মুনতাহা বৃত্তা সাচী:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে কতটা সফল তা বলা মুশকিল। সফলতার সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেক রকম। হুট করে তার বিয়ের আয়োজন নিছক বিয়ে ছিল না। তার পেছনে গল্পটা খুব বেদনাদায়ক।
সদ্য বিলেত থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটবেলার বন্ধু নতুন বৌঠান কাদম্বরীর সাথে সখ্যতা আরো বাড়িয়ে তোলেন। এটা ঠাকুরবাড়ির চোখে লাগে। পুনরায় রবীন্দ্রনাথকে বিলেত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এই বিচ্ছেদ না মানতে পেরে কাদম্বরী সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেন এবং সেবার তিনি বেঁচে যান। তার শারীরিক উন্নতি ও মানসিক প্রশান্তির জন্য হাওয়া বদলে চন্দননগরে বেড়াতে নিয়ে যান স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। ততদিনে রবি জাহাজ যাত্রা করেন বিলেতের উদ্দেশ্যে। হুট করে মাঝপথে মাদ্রাজে নেমে সোজা চন্দন নগরের বাড়িতে ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যতদিন কাদম্বরী সেখানে ছিলেন ততদিন তিনিও থেকে যান। নতুন বৌঠান কাদম্বরীর সাথে নিবিড় নির্জনে মর্মস্পর্শী প্রেম কাহিনী প্রগাঢ় হয় ওই বাড়িটিতে। চন্দননগরের মোরান সাহেবের বাড়ি থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত ভারতী পত্রিকায় একটি লেখা ছাপতে দেন। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখ এড়াতে পারেনি সেই কাল লেখাটি। পরিবারের অন্য সদস্যরা বুঝতে পারেন এই লেখাটি নতুন বৌঠান কাদম্বরীর উদ্দেশ্যে।
পিতার আদেশ হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রবির বিয়ের পাত্রী খোঁজা হোক। সে দায়িত্বের ভার কাদম্বরীকেই দেওয়া হলো। সেই খুঁজে আনবে রবির আদর্শ পাত্রী। ভাবতে অবাক লাগে, এতো বিজ্ঞ লোকেরাও সমস্যা সমাধান এর জন্য বিয়ের পথ বেছে নেন। সমস্যা সমাধানের জন্য যে বিবাহ কতটা শান্তিময় ও শুভ কে জানে!
অভিযান চলতে থাকলো, রবির যোগ্য পাত্রীর জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। তবুও বিয়ের জন্য রাজি হলেন। প্রাণপ্রিয় রবির এমন মিথ্যাচার না মেনে নেওয়াটা কি খুব বেয়াদবি! নব্য বাংলা সাহিত্যের স্রষ্টা, যৌবনে বিপ্লবী ছিল না… এ যে মেনে নেওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়ির সমস্ত জিনিস ওলট-পালট করলেন, ভাঙলেন।
তিনি বড় বাড়ির ছেলে, এসব তৈজসপত্র নিছক ভাঙচুর মাত্র। তিনি তো আদতে পুরুষ, চাইলে শ খানেক মন ভাঙতে পারেন। পূজোর ঘট উল্টে দিলেন। এক আত্মীয়া এসে বাঁধা দেয়ায় বললেন, “আজ থেকে তো আমার জীবনটাই ওলটপালট হয়ে গেল”।
প্রাণপ্রিয় রবি, এই দোষ কার? পরাধীনতার এই গ্লানি আপনারই আত্মনিয়োগ। আট-দশটা ছেলের মতো আপনিও যে বিয়ে নিয়ে তামাশা করলেন, এটা স্পষ্ট। ধরলাম, আপনি অমন কিছু ভেবে বলেননি হয়তো-নতুন বৌঠান আর আপনার বিচ্ছেদ এবং পরিবার সমাজের বিরুদ্ধে যেতে না পারার অপার শূন্যতার কথা বলেছেন। তাতে কী? আপনি তো প্রেম করলেন নিজের ইচ্ছায়, বিয়ে করছেন পরিবারের ইচ্ছায়।
এই মানুষটি সারাটা জীবন প্রেম নিয়ে কতই না লিখে গেলেন। যাই হোক কবির প্রেম নিয়ে আরেকদিন লেখা যাবে। ভদ্রলোকের বান্ধবী ভাগ্য বড্ড ঈর্ষণীয়।
যশোহর জেলার অজ:পাড়া গাঁয়ের মৃণালিনী নামে নয় বছরের একটি মেয়ে রবির বউ হয়ে এলো।কাদম্বরীর মত এই বাচ্চা মেয়েটি ঠাকুর পরিবারের এক কর্মচারীর মেয়ে। একটা প্রবাদ আছে-“ছেলে বিয়ে করালে সব সময় ছোট পরিবারে করাতে হয়”। কী জানি দেবেন্দ্রনাথ এই চিন্তা মাথায় রাখতেন কি না! যদিও এটা সত্যি ঠাকুর পরিবার ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন বলে সেই সময় সম্ভ্রান্ত হিন্দু মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল।
