শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং আমাদের ধারণা রূপান্তর

রিয়াজুল হক:

আজ থেকে প্রায় ৫ বছর আগের কথা। তখন, আমি স্বাধীন পরামর্শক হিসেবে উন্নয়ন সেক্টরে কাজ করি। এক সকালে আমি একটি শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করলাম। একজন শিখন সহায়ক হিসেবে। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা হলেন সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ। সংখ্যায় তাঁরা ২৫ জনের বেশি হবে না।
পরিচিতির পর আমার অধিবেশন শুরু। শিখন প্রক্রিয়ায় আমি ‘বক্তৃতা’ পদ্ধতি বা হাল আমলের পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনার মাধ্যমে শিখন শেষ করতে আস্থাশীল নই। আমি ‘ধারণা স্থানান্তরের’ চেয়ে ‘ধারণার রূপান্তরে’ বিশ্বাসী। তাই আমি বয়স্ক শিখনে ‘অভিজ্ঞতানির্ভর ও ডায়ালোজিক্যাল’ শিখন পন্থার অনুসারী ও অনুশীলনজীবী।

শিখন যাত্রার শুরুতেই আমি প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীকে একটি করে ভিপকার্ড ও একটি আর্টলাইন মার্কার দিলাম। তাঁদেরকে প্রতিটি কার্ডে তিনটি করে তাঁর নিজ শরীরের প্রিয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম লিখতে বললাম। এজন্য দুই মিনিট সময় বরাদ্দ করলাম। লেখা শেষে তাঁদের কার্ডগুলো ভিপবোর্ডে পিন দিয়ে লাগিয়ে প্রদর্শন করা হলো। একজন শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষের সম্মুখভাবে এসে কার্ডে লেখা বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে অনুরোধ করলাম।

তাঁর উপস্থাপনার পর একজন শিক্ষক বললেন, ‘স্যার সব ঠিক আছে তো? আপনি তো আমাদের উত্তরের বিপরীতে কিছু বললেন না’। আমি বললাম, প্রথমত, আমাকে ‘স্যার’ সম্বোধনে আমি অভ্যস্ত নই। আমার নাম ধরে ডাকলে, বা নামের পর ভাই যুক্ত করে ডাকলে আমি প্রীত হবো। দ্বিতীয়ত, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের উত্তরের ‘মূল্যমান’ বা ‘সঠিকতা’ যাচাই করা আমার কাজ নয়, সেই ধৃষ্টতাও আমার নেই। অামি অন্যদের বেলায়ও তা করি না।

এরপর আমি তাঁদেরকে আবারও কার্ডে না লিখে মুখে একে একে আরও দুইটি প্রিয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম বলার অনুরোধ করলাম। যেগুলোর নাম তাঁরা কার্ডে লেখেননি। আমি সেই নামগুলো একে একে ফ্লিপচার্টে লিখলাম। আমি আর একজন শিক্ষককে ফ্লিপচার্টে লেখা অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো পড়ে শোনাতে বললাম। এরপর আমি মাল্টিমিডিয়াতে একজন নারী ও একজন পুরুষের শরীরের স্কেচ প্রদর্শন করলাম। উক্ত স্লাইডে তীর চিহ্ন দিয়ে নারী ও পুরুষের শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নির্দেশিত আছে।

এবারে আমি বললাম-এখানে নারী-পুরুষের কোন অঙ্গগুলো আছে, যা আমরা প্রিয় বলে ভিপকার্ডে লিখিনি এবং মুখেও বলিনি। সবাই একে একে সেই অঙ্গগুলোর নাম বললেন প্রদর্শিত ছবি দেখে। আমি সেগুলোর নাম ফ্লিপচার্টে লিখলাম। তবে ছবিতে প্রদর্শিত কোনো কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম বলতে গিয়ে অধিকাংশ শিক্ষকের (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) মুখ-অবয়ব কিছুটা লাল রঙ ধারণ করেছে। কারো মুখ ও দৃষ্টি অবনত। কেউ কেউ নিচুস্বরে সেই নামগুলো উচ্চারণ করেছেন। আমি মোটেও অবাক হইনি। এটিই তো হওয়ায় কথা।

আমি আবার প্রশ্ন করলাম, আমরা যদি শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে গুচ্ছ বা প্রকরণ করি-তবে কোন গুচ্ছের বা প্রকরণের অঙ্গগুলোকে আমাদের প্রিয় অঙ্গ বলে চিহ্নিত করিনি? এবারে তাঁরা উত্তর দিলেন ‘যৌন ও প্রজনন অঙ্গগুলো’। এরপর আমি সম্পূরক প্রশ্ন করলাম, কেন আমরা যৌন ও প্রজনন অঙ্গগুলোকে আমাদের প্রিয় অঙ্গ বলে চিহ্নিত করিনি? এগুলো কি প্রয়োজনীয় বা দরকারি নয়? তাদের উত্তর এলো – ‘এই অঙ্গগুলো গোপন’, ‘এই অঙ্গগুলো সংবেদনশীল’, ’এই অঙ্গগুলো প্রদর্শন করা যায় না’, ‘এই অঙ্গগুলো নিয়ে কথা বলা যায় না’ ইত্যাদি। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, শরীরে এমন কি কোনো অঙ্গ আছে- যা সংবেদনশীল নয়? যার ওপর ‘জিনগত এবং শরীরের নিজস্ব উপাদান ও বাইরের উপাদানজনিত অভিঘাত তৈরি হয় না, যাতে সংক্রমণ হয় না? উত্তরে তারা বললেন, না। এভাবে দেখলে শরীরে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গই সংবেদনশীল। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গই দরকারি।

আমি আবার প্রশ্ন করলাম, ‘গোপন অঙ্গ বলতে কী বোঝায়? তারা বললেন, যে অঙ্গ ঢেকে রাখা হয়, গোপন রাখা হয়। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, শিশিুরা কি কোনো অঙ্গ কাপড়ে ঢেকে পৃথিবীতে এসেছে? তারা বললেন ‘না’। আমি বললাম, তখনও কি শিশুদের ঐ অঙ্গগুলোকে গোপন বলবেন? তাঁরা উত্তর দেয়ার অগেই আমি বললাম-উত্তর পরে জানবো।

আর একটি প্রশ্ন করতে চাই। আমাদের দেশের অনেক পুরুষ তার শরীরের উপরের অংশে কোনো কাপড় না জড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়। তার ‘স্তন’ দেখা যায়। আমরা সেটিকে পুরুষের গোপন অঙ্গ বলি না কেন? একজন এডাল্ট পুরুষ ও নারীর স্তনের মধ্যে শুধু তফাৎ হলো-একজনের অবিকশিত, অন্যজনের বিকশিত। এবারে তাঁদেরকে উত্তরগুলো একসাথে দেয়ার অনুরোধ জানালাম।

আমার মনে হলো, তাঁরা কিছুটা ধন্দের মধ্যে পড়ে গেছেন। অমি ভাবলাম, তাদেরকে বেশিক্ষণ ধন্দের মধ্যে রাখা ঠিক হবে না, কারণ তাঁরা শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। আমি আবার পরিপূরক প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা আমাদের হৃৎপিণ্ড তো একটি muscular organ, যা প্রাকৃতিকভাবেই ঢাকা পড়ে আছে। আমরা তা দেখি না-তাহলে আমরা হৃৎপিণ্ডকে গোপন অঙ্গ বলি না কেন? আমরা তো হৃৎপিণ্ড প্রদর্শন করতে পারি না। তা হলে যা ঢাকা পড়ে আছে, কিংবা যা প্রদর্শিত হচ্ছে না অন্যের কাছে, এমন একটি ‘গোপন ও অপ্রদর্শিত’ অঙ্গ হৃদয় নিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক বাংলা গান শুনি কেন? ছোট-বড় সকলের সামনেই ‘হৃদয়’ নিয়ে গান শুনি কেন, আমাদের কেন লজ্জা লাগে না তখন?

আমি তাঁদেরকে একটু ভেবে উত্তর দিতে বললাম। আমি ইচ্ছে করেই টেবিলে রাখা পানি পান করলাম। দুই মিনিটের মতো সময় নিলাম। ওই সমেয়ে দেখি, অনেকে এ বিষয়ে পরস্পরের সাথে আলোচনা করছে। আমি এটিই চাচ্ছিলাম।
এবারে তাঁদের (নারী-পুরুষ উভয়ের) কাছ থেকে অনেক উত্তর বা মতামত আসতে শুরু করলো -‘এভাবে তো কখনও আমরা ভাবিনি’; ‘এভাবেই আমরা শিখে এসেছি’, ‘এভাবেই আমরা পরিবারের ছোটদেরকে শেখাই’, ‘এ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো নিয়ে উন্মুক্ত কথা বলা লজ্জার বিষয় বলে মনে করা হয় হয়’, ‘আমরা তা মেনে চলি’, ‘এটি আমাদের সামাজিক ওরিয়েন্টেশন, যা সামাজিকায়নের ফলশ্রুতি, ‘এই অঙ্গগুলোর নাম নিতে আমাদের অনেক সংস্কার (প্রিজুডিস) আছে’, ‘আমাদের শরীর ও এর অঙ্গপ্রতঙ্গ নিয়ে অনেক ট্যাবু (সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাধানিষেধ) আছে’, ইত্যাদি। আমি তাদের উত্তরগুলো সানন্দে গ্রহণ করলাম ‘সকালের সোনালী রোদ’ হিসেবে। শিখন যাত্রাটি তাহলে ভালোভাবেই শুরু হয়েছে।

সেখান থেকেই আমাদের এসআরএইচআর (SRHR is the concept of human rights applied to sexuality and reproduction) বিষয়ক ধারণাগত রূপান্তরের অভিযাত্রা শুরু হলো। ধারাবাহিকভাবে তা তিনদিন চলেছিল। তিনদিন পর শ্রদ্ধেয় সকল শিক্ষকই বললেন, এ আলোচনা জরুরি পরিবারের সকলের সাথে, বন্ধুদের সাথে, কিশোর-কিশোরী ও শিক্ষার্থীদের সাথেও। আমি বললাম, সংস্কার বা ট্যাবু কাজ করবে না? তাঁরা বললেন, ‘না’ কাজ করবে না। আমাদের অনেক ‘সামাজিক-সাংস্কৃতিক-জৈবিক-শারীরিক’ ধারণাগত মিথ ভেঙ্গে গেছে। এ বিষয়ে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেছে। আমাদের প্রায় সকলের চোখেমুখে তখন আনন্দ ও তৃপ্তির ঝলক। তাঁদের কয়েকজন আমার ফেসবুকে বন্ধু হয়ে গেছেন। ফেবুতে তাঁদের অনেক পোস্ট, আমাকে এখনও জানান দেয়-চিন্তার রূপান্তরের জন্য বিদ্যমান ধারণাকে প্রশ্ন করা, তার উত্তর সমবেতভাবে অনুসন্ধান করা, এ নিয়ে তর্ক,বিতর্ক-প্রতর্ক ইত্যাদির কোনো বিকল্প নেই।
গ্রামসির ভাষায়, যা হলো সমাজ রূপান্তরের ‘পরিখা যুদ্ধ’। এ যুদ্ধ না করে অধিকার প্রতিষ্ঠার ’সম্মুখ লড়াইয়ে’ আমরা যাবো কীভাবে?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.