নারীর মূল্য নির্ধারক নারী নিজেই

শিল্পী জলি:

২০০৩-৪ এর ঘটনা। তখনও ফেসবুক চালু হয়নি। লোকজন ইয়াহু ম্যাসেঞ্জারের চ্যাটরুমে ঢুকে গ্রুপ চ্যাট করে। কম্পিউটার বেজড এই সুবিধা তখন শুধুমাত্র ঢাকায় পৌঁছেছে, তাও কিছু সংখ্যক স্বচ্ছল পরিবার এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। সুদূর আমেরিকা থেকে শুধু বাংলা কথা শুনবো বলে আমিও একদিন চুপচাপ চ্যাট রুমে ঢুকে স্পিকার অন করি–উদ্দেশ্য, ওদের কথা স্পিকারে বাজবে, আর আমি সেই কথা শুনতে শুনতে ঘরের এটা-ওটা করবো, মাতৃভাষা বাংলা শোনা হবে, লোনলি ফিল হবে না। কিনতু ঢোকার পর অভিজ্ঞতা হলো একেবারেই ভিন্ন। 

মূলত ছেলেরাই থাকতো তখন ওসব গ্রুপ চ্যাট রুমগুলোতে। মোট মহলে একটি গ্রুপে পঞ্চাশ জনের মতো সদস্য হবে। তেমনই একটি দলে একটি ছেলে বেশ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছিল ‘করেছি-খেয়েছি’, সেইসাথে অন্যান্য ভদ্রতাও। শুনে মনে মনে যেই ভাবছি, আহা কত মধুর কথা, তখনই আরেকজন সদস্য বলে ওঠে, ‘ঐ দেখ আঁতেল শালারে, শালা… ।’ সেই কথা শেষ হতে না হতেই সবাই যোগ দেয় তার সাথে ভদ্র ছেলেটিকে হেনস্তা করতে। শুরু হয় নানা রকম গালির বর্ষণ। সে যে কত রকমের গালি নিজের কানে না শুনলে চিন্তা করাও সম্ভব নয়– মানুষ এমন করতে পারে, এভাবে চিন্তা করে, অকারণ এমন করে একজনকে আঘাত করতে পারে যেন বিশ্বাস করা যায় না!

বলার যোগ্য নয় সেসব শব্দমালা, উক্তি, পংক্তি, কাব্য–এক কথায় ভয়াবহ, এখনও মনে পড়লে শিউড়ে উঠি। একজন বলছিল, শালা শুদ্ধ কথা বলে ওর মাকে…। আরেকজন বলছিল, আরে না না ওর মাকে নয়, ওর বোনকে, উট্ দিয়ে রেপ করাবো, আর উট লাফিয়ে লাফিয়ে রেপ করবে, শুদ্ধ কথা ** দিয়ে বের হয়ে যাবে। ওরা রেপ ওয়ার্ড ব্যবহার করেনি, ধর্ষণও নয়, করেছিল সেক্সের খাঁটি বাংলা শব্দ– নানাভাবে, নানা বিশেষণে। তাদের গালি, ভাষার ধরন এবং বিশেষণগুলো শুনে আমার মাথা ঘুরছিল। একটুও মনে হয়নি কোনো সভ্যতা জানে তারা।

বলতে গেলে গ্রুপের সবাই-ই বিষয়গুলো উপভোগ করছিল। সবারই মানসিকতা প্রায় কাছাকাছি। পার্থক্য শুধু কেউ একটু বেশি একটিভ, কেউ একটু কম। ভাবছিলাম, এদেরও তো একটি মেয়ে বিয়ে করবে–তাহলে? কী করে ঘর করবে এই মানসিকতাগুলোর সাথে? সেই থেকে চ্যাটিং ভীতি শুরু হয়। পঞ্চাশ জনের কেউই একটিও ন্যায্য কথা বলেনি সেদিন! আমি ঢোকার দুই-তিন মিনিটেই ঐ অবস্হা দেখে আর জানানই দেইনি ছদ্মনামে কিছু সময়ের জন্যে একটি মেয়েও ঢুকেছিল ঐ চ্যাটরুমে, অতঃপর বাকরুদ্ধ হয়ে যাই তাদের কথা শুনে।

মনে পড়ে, বুয়েটের হলেও বিদ্যুৎ চলে গেলে হলে হলে একে অন্যকে উদ্দেশ্য করে অকারণে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতো শুধুমাত্র ফান করার নামে। প্রশ্ন এখানেই– 

