকে সবাই চিনবে।
একজন প্রেমিকও ছিলো। যে তার ব্যাংক একাউন্ট মেইনটেইন করতো। তেমন কোনো সঞ্চয় যদিও তার ছিলো না। তবু বিশ্বাস করে প্রেমিককের কাছেই ছিলো সব দায়িত্ব। কিছুদিন পর যার সাথে ঘর বাঁধবে, তাকে অতটুকুন বিশ্বাস তো করাই যায়। আর কেউ তো নেই সুুমীর।
সব ঠিকঠাকই চলছিলো। বাঁধ সাধলো ওর মিডিয়ায় কাজ করার ইচ্ছা। প্রেমিক প্রবর এসিডে পুড়িয়ে দিতে চাইলো ওর সৌন্দর্য্য। প্রথমবার অল্পের উপর দিয়ে গেলো। স্থানীয় হসপিটালে চিকিৎসা করে ফিরলো ঘরে। কিন্তু দমে গেলো না। প্রেমিক বোঝালো থানা পুলিশ না করতে। রাগের মাথায় ভুল হয়ে গেছে, মাফ চাইলো। সুমীও মাফ করে দিলো।
কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। মেয়েটির অদম্য প্রাণশক্তি পোষালো না প্রেমিকের। এবার দ্বিতীয়বার এসিড ঢেলে দিলো। মুখসহ পুরো শরীর এসিডে পুড়িয়ে দিলো আচ্ছামতো। চেহারা বিকৃতির পাশাপাশি দৃষ্টশক্তি হারালো এবার সুমী। প্রথমে সিলেটে মেডিকেল এবং সেখান থেকে এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের হাসপাতালে জায়গা হলো ওর। সব দুর্ভাগ্য মেনে নিলেও চোখে না দেখাটা মানতে পারলো না কিছুতেই। বারবার দাবি জানালো, আমাকে একটু দেখার ব্যবস্থা করে দেন আপনারা। একটা বছর চোখে কিছুই দেখেনি। উন্নত চিকিৎসার জন্য চেন্নাই পাঠানো হলো। একটা চোখের দৃষ্টি কিছুটা ফিরে পেলো সুমী, পুরোপুরি নয়।
সুমীর এখন দুটো মাত্র চাওয়া। এক. পৃথিবীটা ভালোমতো দেখতে চায় সে। চোখের দৃষ্টি ফিরে পেতে চায় যেকোনো মূল্যে। দুই, একটা গানের সিডি বের করতে চায়। সে মিডিয়ায় কাজ করতে চেয়েছিলো। চেয়েছিলো সবাই তাকে চিনুক। যেহেতু মডেলিং করা আর হবে না, অন্ততঃ একটা গানের সিডি হলে তো শিল্পী হিসেবে চিনবে সবাই তাকে।
ওদিকে প্রেমিক প্রবর গ্রেফতার হয়েছিলো। অজামিনযোগ্য অপরাধ হলেও জামিনে বেরিয়ে এসেছে কয়দিন আগে। না, মেয়েটি তার প্রেমিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়নি। কিছুতেই সত্যি কথাটা বলানো যায়নি তাকে দিয়ে। প্রেমিক আবারও বলেছে, তার ভুল হয়ে গেছে, তাকে এখনও ভালোবাসে, তাকে বিয়ে করবে। সুমীকে বুঝিয়েছে প্রেমিকের পরিবারও। যেনো সে ছেলের বিরুদ্ধে কিছু না বলে। তারা তাকে ছেলের বউ করে নেবে ঘরে।
বোকা মেয়েটা তাই তদন্তকারী পুলিশকে বলেছে, সে জানেনা কে তাকে এসিড মেরেছে। কেন সে সত্যি বলছে না জানতে চাইলে যা বলে তার সারমর্ম হলো, প্রেমিক তার প্রতি অন্যায় করেছে সেটা প্রেমিকের সংকীর্ণতা। কিন্তু সে তাকে ক্ষমা করে দেবে। কারন সে তাকে ভালোবেসেছিলো!!!
কর্মসূত্রে গিয়েছিলাম এসিড ভিকটিমদের কাছে। এক একটা মেয়ের জীবন, এক একটা জীবন্ত বিভীষিকার গল্প। আমি একজনের গল্প কিছুটা বললাম শুধু।
সুমী চেয়েছিলো মানুষ ওকে জানুক, চিনুক। আমি লিখলাম, যদি কিছু মানুষও ওকে চেনে, ওর নাম জানে। এসিড সন্ত্রাসে ওর পুড়ে যাওয়া স্বপ্ন একবিন্দুও যদি পূরণ হয়। আমার সামর্থ্য কম, খুব বেশি কিছু করতে পারি না।