ফাহমিদা আক্তার:
ইদানীং মেয়েটা একটা অদ্ভুত কাজ করছে। একটু পরপর কাছে এসে প্রথমে খুব সুন্দর করে হেসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তারপর তার ছোট্ট দুই বাহু দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। কী মায়া ওই চাহনিতে! কী শান্তি ওই বাহুডোরে! ওকি তাহলে আমার মনের অবস্থা আঁচ করতে পারছে? ওকি আমাকে সান্ত্বনা দিতে চাচ্ছে? বাইরে যতোই ভালো আছি দেখাই না কেন, মনের মধ্যে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তা কি ও টের পাচ্ছে?
হাউজওয়াইফ হয়ে থাকতে আমি কখনই চাইনি, আমি সব সময় চাইতাম আমাকে যেন আমার মায়ের লাইফ বেছে নিতে না হয়। প্রেগনেন্ট থাকাকালীন অবর্ণনীয় কষ্টের মাঝেও চাকরি ছাড়ার কথা চিন্তা করিনি। যতরকমভাবে ম্যানেজ করা সম্ভব করেছিলাম, অফিস থেকে দীর্ঘ ছুটি নিয়েছিলাম (ক্যারিয়ারের ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে যাবো জেনেও), লোন নিয়ে গাড়ি কিনেছিলাম (ট্রাভেলে নিষেধাজ্ঞা থাকায়), বোনকে নিজের কাছে এনে রেখেছিলাম দেখভাল এর জন্য। কিন্তু শেষমেষ কি পারলাম আমি, আমার আজন্ম লালিত স্বপ্নকে ধরে রাখতে! স্বাবলম্বী, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়ে থাকতে!
পারলাম না, মেয়ের কাছে হার মানতে হলো আমাকে। যখন বুঝলাম ওর আমাকে দরকার, তখন নিজের ইচ্ছাকেই মাটি চাপা দিতে হলো। যখন দেখলাম আমার সদা হাসিখুশি, চঞ্চল মেয়েটা আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে। একাকীত্ব তাকে গ্রাস করছে। আমার অনুপস্থিতি তাকে কষ্ট দিচ্ছে, ভয় সারাক্ষণ তাকে কুঁকড়ে রাখছে, এমনকি রাতে রাতে বিনা কারণে তার জ্বর আসা শুরু হলো। তখন আমি চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে আর দ্বিধা করলাম না। হ্যাঁ এটা আমার সিদ্ধান্ত, আত্মত্যাগ নয়।
নুয়াইরাহ, আমার বুলবুল পাখি, তুমি জেনে রেখো, আমি তোমার জন্য কোন কিছু ত্যাগ করিনি, জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি মাত্র।
আমি জানি সামনে অনেক কঠিন সময় পার করতে হবে আমাকে, অনেক হিসাবকষে চলতে হবে, চাইলেই অনেক কিছু করতে পারবো না, অন্যের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হবে, নিজের উপার্জনের টাকা খরচ করার আনন্দ আর থাকবে না, আমি কিছুটা হলেও সংসারে কন্ট্রিবিউট করছি, এই গর্বও আর থাকবে না।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নেয়া একজন ব্যর্থ মায়ে পরিণত হলাম যে কিনা সুপারওম্যান হয়ে সব কিছু সামলাতে পারলাম না। আমি পারলাম না তোমাকে দিবাযত্ন কেন্দ্রে কিংবা গৃহকর্মির কাছে কিংবা তোমার নানুর বা খালার কাছে রেখে আমার কর্মজীবন চালিয়ে নিতে।
আমি স্বীকার করছি, হয়তো আমার খারাপ লাগবে নিজের সমসাময়িক অন্যদের সাফল্য দেখে। কিন্তু মা, ভবিষ্যতে তোমার কি খারাপ লাগবে তোমার এই ব্যর্থ পরিচয়হীন মায়ের পরিচয় দিতে, তোমার সফল বাবার পাশে এই ব্যর্থ মাকে দাঁড় করাতে?
বি. দ্র. এসবই আমার বিক্ষিপ্ত মনের এলোমেলো ভাবনা, হাউজওয়াইফ বা কর্মজীবী মায়েদের কষ্ট দেয়া বা ছোট করা আমার উদ্দেশ্য বা বাসনা কোনটাই নয়। আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর সকল মায়ের কাছেই তার সন্তান সব কিছুর ঊর্ধ্বে, মূল্যবান।