ফানের নামে দলবদ্ধভাবে বর্বরতার এই চর্চা সমাজকে কোথায় নিয়ে যায়? 
কী ক্ষতি করতে পারে?
এ কঠোরতা চর্চায় মানুষের হৃদয় খোয়া যায়, মানুষ মানুষকে কারণে বা অকারণে নির্মমভাবে আঘাত করতে শেখে। তাও দলবদ্ধভাবে। দিনে দিনে মানুষের মাঝে তখন আর কোমলতা এবং মানবিকতা থাকে না।

সম্প্রতি বগুড়ার তুফান সরকার একটি মেয়েকে ভর্তির নামে লোক দিয়ে বাসায় নিয়ে পরিকল্পিতভাবে রেপ করলো। অতঃপর তার স্ত্রী আশা, জ্যেঠাস রুমকি এবং শাশুড়ি রুমা মেয়েটির মা এবং তাকে ডাকিয়ে এনে মারধোরসহ মাথা ন্যাড়া করে দেয়। এই অপকর্মে মোট নামধারী আসামীর সংখ্যা দশজন এবং আরও কিছু আসামী বেনামী। এই অমানবিক বর্বরতার ঘটনায় ঐ দশজনের একজনের মধ্যেও একবারের জন্যেও বিন্দু পরিমাণ মানবিকতা জেগে ওঠেনি। যদিও তারা সবাই জানে মেয়েটি যথার্থই ধর্ষণের শিকার এবং তুফান কোন প্রকৃতির মানুষ।

তুফানের যে গুণকীর্তনের হিসাব পাওয়া যায় তাতে বলতে বাধা নেই যে তুফানের এই জাতীয় অপকীর্তি এটাই প্রথম হবার কথা নয়। তথাপি ধর্ষণের শিকার মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাইবার পরিবর্তে কিছু পুরুষ এবং উক্ত নারীরা মেয়েটিকেই মা-সহ লাঞ্ছিত করে। অথচ তাদের ধর্ষকের সাথে ঘর করতে বা আত্মীয়তা রাখতে কোনরকম লজ্জাবোধ নেই। তাদের কী খাদ্যের অভাব, নাকি ক্ষমতার, যে দিনের পর দিন একজন প্রতিষ্ঠিত ধর্ষকের সাথে থাকতে হবে? শোবে? নাকি ক্ষমতার ভয়ে তারা কিছু করতে পারছে না? মেয়েটিকে যেভাবে তারা অত্যাচার করলো তাতে করে তাদেরকে তো মনে হয় না ক্ষমতাহীন বা অবলা! বরং মনে হয়, চরম লোভী! হয়তো তুফানের টাকা না থাকলে তারাও থাকবে না!

লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, দেশের বেশিরভাগ ধর্ষণেরই চিত্র এমন। ধর্ষণের পর পরই পরিবার, প্রশাসন, এবং ক্ষমতার সাপোর্ট দিতে ধর্ষকের পাশে দাঁড়িয়ে যায় আত্মীয়স্বজন টাকাপয়সা, মায়া, এবং আত্মীয়তার খাতির নিয়ে, তাও বিনা শর্তে। এমন কী একবার হয়তো বলেও না, আবার এমন করলে আমরা কিন্তু সাথে নেই। ফলে দিন দিন সমাজটিই নষ্ট হতে থাকে। অতঃপর ক্ষমতায় যেই আসুক না কেন তাদের এটাকে আর হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা থাকে না। সে কারণেই তনু ধর্ষণে ধর্ষক এখনও অজ্ঞাতই থেকে গেল। ক্ষমতা এবং মায়ার বাঁধনে আটকে কোনো এক স্বজন রক্ষায় পুরো সেনাবাহিনী ব্যর্থতাকে মেনে নিলো। ফলে আরও পিছিয়ে গেল সমাজ এবং গোটা জাতি। সে বিবেচনায় এবার বগুড়ার ঘটনায় প্রশাসন চুপ থাকেনি, যথার্থই মানবিকতা দেখিয়েছে সঠিকভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে। আর হালাল হয়েছে তাদের রুজি-রোজগার।

প্রশ্ন উঠেছে, ক্ষমতাশীল দলগুলো কেন তুফানদের মত ধর্ষকদেরকে দলে রাখেন? 
তারা কি দল থেকে ধর্ষকদেরকে ঘাড় ধরে বের করে দিতে পারেন না? 
নাকি তাদের জানা নেই দলে কারা ধর্ষক?
নাকি ধরা না পড়া পর্যন্ত তারা বের করতে চান না– সেটাই মূল কারণ?

