নারী ‘পতিতা’ হলে তুমিও ‘পতিত’ নর

সালমা লুনা:

আপনি যা দেখতে চান বা পছন্দ করেন আপনার মগজটা আপনার কাছে ঠিক সেইটাই খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করবে। আপনি যদি দেখতে চান বাগানের ফুল তবে বাগানে গেলে ফুলই চোখে পড়বে । মনের মাঝে গোবরগাঁদা থাকলে বাগানে হাজার ফুল ফুটে থাকলেও গাছের গোঁড়ার গোবর টুকুতেই চোখ যাবেই যাবে!

আপনি নারীবাদীতে খোঁজেন বিড়ি ফুঁকা কইন্যা, ডিভোর্সী ঘর ভাঙানি মাইয়া।উদলা বডি নাইলে ক্লিভেজ বের করা আধুনিকা! জামার হাতার ফাঁক দিয়ে বুকের ভাঁজ, নাকি উড়না খুইল্লা বুক দেখাইন্না- মাল! নারীবাদ আপনার কাছে পুরুষের কাছে অপ্রিয় নারীর অতৃপ্ত আত্মার তড়পানো। মেনোপজ বন্ধ হওয়া নারীর অক্ষম আক্রোশ। পুরুষকে এক্সপ্লয়েট করা নারীর বাড়াবাড়ি ।

নারীবাদে কী আছে সত্যি বলতে আমিও জানি না।

কিন্তু আমি এইটুকু জানি একটু স্বাধীনতা ভোগ করলে,একলা পথে হেঁটে গেলে,মাথাটা একটু বেশিই উঁচু করে রাখলে ওই মেয়েগুলো কারো প্রিয় হতে পারেনা। ওইগুলা কারো মাঝে পেলে সে ডেফিনিটলি নারীবাদী এবং তার জীবন ত্যানাত্যানা ।

শুধু বাদীতার জন্য বিড়ি বিষয়ক আলাপ নিস্প্রয়োজন। 
দেন না, যার খুশি তাকে বিড়ি হুইক্কা খেতে দেন। এই বিড়ি আমি বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে গ্রামের বুড়া মহিলাগুলারে খেতে দেখেছি। চুলার পাড়ে বসে ধানের ইয়া বড় হাড়ির নীচে খড় আর শুকনা পাতা ঠেলতে ঠেলতে পাটশোলার আগুনে বিড়ির মুখাগ্নি। মাশাআল্লাহ্ ! সে কী চক্ষু মুইঞ্জা আরামের টান ! ওদের কাছ থেকে বিড়ি না হলেও ওই পাটশোলাতে লুকিয়ে টান আমরাও দিয়েছি।

কানের পাশে বিড়ি গুঁজে কপালে এত্তবড় গোল টিপ দিয়ে আমাদের সরকারি বাসার বাথরুম পরিষ্কার করতে আসতো কালো ঢ্যাঙ্গা নয়নতারা – বাবুদের ভাষায় সুইপারনি।

পরে জগতের বিত্ত ও বৃত্ত চেনার পরে জানলাম উচ্চবিত্তরাও টানে – তবে সেটি সিগারেট। লাইট সিগারেট। সে আলাদা জগত আলাদা বৃত্ত।

মুশকিল হয়েছে এই মধ্যবিত্ত নারীদের নিয়েই । এমনিতেই এদের তো জন্মই আজন্ম পাপ। তাই বিড়ি খেলে তো সব গেলো। এদের জন্য অলিখিত নিয়ম স্বামী দেবতার মাইর খাইলেও সংসার করতে হবে, স্বামীধন যৌতুক দাবি থেকে শুরু করে অন্য নারীসঙ্গ করলেও সংসার ধরে রাখতে হবে নারীকেই! নইলে যে নারীবাদীতার পাপ হে!

যে মেয়ে ক্লিভেজ দেখায় সে না হয় নারীবাদী। যে পুরুষ সকলের সামনে লুঙ্গি হাটুর উপর তুলে খচর খচর উদলা পেট আর বগলতলা খুঁজলায়, সে তবে কী ?

যে মেয়ে হিজাব পরে না শুধু উড়না বুকে ফেলে রাখে বা রাখেই না তার বুকের মাংসপিণ্ডের প্রতি আপনার আগ্রহী চোখ তো থাকবেই – এ যে আপনার বহু পূণ্যে পাওয়া নর জীবনের অধিকার।

আর চড়া মেকাপের হিজাবী নারীতে যে আপনার ভীষণ প্রীতি, তার মাথাখানা ঢাকলেই কী তার বুকের শেইপ, কোমরের খাঁজ পেটে কতটুকু মেদ তা আপনি ইসলামি বিধান মতে এড়িয়ে যান? আপনার চোখ আর কিছু খোঁজে না বুঝি?!!

ও আচ্ছা ! 
আপনার কাজ আপনি করবেন ,করে যাবেন কিন্তু এই নিয়ে আলোচনায় আপনার আপত্তি, এই তো?

আপনি যে কোন নারীর সাথে পরিচিত হবার সময় তার মুখের দিকে না তাকিয়ে আগে যে বুকের দিকে তাকান- এটি কি আপনার কোন রোগ ? কোন নারীও কি এভাবেই তাকাতে পারবে ?

যে কিশোরীটি উড়না না পরে বাইরে বেরোল সে কার জন্য দুদিন পরেই শার্টের উপরেও একটা স্কার্ফ চড়ায় মশায় ?
বলুন দেখি?

তারই মতো কোন নারী জাতীয় প্রাণী কিংবা রাস্তার ধর্মের ষাঁড়ের জন্য না নিশ্চয়ই ?

