শেখ তাসলিমা মুন:
নতুন বোতলে পুরনো মদ যতই পুরান হোক না কেন তাতে মদের স্বাদ একই থাকে। বোতল স্বাদ বদলাতে পারে না। আমরা বদলাচ্ছি ততটুকুনই, যতটুকুন আমাদের ‘সুবিধাবোধ’ আমাদের অ্যালাও করছে। অর্থাৎ আমরা আমাদের সুবিধার বিষয়গুলো থেকে বেরিয়ে এসে কিছু সৃষ্টি করতে পারছি না। নতুন ভাবনায় প্রবেশ করতে পারছি না। এ প্রশ্নে নারী বা পুরুষ উভয়েই সমান। নারী বা পুরুষের ভেতরে এ দিকটায় বেশ মিল দেখা যায়। উভয়ই ‘সুবিধাবাদের’ বলি।

‘শহুরে নারীবাদী টাউট’ বিষয়ে আসা যাক। আসলে এ বিষয়ে ‘টাউট’ আমিও। আমার জন্ম মফস্বলে এবং ১৮ বছর সেখানে বেড়ে ওঠা হলেও নারী সাহিত্য পড়েছি ‘এলিট একাডেমিক ডক্ট্রিন’ হিসেবেই নয়, মনের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনা এবং কৌতূহল থেকে। অস্বীকার করবো না এ বিষয়ে লেখাপড়াই আমার মূল ‘টাউট’গিরির শুরু।
‘প্রগতিশীল’ পুরুষেরা নারীর সীমাহীন পরিশ্রমের সাথে তাঁর অধিকার অর্জনকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন। তাঁদের অধিকার অর্জনের পাশে আছেন বলে সৌহার্দ্য প্রকাশ করছেন এবং তার বিপরীতে ‘নারীবাদ’ এবং ‘নারীবাদী’দের ‘টাউট’ বলছেন। একটি সহজ বিষয় তাঁরা একবারও ভেবে দেখেননি, যে নারীরা বুকে হেঁটে, ছাল চামড়া তুলে ফেলে, এনজিও কনসেপ্টে সামান্য এগুচ্ছে, তাঁদের পথচলা যুগপৎ দুরূহ করছে কোন কনসেপ্ট? কোন মাইন্ডসেট? তাঁদের পায়ে কয়েক মনের লোহা লক্কড় বেঁধে দিয়ে দৌড়মাঠে ছেড়ে দিয়ে তাঁদের বলা হচ্ছে, বাহ! কী দারুণ দৌড়ুনোর প্রচেষ্টা তোমাদের! কী সীমাহীন ক্ষমতা তোমাদের! তোমাদের এ প্রচেষ্টা ক্ষমতাকে আমাদের কুর্নিশ!
আর যারা বলছে, ‘’তোমার পায়ের লোহা লক্কড় খুলে জুব্বা জাব্বা খুলে আকাশের নীচে দাঁড়াও! এ আকাশ তোমার! এ বাতাস তোমার! এ আকাশের নিচে সব ‘পোশাক’ খুলে একবার দাঁড়িয়ে অনুভব করে দেখো তোমাকে! এ বাতাসের প্রতিটি কণা কারো দান নয়, তোমার জন্মগত! এ শ্বাসে তোমার অধিকার! যে মাঠ তোমার পায়ের নিচে, সে মাঠ তোমার! সেখানে তোমার প্রতিযোগিতা করার দরকার নেই। পিঠে পিঠ চাপড়ানোর জন্য কোন ভাড়াটে হাত দরকার নেই। তোমার বুকে হেঁটে হাঁটার দরকার নেই। তুমি যাও তোমার নিজের গতিতে। যে গতি তোমার নিজের এবং আপন তাগিদ অনুযায়ি’’ –তারাই হলো হলো ‘টাউট’।