আমার প্রশ্ন, দেশের কোন দলে ধর্ষক অথবা মনমানসিকতায় ধর্ষকসম লোক নেই? শাকে যদি বেশির ভাগই পোকা থাকে তাহলে করার কী থাকে, সমাজটিই যখন নষ্ট প্রায়!

দেশের প্রায় প্রতিটি সাধারণ মেয়ে শিশু, কিশোরী, তরুণী, বৃদ্ধা যেমন চেনে সমাজে মেয়েদের প্রতি ছেলেদের দৃষ্টিভঙ্গি, তাদের ভাষা, কথা, ছোঁয়া, ধাক্কা, হেনস্তা, কিল, ঘুষি, চড়-থাপ্পড়, লাথি, গালির কথা, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকেও এমনই লোকজনের সাথে দিনরাত ওঠাবসা করতে হয়।

গোটা সমাজেই যদি পঁচন ধরে যায় তাহলে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া বা হাফেজি হুজুর কারোর পক্ষেই রাতারাতি আর তেমন কিছু বদলাবার থাকে না। সেই সাথে চালু আছে আবার ঘুষের কালচার। ফলে হাত বাড়াতে হয় সমাজেরও, কেননা তখন প্রয়োজন হয় সামাজিক আন্দোলনের পুরো সমাজকেই বদলে দিতে। সেই সাথে যদি থাকে ভোটের হিসাবনিকাষ থাকে, তাহলে তো কথাই নেই, একেবারে লারেলাপ্পা–জটিলতা বাড়ে আরও বেশি। তখন সমাজে একটিভ হয় বগুড়ার তুফান সরকারের মত সন্ত্রাসী বাহিনী এবং বাড্ডার শিপনদের মত ধর্ষক– তিন বছরের মেয়েকে ধর্ষণের মতো শরীরে কিছু নেই জেনেও মরণের থাবা মারে।

তবুও দেশে সুযোগ পেলেই অধিকাংশ পুরুষ মেয়েদের চলন, বলন, গড়ন, পরন নিয়ে কথা থামায় না, যদিও একজন পুরুষই ধর্ষকের হোতা। তাইতো রুবেলের মতো ফেমাস খেলোয়াড়ও ধর্ষণের অভিযোগে দাঁত কেলিয়ে হাসেন, অথচ কথা ছিল এমন অভিযোগে তারও লজ্জিত হবার।

মেয়েদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে কোন সরকারই ধর্ষণ আটকাতে পারবে না। কেননা মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা থেকেই তাদেরকে ধর্ষণ করা হয়। মনে করা হয় তারা নিকৃষ্ট, কোন মানুষই নয়। সমাজ শেখায় তাদের শরীর ছুঁয়ে দিলেই তারা অচ্ছুৎ হয়ে যায় যেনো একটি ডিসপোজেবল প্লেট– তার কোন মানুষের জীবন নয়, কোন বাঁচার অধিকার নেই, তাদেরকে রাতের অন্ধকারে ধরা গেলেও আর জীবনসাথী করা যায় না।

আর কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। অথচ পুরুষরা হাজারবার ধর্ষণ করেও ঐ একই সমাজে এক ডুবেই শুদ্ধ হয়ে যায়! এমনকি ডুবও হয়তো দেবার দরকার হয় না ক্ষেত্রবিশেষে! আসলেই কি তাই? লেডি ডায়না যদি ধর্ষণের শিকার হতেন, তাহলে কি তার লেডি ডায়নার নামটিই বদল হয়ে যেতো? এক ধর্ষণেই এতোদিনের মানুষটি ভ্যানিশ হয়ে যেতেন? এতোই মূল্যহীন একটি মানুষের জীবন–সম্ভব?

আমাদের সমাজে মেয়ে জন্ম নেবার সাথে সাথেই তার মূল্যহ্রাস ঘটানো হয় আচার-আচরণ এবং আনুষ্ঠানিকতায়– আজান দিয়ে ছেলে সন্তানের আগমন গ্রামবাসীকে জানানো হলেও, মেয়ে সন্তানের জন্মে সরবতার বিধান নেই। নামকরণ বা আকিকায়ও মেয়ের জন্যে এক ছাগল, ছেলের জন্যে দুই–শুরুতেই হয়তো লোকে আধা পেট খেয়ে ‘শালার মেয়ে’ বলতে বলতে বাড়ি ফেরে! অতঃপর অবিরত সমাজের চোখে ঘটতে থাকে মেয়েটির মূল্যহ্রাস। বিয়ে হলে ভার্জিনিটি হারিয়ে মূল্যহ্রাস, না হলেও ‘বিয়ে হয় না’ দায়ে মূল্যহ্রাস। কালো হলে মূল্যহ্রাস, গরীব হলে মূল্যহ্রাস, সন্তান হলে বডি নষ্ট হওয়ার দায়ে মূল্যহ্রাস, সন্তান না হলেও বাচ্চা না হবার কারণে মূল্যহ্রাস, বিধবা হলে মূল্যহ্রাস, তালাক হলে মূল্যহ্রাস, এতিম হলে মূল্যহ্রাস, বয়স বাড়লে মূল্যহ্রাস…।

কেননা নারীর মূল্য যেটুকু, সবই তার বুক, যৌনাঙ্গ এবং ভার্জিনিটিতে বসিয়ে দেয়া হয় এবং মূল্য নির্ধারকও একজন পুরুষ, আবার একজন ধর্ষকও ঐ লিঙ্গের। সমাজই অর্পণ করেছে এসব দৃষ্টিভঙ্গি, নিয়মনীতি একজন নারীকে কোণঠাসা করতে। আবার তারাই ওটা হরণ করতে কোটি বাহানা খোঁজে, অবিরত হাত বাড়াতে থাকেন এদিক-ওদিক দিয়ে– 

নারীর উপায় কী? উপায় একটিই, নারীর নিজের বিশ্বাস এবং অন্যকে পরোয়া না করে নিজের মূল্য নিজে অনুধাবন করা। কেননা প্রতিটি জীবনই অমূল্য সম্পদ।

নারীর গর্ভেই পুরুষের জন্ম–কখনও ধর্ষণে, কখনও বা ভালোবাসার সঙ্গমে। হাতে থাকে কম করে হলেও দশ বছর পুরুষকে মানুষ হতে শিক্ষা দেবার, যেন কোলের পুত্র সন্তানটি ধর্ষক হয়ে না ওঠে, একজন মানুষ হয়। তাকে মানুষ করে গড়ে তোলার মূল দায় পরিবার এবং সমাজের। রাষ্ট্রেরও। ছোট থেকেই বাবা-মাকে সম্মানের পাশাপাশি সমাজ যদি প্রতিটি মেয়েকে সম্মান করতে শেখায়, পরিবার এবং সমাজে ‘ধর্ষণে ধর্ষিতার সম্মানহানি ঘটে না’ শিখিয়ে যদি সামাজিকভাবে ধর্ষককে ঘৃণা করতে শেখানো হয়, এবং ধর্ষণের সাজা যদি তাৎক্ষণিক এবং কঠোর হয় তাহলে দেশে ধর্ষণের হার ব্যাপক হারে কমতে বাধ্য। আত্মীয়তার খাতিরে ধর্ষককে বার বার ক্ষমা করা ধর্ষককে আরেকটি ধর্ষণে উৎসাহিত করা ব্যতীত আর কিছু নয়, কেননা ওটা তখন তার নেশা হয়ে দাঁড়ায়।

আর একটি মেয়ের যৌনাঙ্গ, বুক এবং ভার্জিনিটিও কখনও তার মূল্য নির্ধারক হতে পারে না–সেও সম্পূর্ণ একজন মানুষ। কিছু হাবিজাবি লোক বিয়ে করে বা না করে জোরজবরদস্তিতে নারীকে ছুঁয়ে দিলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। কেননা প্রতিটি জীবনের সূত্রই স্পন্দন, স্বপ্ন, পথচলা, ছন্দপতন, উঠে দাঁড়ানো, কর্ম, সৃষ্টি , এবং নিজের মত করে শ্বাস নেয়া। নারীর মূল্য নির্ধারক নারী নিজেই– তার বিশ্বাস! 
আর চাপ বাড়ালেই সমাজ বদলায়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.