বাংলাদেশে আমাদের বয়সী কটা নারী খুঁজে পাওয়া যাবে যিনি কিশোরী বেলায় বাসে ট্রেনে শপিং এর ভীড় ভাট্টায় কনুইয়ের গুঁতো খাননি বুকের ডান কিংবা বাম পাশে? পেছনের অংশে হাত বুলায়নি কোন দেবসম নর!
চিমটি খাবার অভিজ্ঞতা আছে শতকরা কতজনের- এই হিসেব কি কোনদিন করা হয়েছে ?
কৈশোরটা আতঙ্কে আর চোখের জলে ভিজেছে কতজন কিশোরী বালিকার শুধুমাত্র এইকারণে – সেই হিসেবও দরকার।

আপনাদেরই পূর্বপুরুষরা যা করে গেছেন, বংশ পরম্পরায় সেগুলোরই পূণরাবৃত্তি আটকাতে আমাদের উত্তরপ্রজন্মের নারীরা যদি আওয়াজ তোলে, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় তাদের সাথে এই এই হচ্ছে, ল্যাঙ মেরে ঠ্যাঙ ভেঙে দিতে চায় তবে তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে টিটকিরি কপচানো কেন ?

ভেবে দেখুন – কে জানে, এই কারণেই হয়তো আপনার কন্যা বা ভাবি কন্যাটি বেঁচে যাবে ভবিষ্যতে বুকে বা পশ্চাতদেশে কারো অনাকাঙ্খিত ঘিনঘিনে ছোঁয়া থেকে।

প্রতিবাদের ভাষা ভুল হতে পারে কিন্তু প্রতিবাদটাই যখন আপনার হিংস্র সমালোচনার শিকার হয় তখন সন্দেহ জাগেই – কোথাও আপনিও তো তাদেরই মতো সাইলেন্ট “নরদেব” নন ?!

প্রতিবাদকারীনিরা ভুল করতে পারে। তাদের তরিকাও ভুল হতেই পারে! তাদের জীবনযাপন আপনার বহু বছরের জানা দেখা এবং সংস্কারের সীমানা ডিঙিয়ে যেতেই পারে তাই বলে কি তারা গলা তুলে জানান দেবার অধিকার রাখে না আপনার বা আপনার পূর্বসুরীদের সুকীর্তির কথা?

এই গলা তুললেই তারা খারাপ ?

এখন যদি আমাদের পরের প্রজন্ম আপনার উড়নার ফাঁকে তেলাপোকার মতো সুযোগ নেয়া দৃষ্টিতে আমাদের মতো অস্বস্তি বোধ না করে বরং উড়না খুলেই ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় আর তেড়িয়া হয়ে বলে- ‘কত দেখবি দেখ!’

তাদের আর তখন নারীবাদী বলে গাল দিলেই কি আপনার বা আপনাদের ইজ্জত বাঁচে?

বরং দেখতে দেখতেই হয়তো একদিন আপনি বা আপনারা বুঝে যাবেন এটি একই বস্তু যা আপনার মা বোন থেকে শুরু করে পৃথিবীর সকল নারীর আছে। যেটি আপনার চোখকে তৃপ্তি দিতে নয় আপনাকে গুঁতো দেয়ার ভীড়ের সুযোগে চাপ দেয়ার জন্য নয় বরং আপনাকে আমাকে আমাদের সকলকে বাঁচিয়ে রাখতে সৃষ্টকর্তা স্বয়ং দিয়েছেন জীবনসুধা ভরে দিয়ে।

পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতেই নরেরা কাপড়ের উপর দিয়েই ডিসেকশন করবে সাইজ কেমন,শক্ত না নরম। এবং মুখেও বলবে। এসব শুনে যে নারী প্রতিবাদ করলো, যে আরেকজনকে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শেখালো সে হয়ে গেলো ঘৃণিত নারীবাদী? পতিতা?ঘরভাঙানি?

আপনাদের মতামত তবে চুপ থাকা! নারীদেরই ঢেকেঢুকে চলতে হবে কারণ পুরুষ ওইরকমই ?

পুরুষ বদলায়নি বলেই নিজেকে বদলাতে হচ্ছে নারীর। পুরুষ ব্যথা বোঝেনি বলেই চণ্ডালিনী হয়েছে নারী। সহযাত্রী হয়নি বলেই একলা চলে চলেই অমিত সাহস পেয়েছে নারী – একলা চলার এবং বলারও ।

প্রফেসর সায়েবার প্রসূতির চিকিৎসা যেমন বিপ্লব, এসিড সন্ত্রাস বাল্যবিয়ে রোধে নারীদের ভূমিকা যেমন বৃহৎ কাজ, তেমন শারীরিক হেনস্থার শিকারে পরিণত নারীও ধর্ষিত হয়, আত্মহত্যা করে বলে সেটি ঠেকানোর জন্য নারীরা যদি শরীর চেনায়, গলিঘুঁচি দেখায় আর আঙ্গুল তোলে এইজন্য দায়ী পুরুষের দিকে তবে গাত্রদাহ কেন কতিপয়ের ?

প্রতিবাদের ভাষা শিখলো বলেই কি এই ঝাল? 
নাকি অত্যাচারীর এগিয়ে আসা হাতটা ধরে ফেলতে পারবে বা শেখাচ্ছে – এটাই মানা যাচ্ছেনা ? 
অথবা শুধু চেহারাটা দেখিয়ে দিচ্ছে এটুকুই বুঝি সহ্য হচ্ছেনা ?
তাই অক্ষমের গাল দিচ্ছেন গণহারে পতিতা বলে!

এই মানুষের জমিনে নারী যদি পতিতা হয়, তবে- হে নর, তুমিও পতিত !

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.