একটি প্রসঙ্গ মনে পড়ছে। বেগম রোকেয়াকে মুসলমান পুরুষ গ্রহণ করেনি শত বছর। মজার বিষয় লক্ষ্য করুন, বাঙালি মুসলমান পুরুষ এখন আধুনিক নারীর বিরুদ্ধে ‘মডেল’ হিসেবে বেগম রোকেয়াকে সুবিধাজনকভাবে নিজেদের সুবিধায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। বলছে, ‘তোমরা বেগম রোকেয়ার আদর্শ গ্রহণ করো! তিনি এখনও কন্টেম্পরারি।‘ আমাদের ‘প্রগতিশীল’ পুরুষের ‘রোকেয়া প্রীতি’র কারণ আমাদের না বোঝার কারণ নেই। বেগম রোকেয়া ‘শালীন’ মুসলিম পোশাকে যে ছবি আমাদের দিয়ে গেছেন সে ছবি আজকের নারীর জিন্স টপসের থেকে নিরাপদ টেঁকসই। যে বেগম রোকেয়া তাঁর সময়ে ছিল বিভীষিকা এখনকার পুরুষের জন্য সে নারী আদর্শ। এই অন্ত:পুরবাসিনী নারীবাদী অনেক বেশি নিরাপদ তাঁদের কাছে।
‘নারীবাদী’রা ‘বিচ’ ‘টাউট’ কিন্তু নারী সমাজের নর্ম রেগুলেশন টার্ম কন্ডিশন মেনে পেরেক উঠা স্যান্ডেল পরে কর্মক্ষেত্রে যুদ্ধ করলে আদর্শ। পুরুষ যেভাবে নারীর স্বাধীনতা ছটাক দরে মেপে দেবে, স্কেচ করে দেবে, ডিজাইন করে দেবে গজ ফিতে মেপে সেটাতে আমাদের সকলকে সুখী থাকতে হবে। একবার এক বাঙালি ছেলে আমাকে বলেছিল, ‘আমাদের মায়েরা সুখী’। ‘তাঁরা তাঁদের সংসার ছেলে মেয়ে স্বামী নিয়ে সুখী! তাদের সুখ কেন আপনারা নষ্ট করবেন?’ আমি বলেছিলাম, আপনার মা কী চায় আপনি কোনদিন জানতে চেয়েছেন?
-অবশ্যই। আমার মা তাঁর ছেলেমেয়ের মুখের হাসিতেই হাসেন। তাঁদের কান্নায় কাঁদেন। তাঁকে অন্য কোন জীবন দিলেও তিনি নেবেন না। আমি বললাম, আপনি একটি জীবনের আলখেল্লা তৈরি করে দিয়ে সেখানে আপনার মাকে ঢুকিয়ে বলছেন, তিনি সে জীবনের বাইরে কোন জীবন চান না! এবং আপনার মায়ের এ ‘রোলে’ সবচাইতে আশ্বস্ত হলেন আপনি! আপনি নিশ্চিন্ত সুবিধাভোগী। আপনি তাঁর অন্য রূপ ভাবতে রাজী নন। এটা আপনার পক্ষে যাওয়া একটি ‘রোল’!
খোদা না খাস্তা একবার ভাবুনতো, বিকেলে আপনার মা বললেন, ‘রাতের রান্নাটা তোমরা দেখে নিও, আজ আমি আমার এক পুরনো পুরুষ বন্ধুর সাথে একটি বারে বসবো। এক গ্লাস ওয়াইনের সাথে রাতের খাবারটা আমি আজ তাঁর সাথে সেরে নেব!’ তুমি তোমার মাকে কী বলবে? তোমার আকাশ ভেঙে পড়বে মাথায়। কিন্তু এ কাজটি তুমি গতরাতে নিজেই করেছিলে। কিন্তু তোমার ওল্ড মায়ের এমন একটি রূপ কল্পনা করতেও তুমি ভিমড়ি খেয়ে পড়ছো। তখন তুমি নানান নর্ম মূল্যবোধ আদর্শ নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যাবে। মায়ের মাতৃত্বের চিরচায়িত বাঙালি রূপ বা এখন মুসলিম মূল্যবোধও তুলে ধরবে। কিন্তু হাউ এবাউট ইয়ুর মম? তোমার বক্তব্য এসব আমাদের কালচারের সাথে যায় না, আর তিনিও এসব অপসংস্কৃতি চান না। খুবই আনন্দের খবর। কিন্তু যদি চান? সে রুম তাঁর আছে কিনা?
