মেয়েরা কেন বয়স লুকায়!

দিনা ফেরদৌস:

আমার এক কলিগ পড়াশুনা একটু বেশি করায় নিজের জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে আমার মধ্যস্থ্যতায় আমার প্রতিবেশি যোগ্য পাত্রের সঙ্গে কলিগের বিয়ে হলো। ধরা যাক, আমার কলিগ দিদির নাম ‘ক’। ‘ক’ দিদি হচ্ছেন তাদের পরিবারের সবার আদরের ছোটবোন। তিনি ভালবেসে বড় ভাইদের নাম ধরে ডাকেন, তুই বলে সম্বোধন করেন। পরিবারের সকলে আদর করে ‘ক’ দিদিকে মণি বলে ডাকেন।

বিয়ের কয়দিনের মাথায় একদিন সকালে ‘ক’ দিদি ভীষণ কান্নাকাটি করে এসে আমার বাসায় হাজির। বললেন; তার বয়স নিয়ে স্বামী সন্দেহ পোষণ করেছেন। কারণ তিনি তার বড় ভাইদের নাম ধরে ডাকেন। বাসার অনেকের সামনেই স্বামী তাকে প্রশ্নটি করেছেন। ‘ক’ দিদির কান্নাই বলে দিচ্ছিল যে, শুধু লজ্জার কান্না তা নয়, কঠিন অপমানেরও।

প্রশ্ন আসতে পারে, বয়স একটি স্বাভাবিক বিষয়, সবাই’তো আর বয়স লুকায় না, এতে লজ্জা বা অপমানের কী আছে? স্বামী এ প্রশ্ন করতেই পারেন। অবশ্যই স্বামীর নিজের স্ত্রীর বয়স জানার অধিকার আছে, ডাক্তার হলে রুগীর সঠিক বয়স জানার অধিকার আছে, আইনি কাজে আসল বয়স অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

তাহলে কেনো এই লুকোচুরি? তার আগে আর একটা উদাহরণ দেই। আমার পাশের বাসার বিয়ে উপযুক্ত এক ফুফু তার আপন ছোট ভাইকে ভাইয়া বলে ডাকেন। আর ছোটভাই ডাকেন তাকে নাম ধরে। সেটা আমরা অনেকেই জানি, আবার কেউ কেউ জানে না।

এখন আসি মেয়েদের আসল বয়স জানার সমস্যাটা কী? সমাজের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী একটা মেয়ের বয়স হয়ে যাওয়া মানে বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়া। বিয়ের ব্যাপারে বয়স বিশাল ফ্যাক্ট্রর হয়ে দাঁড়ায় যদি পাত্র থেকে কন্যার বয়স বেশি হয়। দাদার বয়সী লোকের সাথে নাতনীর বয়সী মেয়ের বিয়েকে এই সমাজ যতোটা সহজে মেনে নিতে পারে, ঠিক ততোটাই কঠিন হয়ে যায় পাত্রী থেকে পাত্রের বয়স কম হলে। কনের বয়স বেশি হলে সমাজ অসম বিয়ে বলে দিব্যি চালিয়ে নেয়।

প্রচলিত আছে, পুরুষের বয়স দেহে নয়, মনে। কিন্তু আমরা ভালো করেই জানি, দেহের কাজ কোনভাবেই মন দিয়ে করা করা সম্ভব না। একজন পঞ্চাশোর্ধ নারীকে দিয়ে যেমন সন্তান জন্মদান সম্ভব না, তেমনি পঞ্চাশোর্ধ পুরুষকে দিয়ে তৃপ্তি সহকারে যৌনসুখ লাভ করাও সম্ভব না।

অনেক মেয়েই আছেন স্বামীর সঙ্গে একটু পুতুপুতু, ন্যাকামি করতে পছন্দ করেন। সেখানে বয়স একটু কম দেখাতে পারলে বেশ সুবিধা। অনেক স্বামীদের বলতে শুনেছি; আমার বৌ’টার বয়স কম, তাই বহু কিছু ছাড় দেই। বয়স হলে ঠিকই বুঝবে। এখানে প্রিয়তমা বৌয়ের দোষ-ত্রুটিকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না, তার কম বয়সকে ছাড় দেয়া হচ্ছে।

ব্যক্তি জীবনে বিয়ের কারণে বা কখনো সম্পর্কের কারণে বয়সে অনেক বড় দেবর-ননদকে নাম ধরে ডাকি। আবার সম্পর্কের কারণে বয়সে ছোট খালা, মামী, ভাবী তাদের নাম ধরে ডাকতে পারি না। বয়সে বড় বা কাছাকাছি বয়সের অনেকের আমি চাচী, মামী, ভাবী, খালা, ফুফু হই। আবার কারো কারো সাথে সম্পর্ক এমন যে, তারাও আমায় কিছু বলে ডাকেন, আমিও ডাকি। যেমন, ভাবী। তার মানে এই নয় যে হাটে, মাঠে, ঘাটে সবাইকে অপ্রয়োজনে নিজের বয়স বলে বেড়াতে হবে; অথবা কারো বয়স বা এসএসসি এর সন জানতে চাইবো বিভিন্ন অছিলায়।