নয় বছরের মেয়েটিকে স্বামী, সংসার, ঠাকুরানগিরি স্বামীকে মুগ্ধ করে রাখার সমস্ত কৌশল শিখতে হবে। আদর্শ বউ হবার জন্য তাকে বড় বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে পাঠানো হলো। ছলা-কলা শিখে আদর্শ বউ হবার প্রস্তুতি চলতে থাকলো। সুকৌশলে স্বামীকে একান্ত নিজের করে রাখার বৃথা চেষ্টা। আদর্শ বউ হতে চাওয়া মানে কেবলই বিসর্জন এবং নিজের ব্যক্তিত্বের সাথে অসহিষ্ণুতা করা। আদর্শ পুরুষ না জন্মালে আদর্শ বউ কখনোই হওয়া যাবে না।
ট্রেনিং এ কাজ হয়নি, হলফ করে বলা যায়। যদি হতো, তবে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এবং ইন্দিরা দেবীর সাথে রবির বিয়ের পর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কী করে হয়? খাঁটি কথায় যাকে আমরা ‘পরকীয়া’ বলতে পারি।
বিয়ের পর প্রেম হতেই পারে। মানুষের মন নদীর স্রোতের মতো, নিত্য নতুন শাখা-প্রশাখায় বয়ে চলাই তার ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার তার এক বান্ধবীকে বলেছিলেন, “এই জীবনে আমি কাউকে ভালোবাসিনি, স্ত্রীকে নয় ,কন্যাকে নয়, পুত্র কেউ নয়”, কত ভালো অভিনেতা তিনি। আসল ছলা-কলা সুকৌশলে তিনি শিখে ছিলেন, ভালোটি না বেসে, কী করে এক ঘরে কাটানো যায়।
ওকাম্পো এবং ইন্দিরা দেবীকে লেখা সে সমস্ত অসাধারণ চিঠিতে কী ছিল? ওটা ভালোবাসা নয়? ছলনা? তার মানে সারাটা জীবন কত ছলনা করতে হয়েছে আপনাকে। প্রেমিক শব্দটার পরিপূরক শব্দ কি ভণ্ড? ভালোবাসা অপাত্রে দান হয়। আজো বহু মেয়ে চরমভাবে আপনাকে ভালোবাসে। আপনার গান মুগ্ধতার সীমা ছাড়িয়ে চোখের জলে ভেজায়। আমিও তাদের মধ্যে একজন। আপনার এমন রূপ মানতে ভীষণ কষ্ট হয়। পরক্ষণে মনে পড়ে যায়, বিশ্বকবি যে একজন পুরুষ ছিলেন!
আদর্শ স্বামী হবার কোনো বিদ্যা কেন আপনাকে দেওয়া হলো না! স্বামী হলে স্ত্রীকে ধরে রাখার কোনো ট্রেনিং নিতে হয় না বুঝি? অত্যাচার মানসিক হোক, কিংবা শারীরিক, স্ত্রী থেকে যেতে যায়। মেয়েদের জন্য সংসার সাংঘাতিক লালসাময়। “হেথা হতে যাও, পুরাতন! হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে”
মৃণালিনী দেবী বেশ কিছুদিন বাবার বাড়িতে কাটিয়ে ফিরছেন কলকাতায়। তাই আগে থেকে রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন। আগামীকাল থেকে তোমায় আর এভাবে লিখতে পারবো না। আগামীকাল থেকে আমি পিতা, আমি স্বামী।
হাসি পায় আপনার সংযম দেখে। কতই না অভিনয় জানতেন। শান্তিনিকেতন গড়ার জন্য কবির কাছে বিভিন্ন জায়গা থেকে সাহায্য আসছে। তাতেও কুলাচ্ছে না। স্বামীর স্বপ্নের জন্য কবিপত্নী তার সমস্ত গয়না খুলে দেন একে একে। সে সময় কী ভয়ঙ্কর দিন তাদের কাটাতে হয়। দারিদ্র্য এবং পুষ্টিহীনতায় মৃণালিনী দেবী ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হোন। উন্নত চিকিৎসার জন্য ফিরে আসা হয় কলকাতায়। তার পরপরই এক রাতে কবি পত্নীর বিয়োগ ঘটে। কবি সারারাত তার পাশে জেগে কাটান এবং নিজ হাতে বাতাস করেন।
এই রাতের ঘটনা স্বামী রবিকে প্রেমময় করে দেয়। তবে আমি বলবো না স্ত্রীর প্রতি তার প্রেম খুব একটা ছিল না। সেই একটা রাতে তিনি দায়িত্বশীল স্বামী ছিলেন মাত্র। চূড়ান্তভাবে হয়তো মৃণালিনীর সমস্ত বিসর্জন মনে পড়ছিল। কেন ক্ষয় রোগ কবির হয়নি! খেয়ে না খেয়ে হয়তো স্বামীর মুখে সে খাবার তুলে দিয়েছেন মৃণালিনী। অথচ স্বামী রবীন্দ্রনাথ সে খবর রাখেননি। জীর্ণ মৃণালিনীর দিকে তাকাবার সময় কই! আমার মনে হয় কবির বিশাল সাহিত্যের মূলমন্ত্র ছিলেন একজন মৃণালিনী দেবী। সাহিত্যের সুর আহরণের নিরাপত্তা তিনিই দিয়েছেন। তাঁর বিশালত্বের কাছে কবির ব্যাপ্তি ঋণী থাকবে….