একজন জীবনবাদী মায়ের গল্প

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল:
১.
আমি হলুদের স্টেজে বসে আছি, হঠাৎ অাম্মু এসে আমার হাতে তাঁর ফোনটি ধরিয়ে দিলেন। আমার এক চাচা শুভকামনা জানাতে ফোনটি দিয়েছিলেন। 
চাচা: অামি তো আসতে পারলাম না, তোর মাকে বলি সে বোঝে না! আসলে সে তো আর আমাদের পরিবারের কেউ না, তাই বুঝবে না। তুই বুঝবি…..
আমি: অামার মা এতো বছরেও যখন ‘কেউ’ হতে পারেনি, সেখানে আমি কীভাবে হবো? ভাগ্যিস আপনি আসেন নাই। 
২.
আজ থেকে প্রায় অনেক বছর আগের কথা। আমাকে স্কুলে ভর্তি করানো হবে, নাম রাখলেন আম্মু। নামের কারণে আলোচনা-সমালোচনা-যুক্তি-তর্ক সব শুনেছি অতি আনন্দ নিয়ে। নামের মাঝে মা-বাবা দুজনই বিদ্যমান। নামের অর্থ দাঁড়ায়- শিরিন ও নজরুলের কন্যা!!  সেই সময় এই নাম রাখা যখন ‘বিনতে’ এর পরে বাবার নাম রাখাটাই জায়েজ!
আমার সারা জীবনে ভাইভাতে, যেকোন ইন্টারভিউতে আর কিছু কমন পরুক কী নাই পরুক, আমার নাম নিয়ে একটা প্রশ্ন অবধারিত!! এবং বোর্ডে আঁতেলের সংখ্যা বেশি থাকা মানেই সেই অবস্থা হবে!! বেশিরভাগ মানুষই এখন পর্যন্ত এই নামটি কেন যেন নিতে পারে না এবং বেশিরভাগই আমার নামের মায়ের অংশটি বাদ দিয়েই ডাকতে পছন্দ করে!!
সেটা বিষয় নয়, বিষয় হলো আমার মায়ের সেই সময়ে নিজের মেয়েকে নিয়ে দেখা একটি স্বপ্ন!! সন্দ্বীপের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা আমার মা অনেক শিক্ষিত ‘নারীবাদী’দের চেয়েও আমার কাছে অনেক বড়, কারণ অনেক নারীবাদীই শুধুই ‘নারীবাদী’ , কিন্তু আমার মা ‘নারীবাদী’ নন, সরাসরি তাঁর বিশ্বাস চর্চায় আনতে বিশ্বাসী।
অনেকের কাছেই হয়তো ঘটনাটি অনেক ছোট, কিন্তু অামার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই নামটিই আমাকে ডেমোনস্ট্রেট করে শিখিয়ে দিয়েছিল যে, সন্তান কেবল বাবার নয়, সে মায়েরও!! মুক্ত চিন্তায় হাতে খড়ি তাই মায়ের কাছেই বটে!!
৩.
আমার মা সন্দ্বীপে জন্মেছিলেন। একটু বড় ক্লাসে ওঠার পরে দেখা গেল যে তার ক্লাসে শুধু তিনিই মেয়ে শিক্ষার্থী। তারপরে আমার নানা ব্যবস্থা করলেন যেন শিক্ষকরা বাসায় এসে তাঁকে পড়িয়ে যান। এভাবেই তিনি ম্যাট্রিক এবং ইন্টারমেডিয়েট পাস করলেন। তারপর ভর্তি হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার নানী খুবই আনন্দিত হলেন এই ভেবে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বোধহয় গান-বাজনার সুবিধা নেই, মেয়ের পড়াশুনা ঠিকমতোই হবে তাহলে। এখানে বলে রাখি, আম্মুর ছিল গানের নেশা। রাত জেগে রেডিওতে গান শুনতেন, গানের কলি লিখতেন অনেক কষ্ট করে। কারণ এক গান তো আর প্রতিবার শোনানো হতো না, যখন হতো তখন একটি একটি করে লাইন লিখতেন, এভাবে নাকি একটি গান লিখতে এক মাস , কখনও দুমাসও লেগে যেতো!!
তো, আমার মা ভর্তির পরেই যথারীতি সঙ্গীতের খোঁজ-খবর নিয়ে সেইখানে চলে যাওয়ার অভিপ্রায়ে বের হয়েই এক্সিডেন্ট করে পা ফ্র্যাকচার করে ফেলেন!! গানের জন্য এমন প্রত্যয়ী মানুষ ভাবাই যায় না!! সেই ভাঙ্গা পা নিয়ে আম্মু বেডে শুয়ে পরীক্ষাও দিয়েছিলেন সেই সময়ে, তাও ইয়ার লস দেননি!! এমনকি ওনার অনেক কাছের মানুষ ছিলেন যারা উনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন, গীতবিতান তাঁর ঘরে ছিল বলে তাঁর বাসায় অাসতে চাইতেন না!! অামার মা কিন্তু আজও রবি বাবুর গান করেন এবং তাঁর গানের ভাণ্ডার অামার চেয়েও বেশি।
৪.