অনেকেই আছেন কোনো কারণ ছাড়াই নিজের বয়স বলে অন্যেরটা জানতে চান। আপনি নিজেরটা বলে শান্তি পান তাতে আরেকজনের কী, কথা হচ্ছে অন্যে তার বয়স বলতে আগ্রহী কি না! কেউ এই ব্যাপারে আগ্রহী না থাকলে তাকে বয়স জানার জন্য চাপাচাপি করা চরম অভদ্রতা। আমেরিকাতে প্রথম এসে ভাষা এবং কালচারের উপর ক্লাস করেছিলাম কিছুদিন। সেখানে কম বয়সী এক টিচারকে কোন স্টুডেন্ট বয়স জিজ্ঞেস করেছিল। টিচার খুব বিরক্ত হয়ে মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন, এটা তোমার পাঠ্যপুস্তকের বিষয় না, আর আমি তার উত্তর দিতে আগ্রহী না।

এরকম প্রশ্নে আমরা সরাসরি কিছু না বলে মিথ্যা বলি, যার উত্তর দিতে কেউ বাধ্য না। কথা হচ্ছে, অপ্রয়োজনে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করলে আমাদের অনেকেই শান্তি খুঁজে পান না। কে কবে বিয়ে করবে, কার বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, কার বাচ্চা হচ্ছে না, কে এক বাচ্চা নিয়ে বসে আছে, আর একটা চাইলেই নিতে পারে, কার বউয়ের বয়স বেশি, কার বর তার থেকে বয়সে ছোট, কম বয়সী বর নিয়ে কে কেমন মাস্তি করে ইত্যাদি।

সকলে যে শুধু হিংসা করে বলে তা না, কেউ কেউ এইসব বলেই আড্ডা দেয়, গল্প জমায়। আমরা যারা বুঝি এইসব উচিত না তারা হয়তো এইসব বলি না, কিন্তু অন্যে বললে সেইসব মুচমুচে গল্প ঠিকই শুনি বিনা প্রতিবাদে। যেই ‘ক’ দিদিকে দিয়ে শুরু করেছিলাম কাহিনী তার স্বামী বা এ জাতীয় পুরুষ যারা নিজের বৌ বা পরের বৌয়ের বয়স নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তারা কিন্তু ঠিকই ঘরে নিজের বিবাহ উপযুক্ত বোন, মেয়ে, ভাতিজি, ভাগ্নির বয়স অন্য জায়গায় কমিয়ে বলেন, অথবা বিষয়টি এড়িয়ে যান।

নিজের সম্পর্কে সত্য প্রকাশে অবশ্যই এক ধরনের আনন্দ আছে। যেমন ধরেন; সাজগোজ  অবস্থায় কেউ আপনাকে সুন্দর বললে যতোটা ভাল লাগে, দেখবেন তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভালো লাগে সাজগোজ ছাড়া কেউ যখন বলে আপনি ন্যাচারাল বিউটি। কারণ আপনি ভাল করেই জানেন, এই সাজগোজ করে নিজের কোন কোন খুঁতগুলোকে আড়াল করেছেন। মেয়েদের বয়স লুকানোর মধ্যে আলাদা কোন আনন্দ বা সুখ নেই, কিন্তু বয়স প্রকাশের মধ্যে আছে বহু সামাজিক যন্ত্রণা।

মনে আছে, রবি ঠাকুরের “হৈমন্তী” গল্পে হৈমন্তীর শ্বশুর তাকে ” আইবুড়ো মেয়ে ” বলেছিলেন। কারণ তখনকার সমাজে মেয়েদের দশ বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ের প্রচলন ছিল। সেখানে হৈমন্তীর বয়স ছিল সতেরো। যা নিয়ে সমাজে সমালোচনা হতে পারে, সেইজন্য শাশুড়ী প্রতিবেশিদেরকে হৈমন্তীর বয়স কমিয়ে বলেছিলেন। আমাদের সমাজে মুখে এখন কেউ কিছু না বললেও মনে মনে বিশ্বাস করে, ” মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি “।

অনেকেই মনে করেন, মেয়েরা বেশি পড়া-লেখা করলে বয়স বেশি হয়ে যাবে। কাদামাটির মতো আর নরম থাকবে না, তাই ইচ্ছামতো নির্যাতনও করা যাবে না। এজন্য দেখা যায় বিয়ের পাত্রী হিসেবে অনার্সে পড়ুয়া মেয়েদেরই পাত্রপক্ষের বেশি পছন্দ।

মেয়েদের বয়স, রূপ, গুণ এসব নিয়ে মিথ্যা বলার মধ্যে বিশেষ কোন কৃতিত্ব নেই, আমি জানি যারা এসব নিয়ে মিথ্যা বলে, তারা এই সমাজ ব্যবস্থার প্রচলিত নিয়মের মধ্যে আটকা পড়ে আছেন। একবার খুব কাছের একজনের বিয়ের বায়োডাটাতে দেখলাম ,উচ্চতা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। পাত্রীর বড়বোনকে বললাম, পাত্রীর উচ্চাতা তো ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি। বললেন, সমস্যা নাই। আগে দেখতে আসুক, পছন্দ হয়ে গেলে এসব নিয়ে কে ভাবে! ৫ ফুটের উপরে শুনলে আলাদা হিসাব করবে, আর ৫ ফুটের নিচে শুনলে আগেই পালাবে।

এইভাবে আরেকবার খুব কাছের এক জনের জন্য জিন্সের প্যান্ট আনার কথা। যাবার আগ মুহূর্তে তার কোমরের মাপ জানতে চাইলে তার স্বামী উত্তর দিলেন, তিনিও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন যেন এটাই ঠিক। আনার পর দেখা গেল, তিনি যে মাপ দিছিলেন, জিন্সের প্যান্টটি তার থেকে অনেক ছোট। শেষে তিনি নিজেই বললেন, কয়দিনে একটু বেশি মোটা হয়ে গেছি তাই হয়নি, আগে এই মাপই ছিল (যদিও স্বামী তখন পাশে ছিলেন না)। পরে বুঝেছি, তিনি তার মাপ ঠিকই জানতেন। স্বামী যেখানে বলে দিছেন, আর সঠিকটি বুঝতে পারেননি, তাই তিনি এর বেশি বলেননি।

অথচ এই সমাজেই বহু স্বামী নিজের স্ত্রীর জন্য অন্তর্বাস, পেন্টিসহ আরও অনেক ব্যক্তিগত জিনিষ কেনাকাটা করেন। বিষয়টা হচ্ছে মানসিকতার। কে কিভাবে বিষয়টিকে দেখতে চান। আমার এক বান্ধবী ছিল সে সব সময় স্কার্ট, টপস এই জাতীয় জামা পরতো। আরেক বান্ধবী একদিন তাকে বললো, আমরা তো স্কার্ট জাতীয় জামা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি, তুই এখন এইগুলা বাদ দে। সে বললো, তোর তো ঘরে বড়বোন নেই, আমার দু’জন আছে। এখন থেকেই যদি সালোয়ার- কামিজ পরা শুরু করি ,তবে লোকজনদের চোখে একসাথে তিনজনকেই বিবাহ উপযুক্ত হিসেবে চোখে পড়বে। তার সেই কথাটি আমি তখনই ফিল করতে পেরেছিলাম। এটা তার নিজস্ব ইচ্ছে নয়, এটা সমাজের দায়ে।
এই সমাজে একটা মেয়ের বয়স বেড়ে যাওয়া মানে, সেই বয়সের ওজনে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশিসহ, সারা সমাজের ঘাড় যেন বাঁকা হয়ে যাওয়া। বয়স হয়েছে মানেই বিয়ে দিতে হবে। বয়স হয়েছে মানেই ধাড়ি মেয়ে, এই করতে পারবে না, ওই করতে পারবে না। বয়স হয়েছে মানে তার মনের চঞ্চলতার কোনো দাম নেই। বয়স হয়েছে মানে এই বয়সের বোঝা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে। বয়স হয়েছে বলেই তাকে বয়স লুকিয়ে রাখতে হবে, নয়তো সে বুড়ি, আইবুড়ো আরো কত কী খেতাব পেতে হবে। এইসব সামাজিক প্রথার কারণেই মেয়েরা বয়স লুকাতে না চাইলেও, বাধ্য হয়েই তা লুকাতে হয়।

যদিও আগামী প্রজন্ম এসব থেকে মুক্ত। কারণ তাদের সাহস আছে, যেকোনো সত্যের মুখোমুখি হতে তারা ভয় পায় না। এইসব নষ্ট সমাজেরও ধার ধারে না। মনের শক্তি থাকলে কোনো মেয়ের বয়স, গায়ের কালো রঙ, উচ্চতা বা স্থুলতা কোন ক্ষেত্রেই বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। মানুষের এইসব নোংরামি মন্তব্যকে গুরুত্ব দেয়ার ফলেই অনেকেই ভিতরে ভিতরে নিজেকে দুর্বল ভাবতে শুরু করেন। যার ফলেই এইসব লুকোচুরি।

শেয়ার করুন: