মালবিকা শীলা:
নারীদেহ নিয়ে সাধারণ পুরুষের তুমুল আগ্রহ থাকলেও, নারী পুরুষ সবার কাছেই এই বিষয়টিকে নিষিদ্ধ করে তোলা হয়েছে। আমার বয়ঃসন্ধির সময়ে আগের প্লেইন জামা হটিয়ে জামা বানানো হতো বুকের কাছে কুচি দিয়ে। কেন? তার কারণ হচ্ছে ক্রমশ বাড়তে থাকা স্তনের দিকে যেন কারো লোলুপ দৃষ্টি না পড়ে! গোপন করে রাখতে হবে নারীত্বের সব নিদর্শন। এসব নিয়ে ভাবা, কথা বলাকে এখনও অসভ্যতা মনে করা হয়! যে শরীর থেকে প্রতিটি মানুষের উৎপত্তি, সেই শরীরই কি-না আলোচনায় নিষিদ্ধ থাকে! হায় রে আমাদের মেকী সভ্যতা!
আমার সাথে স্কুলে পড়া একটি মেয়েকে দেখতাম জামার নিচে শক্ত করে কাপড় দিয়ে স্তন বেঁধে রাখতো! বাইরে থেকে দেখে বুক একদম সমতল মনে হতো। এখনো এটা মনে হলে আমার দমবন্ধ হয়ে যেতে চায়। বয়ঃসন্ধিতে পাল্টে যেতে থাকা শরীরে অতি সংবেদনশীল অঙ্গে এই ধরনের অত্যাচার রীতিমতো অমানবিক! মেরুদণ্ড সোজা করে হাঁটলে শরীরের খাঁজ আর ভাঁজ প্রকট হয়ে ওঠে বলে মেয়েদের কুঁজো হয়ে হাঁটার একটা প্রবণতা দেখা যায়। নিজের শরীর নিয়ে এই অপরাধবোধের মাধ্যমে আসলে মেয়েটির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়। সারাজীবন অনেক মেয়েই আর মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না।
যেখানে নারীদেহ একটি সুন্দর শিল্পকর্ম হওয়ার কথা, সেখানে ট্যাবু বানিয়ে, নিষিদ্ধ করে শুরু থেকেই নারীর মানসিক জগতে নেতিবাচক, অন্ধকার একটা প্রভাব ফেলা হয়। আমি বলছিনা যে, মেয়েরা শরীর দেখিয়ে দেখিয়ে বেড়াবে, কিন্তু শরীর নিয়ে এই হীনমন্যতা কি মানুষ হিসেবে মেয়েটিকে ছোট করে দিচ্ছে না! নিষিদ্ধ বিষয়ে প্রায় মানুষেরই অপার আগ্রহ থাকে। নারীদেহকে নিষিদ্ধ বানিয়ে আসলে পরোক্ষভাবে আমরা ধর্ষণকে উৎসাহিত করছি। এসব এড়াতে চাইলে উদার আর উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে নারীপুরুষ উভয়কেই আলোকিত করতে হবে। ভুল ধারনা, তাবৎ কুসংস্কার ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে।
ঘরে বাইরে, ভীড়ে, জনশূন্য এলাকায়, নিজের লোক বা পরের হাতে প্রতিনিয়ত অপদস্থ হচ্ছে নারী। নিউমার্কেট অথবা গাউছিয়া কিংবা যে কোনো ভীড়ের মধ্যে গিয়ে নিজের শরীরে অপরিচিত পুরুষের ইচ্ছাকৃত স্পর্শ পাননি এরকম মেয়ে কয়জন আছেন? সেই তুলনায় অপরিচিত পুরুষের গায়ে হাত দেয় কয়জন মেয়ে! অহরহ এরকম অপমানের শিকার হলে মেয়েটি নিজের শরীরকে কিভাবে ভালোবাসতে শিখবে! অবচেতন মনে মেয়েটির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় তার নিজেরই শরীর।
একবার এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা কয়েকজন মিলে। জায়গা কম বলে রাতে আমরা একগাদা ছেলেমেয়ে একসাথে শুয়েছিলাম। কই কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা তো ঘটেনি! আমাদের পাশে শোয়া ছেলেগুলো কি পুরুষ হিসেবে অক্ষম ছিলো! না তো! তাহলে কিছু ঘটেনি কেন!
দুজন নারী-পুরুষের মধ্যে সেক্সের বাইরেও যে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে এটা অশিক্ষিত, মূর্খ কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। নারী-পুরুষের মধ্যে শুধু খাদ্য আর খাদকের সম্পর্ক, একটি মেয়ের ইজ্জত তার শরীরে, এইসব বস্তাপচা ধারনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। নারীপুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছাড়া সেটা কিছুতেই হবে না।
একটি গাছকে সুস্থ সবল বেড়ে উঠতে হলে যেরকম যথেষ্ট পরিমাণে আলো, বাতাস, পানির দরকার, একজন নারীর আত্মিক, মানসিক তথা সার্বিক উন্নয়নের জন্য তেমনি নিজের শরীর আর মনের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব থাকাটা জরুরি। ইটচাপা ঘাস বেঁচে থাকে ঠিকই, কিন্তু তার না থাকে রঙ, না থাকে আনন্দ। এইরকম বেঁচে থাকা কি মৃত্যুরই নামান্তর নয়?