বিয়ের পরেও তিনি চাইলেই কিন্তু স্বামীর সাথে সিভিল সার্জনের ‘স্ত্রী‘ হয়ে আলিশান বাড়ি আর গাড়ি নিয়ে অামোদে থাকতে পারতেন। কিন্তু সেই আমোদের চেয়ে পাণ্ডব বর্জিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করাকে তিনি অধিক সম্মানের বলে বিশ্বাস করতেন, এবং যেই বিশ্বাসের জোরে আজ অন্য আর দশজন মায়ের চেয়ে অামার মাকে আমি আলাদা ভাবার একটি জায়গা বলে মনে করি। আমার অাশেপাশে এখনও এমন অনেক মানুষের সংখ্যাই বেশি যারা ম্যাজিস্টেট স্বামীর ‘বউ’ হয়ে, স্বামীর কল্যাণে অন্যদের ‘ম্যাডাম’ হয়েই বিশাল বাড়িতে থাকতেই বেশি সম্মানের বলে মনে করেন। এমনকি বেশিরভাগই এখনও পুতুল বউ-ই খুঁজতে থাকে বিয়ে করার জন্য। 
৫.
তার সাধ্যের মধ্যে যা যা ছিল আম্মু তার সব অামাকে শিখাতে যেন বদ্ধপরিকর ছিলেন। একটি উদাহরণ দিলেই বুঝবেন- তিনি একদিন মহা উৎসাহে অামাকে কারাতে শেখাতে নিয়ে গেলেন। কারণ তিনি মনে করতেন আমার নাকি আত্মরক্ষার কৌশল শেখা খুবই প্রয়োজন। এটি ছিল তাঁর উপলব্ধি, একজন কন্যার মায়ের উপলব্ধি। এই উপলব্ধির জন্য তাঁকে নারীবাদ পড়তে হয়নি, শুধু জীবনবাদী হতে হয়েছিল কন্যা সন্তানের সর্বোচ্চ সুরক্ষা চিন্তায়!!
কোনদিন তাদের কথাকে মোটেও পাত্তা দেননি যারা হাজার বার বলেছেন যে, মেয়েকে রান্না শেখাও না কেন? আম্মু বলতেন, সবাই রাঁধতে পারে, এটা কঠিন হলে কি পারতো সবাই? অামার মেয়ে যা যা পারে তা কি সবাই চাইলেই পারে? যখন ওর দরকার পড়বে, সে রান্না করে ঠিকই খাবে।
৬.
অনেকেই বলেছেন, একাধিকবার যে আম্মুর এভাবে অামাকে ছেড়ে দিয়ে মানুষ করা ঠিক হয়নি। ডাক্তারের বউ হয়ে থাকলে নাকি আমি আরও অনেক ভালোভাবে মানুষ হতাম!! অামার লেখালেখি নিয়েও অনেকের অনেক কথা, সবই মায়ের দিকে যে আম্মু আমাকে বেশি নাকি ছেড়ে দিয়েছিলেন তাই এমন বেপরোয়া,, বেয়াড়া। ‘মেয়ে’ হয়ে উঠতে শেখাননি তিনি। সবার সে কী চিন্তা…..  এখন অবশ্য আমি জানি সেটা চিন্তা ছিল, নাকি নিজেরা এই লাইফটা না পাওয়ার হতাশা…….. মজার বিষয় হলো, জীবনের এতোগুলো বছর কিন্তু আমাকে সবাই মায়ের নামেই চিনে এসেছে।
৭.
যারা বলেন উইমেন চ্যাপ্টার নাকি ‘নারীবাদ’ শেখায়,  আমি বলি মানুষ তার জীবন থেকেই শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোয়, শুধু এই পোর্টাল মানুষের নি:শ্বাস ফেলার জায়গাটি তৈরি করে দেয় সামনে এগোনোর জন্য, অনুপ্রেরণা জোগায় অন্যকেও সামনে এগিয়ে যেতে!! অামার মায়ের সময় এই সুযোগটি ছিল না তিনি একা লড়াই করেছেন অনেক কিছুর সাথে…… আজ সেই সুযোগ কিন্তু আপনার হাতের কাছেই… তাই সবার জন্য অনুপ্রেরণা হোন… একজন নারী নয়… একজন মানুষ হোন!! বর্বর সমালোচনা নয়, বরং সামনে এগোনোর সঠিক মন্ত্রটি অন্যকে বলে সাহায্য করুন, যদি না পারেন অাপনার মূল্যবান মন্তব্যটি ব্যঙ্গ করায় ব্যবহার করবেন না, ও অন্যদের পথ আটকাবেন না।
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.