আমাদের চলতে হবে মেপে দেওয়া পথে, কেটে দেওয়া খালে। পড়তে হবে সেলাই করে দেওয়া পোশাক। আমাদের পায়ে বেঁধে দেওয়া হবে ঘুঙুর। সে ঘুঙুরের শব্দ যতক্ষন শোনা যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিকঠাক। ঘুঙুরের শব্দে তোমরা মাপছো সে কতদূর গেল। যখন আর শব্দ শোনা যাবেনা, তখন তুমি কন্ট্রোল হারালে। তখন তুমি উদ্বিগ্ন। তোমার ঘুড়ির সুতো কেটে গেছে। তুমি এখন তোমার ‘রোল’ হারিয়েছো। তুমি ডেস্পারেট। তুমি বলবে ঘুঙুরের শব্দ শোনা যাওয়া পর্যন্ত আমার চলা তোমার পছন্দ। আর আমি যে মেয়েকে নিজের পথ দেখানোর প্রশিক্ষন দিতে চাইছি। বলছি পায়ের ঘুঙুর ফেলে দিয়ে হেঁটে যাও গৌরবে, আত্মবিশ্বাসে – আমি হচ্ছি ‘টাউট’ বিচ!
প্রবাসে একটা বিষয় দেখা যায়, মাইগ্রেটেড করা নারী পুরুষের ভেতর বিশেষ করে যারা প্রাচ্য থেকে এসেছে, তাঁদের ভেতর নারীরা যেভাবে এ সমাজের সাথে এডজাস্ট করে নেয় পুরুষ পিছিয়ে থাকে আর তাঁর মুল্য দিতে হয় এগিয়ে যাওয়া নারীকে।আমাদের পুরুষেরা এ উন্নত সোসাইটিতে ইন্সিকিওরড হয়ে পড়ে। একাকী হয়ে পড়ে। আইসঅলেটেড অনুভবে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। এর ঠিক পরবর্তী ধাপে তাঁরা কমপ্লেইনিং এবং এগ্রেসিভ হয়ে ওঠে। তাঁরা নিজেরা অসুখী হয়ে ওঠে। নারী ও কন্যা সন্তানের জীবন দুঃসহ করে তোলে। যা ভায়োলেন্স থেকে শুরু করে ডিভোর্স অনেক ক্ষেত্রে খুন পর্যন্ত গড়ায়। অথচ তাঁর নিজের দেশে সে একজন ‘মুটাসুটা’ সুখী স্বামী হিসেবেই জীবন যাপন করছিল। এখানে এই উন্নত জীবনে তাঁর অসুখের প্রথম কারণ সে তাঁর ‘রোল’ হারায়। এতোদিন যে ‘রোল’ তাঁর ছিল, সে ‘রোল’ সে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে যায়। যে ‘রোল’ তাঁর সর্বস্ব। তাঁর একজিস্টেন্স। এ সোসাইটিতে খাপ খাওয়াতে তাঁর যে সোশ্যাল কমপিটেন্স দরকার সেখানে সে নিজেকে অশিক্ষিত অনুভব করে।
কিন্তু পাশ্চাত্যের পুরুষেরা যে দিনের ভেতর ছয়বার বাচ্চার ডায়পার চেঞ্জ করে, জামা কাপড় ধুয়ে, ডিশ ক্লিন করে, নিজের শার্ট নিজে ইস্ত্রি করে অফিস গিয়েও দিব্যি স্ত্রী বা সঙ্গীদের ভালবাসে তার মাজেজাটা কী? তাঁদের জীবনের এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, যা তাঁদের দিয়েছে আরেক অর্থপূর্ণ ‘রোল’ যার কাছে তাঁদের ‘বিয়িং’ বা ‘একজিস্টেন্স’ হুমকির মুখে নয়। সে তাঁর সঙ্গিনীর কাছে আসে হৃদয়ের আকর্ষণে। সার্ভিসের জন্য নয়।
যতদিন আমাদের দেশের পুরুষ এ রোলটি খুঁজে পাবে না। বাঁচার এক আরেক সুখময় কারণের সন্ধান পাবে না ততদিন পর্যন্ত তাঁদের এ দুর্দশা ঘুচবে না। তাঁদের এ দুর্দশার ভেতর জীবন কাটাতে হবে। তাঁরা নিজেদের দুর্দশায় নিজেদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। অন্যের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। সমাজকে অসুস্থ করে রাখবে। পশ্চাদপদ করে রাখবে। সমাজের হৃৎপিণ্ডে ক্যান্সার রোপণ করে রাখবে। ভবিষ্যৎ জেনারেশনকে অথর্ব করে রাখবে।
এবার আশা যাক, ‘পরকীয়া’ নামক ভয়ানক ‘নিষিদ্ধ’ একটি বিষয়ে। খেয়াল করুন, ‘পরকীয়া’ শব্দটিতে কেবল পুরুষ নয় নারী আঁতকে উঠছে বেশি। প্রতিটি নারী ‘পরকীয়া’ ঘটনাটিকে খুব ‘পার্সোনালি’ নিয়ে ডিফেন্সিভ হয়ে উঠছে। খুব ‘নারীবাদী’ নারিটিও এ বিষয়ে ‘নর্ম’ ‘কমিটমেন্ট’ ‘অনৈতিকতা’ ইত্যাদি শব্দে উতলা হয়ে উঠছে।
ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? সেইতো পুরনো নিয়মের পৌরহিত্য করা? ‘বিবাহ’ কে সৃষ্টি করেছে? তুমি? এ প্রশ্নটার উত্তর খোঁজো আগে! ফাঁকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। একটি সনাতন প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের দাসত্ব যদি মানো, তাহলে ‘পুরুষতন্ত্র’ মানবে না কেন? ‘বিবাহ’ও ‘পুরুষতন্ত্রের’ই অবদান। তোমাকে কুক্ষিগত করা। তোমার মালিকানা পাওয়া। তোমার জরায়ুতে মালিকানা কায়েম করা। তোমার জরায়ুতে সেইফ বীর্যপাতের ফসল বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার প্রচেষ্টা। যদি এ প্রতিষ্ঠানকে মানতে তোমার আত্মসম্মানে না বাঁধে তাহলে পুরুষতন্ত্রকে মানতে কেন তোমার অসুবিধা হচ্ছে?
সম্পর্ক একটি স্বাধীন বিষয়। প্রেম এবং সেক্সুয়ালিটি কখনও কারো কাছে বন্ধক রাখা যায় না। ইনভেস্ট করা যায় না। এটি তাঁর নিজস্ব। তোমার জরায়ুর স্বাধীনতা তোমার। পুরুষের জেনিটালকে তুমিও ওউন করো না। হিসেব এতোটাই পরিষ্কার। তুমি সেক্সুয়ালি জেগে উঠবে কখন, কার প্রতি সেটি কোর্টে নিস্পত্তি হবার বিষয় নয়। এটি তোমার শরীর এবং মনের কিছু মিশ্রণ। জীবনে যত সৎ হবে, আপন অনুভবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে, ততো তুমি একটি ভিন্ন ধরনের সততাকে চিনবে। শিখবে। ম্যানমেড ‘সততা’র কাছে নির্ভর করবে না। নিজেকে এবং অন্যকে প্রতারিত করবে না। বিবাহ মানুষকে সে অসততা শেখায়। ৯৯% বিবাহ সে কারণে করাপ্টেড এবং ব্যর্থ। তাঁরা হয় ভণ্ড জীবন যাপন করে। না হয় স্বেচ্ছাচার হয়ে ওঠে। তৃতীয় ভূমিকা প্রবঞ্চনার ভেতর বাস করে।
আর এটি , জাগতিক এবং মানসিক ‘সুবিধা’ভোগিতার উপর দাঁড়িয়ে। অনেক স্বামী ‘মানবিক’। তাঁরা স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা অনুভব করে না, কিন্তু ‘দায়িত্ব’ অনুভব করে। তাঁরা আমাদের সমাজে ‘ভালো স্বামী’! ‘আহা মানুষটা কী ভালো! কী ভালো!’ হ্যাঁ অবশ্যই ভালো। কিন্তু আমি বলছি, আমার স্বামী যদি আমার উপর ‘দায়িত্ব’ বোধে আমাকে তাঁর জীবনে জড়িয়ে রাখে, বিশ্বাস করো, এর থেকে অপমানিত আমি আর কিছুতেই অনুভব করবো না। আমি ‘দয়া’ ‘মায়া’ ‘দায়িত্ব’বোধের অবজেক্ট নই। আমি একজন মেধাবী, মননশীল এবং দায়িত্বশীল মানুষ। আমি তোমাকে কোনো বাঁধনে না বেঁধে যখন বুঝবো তুমি আমাকে চাও, তখনই কেবল আমি তোমার সাথে সম্পর্ক স্বীকার করবো, আমিও তোমাকে চাইবো যদি একই অনুভব আমিও তোমার প্রতি অনুভব করি।
কোন নর্মে কোন মূল্যবোধে কোন ঔচিত্যবোধে তুমি সম্পর্ক পবিত্র করতে চাও? সেইতো সেই পুরনো মদ। তুমি কেবল বোতল বদলাতে চাইছো!
স্টকহোম
৬ আগস্ট ২০১৭
শেয়ার করুন: