মুমিতুল মিম্মা:
দিন শেষে কাজে থেকে ফিরতে হয় সকল মানুষকে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহৃত হয় জনমানুষের জন্যে। সেই পাবলিক ট্রান্সপোর্টে হয়রানি করা হয় মেয়েদের। আর সেগুলো নিয়ে কটূক্তি করে ‘কোবতে’ লেখেন একদল কবি। আর মেয়েদেরকে মেয়েদের বিপক্ষে লেলিয়ে দেন একদল নারী লেখক।
আজ পাবলিক ট্রান্সপোর্টে উঠেছিলাম। আসাদগেট আটকানো পানিতে। ডি-লিঙ্কের বাসে সবগুলো ছেলে দাঁড়ানো। মেয়েদের বিরুদ্ধে সবগুলো ছেলে একযোগে বলে উঠলো, “কন্ডাকটর মহিলা উঠাবি না” ব্যস মেয়ে ওঠানো বন্ধ বাসে। মহিলা সিটে এখন বসবেন পুরুষেরা। আমাদের দুজন মেয়েকে একজন পুরুষ বলে বসলেন, “চাপেন ওদিকে আমরা বসবো।”
আমি বললাম, “এখানে আরো দুজন মেয়ে উঠানো হবে। মহিলা সিট নেই মানে কী? মেয়েরা বাসে যাবে না? ৬০ জনের বাস শুধু পুরুষ নিয়েই চলবে নাকি?”
ওদিক দিয়ে বাসে ওঠা সকল ছেলে এবার পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ হয়ে উঠলেন। সবার এক কথা, “আপনি এতো কথা বলেন কেন?”
ড্রাইভার বলে উঠল, “আপনের সমস্যা কী? বহুতক্ষণ ধইরাই তো চিল্লাইতেছেন। আমি মহিলা উঠামু না, আমার সমস্যা আছে” ।
আমি আর এই “উঠামু না” শুনে স্থির থাকতে পারলাম না। আমি এবার গলা চড়িয়ে বললাম, “যারা পেছন থেকে বলছেন মহিলা উঠাবি না, সেই ভাই সকল একটু সামনে আসেন, আমি শুনি কেন আপনারা চার-চারটা মহিলা সিটে নারী ওঠাবেন না? ৬০ জন পুরুষের বিপরীতে ৪জন মহিলাকে ওঠাতে আপনাদের সমস্যা কোথায়?”
ড্রাইভার এবার ক্ষেপে গেলেন, “আমি উঠামু না আমার ইচ্ছা আপনি কী করবেন করেন”-
“আমি কী করবো? আরেকজন মহিলা না ওঠা পর্যন্ত বাস থেকে নামবো না। আমি দেখতে চাই আপনি কতদূর আমাকে নিয়ে যেতে পারেন! মহিলা উঠবে না এটা কী ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা?”
দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ড্রাইভারসহ সকল পুরুষ ক্ষেপে একশেষ। নারীরাও টুঁ শব্দটি করলেন না। এরই মধ্যে বাচ্চাসহ এক মা উঠতে গেলে ড্রাইভার দিল গাড়ি টান। আমি দরজায় ঠায় দাঁড়ানো। একটা সময় বাধ্য হয়ে একজনকে ওঠাতে হলো ওদের। মেয়েটাকে উঠিয়ে বাস ছেড়ে হৃষ্টচিত্তে নামলাম আমি। দিন শেষে চার সিটের বিপরীতে একজনকে উঠাতে পারলাম। দিন শেষে এই সামান্য চেষ্টা কাউকে দ্রুত ঘরে ফিরতে সাহায্য করবে।
বারবার আমি আক্রমণ করি পুরুষতন্ত্রকে, আক্রান্ত হয় পুরুষ।
পুরুষদের কাছে আমার প্রশ্ন –
আপনার প্রিয়তম, আপনার মেয়ে, আপনার বোন দ্রুত ঘরে ফিরুক এটা সবাই চায়। কিন্তু রাস্তায় ট্রান্সপোর্টের অভাবে দাঁড়ানো মেয়েগুলোকে দেখে কন্ডাকটরকে বলে বসেন “বাসে মহিলা উঠাবি না”। এটা বলে আপনি কী আপনার চিন্তিত সময়টাকে দীর্ঘ করে ফেলেন না? কারন এই দাঁড়ানো মেয়েগুলোই কেউ কারও প্রিয়তমা, কেউ বোন, কেউ মেয়ে, কেউ মা। আপনি আজ একজনকে মেয়েকে বাসে উঠতে বাধা দিলেন মানে আরেকদিন আরেকজন আপনার প্রিয় স্বজনকে বাধা দেবে। এই চক্র আপনার মাথায় আসে না কেন? এটাকে আপনার কাছে কেন হ্যারাজমেন্ট মনে হয় না?
পুরুষ, কারও জন্যে আপনি কিছু করছেন মানে প্রকৃতির কাছে আপনি জমা রাখছেন নিজের জন্যে। জমা রাখবেন যখন ভালোবাসাই জমা রাখুন না। পৃথিবীটা ভরে উঠুক আপনার আমার ভালোবাসায়।
আজ আপনি কারও স্বজনের জন্যে করছেন মানে কাল আরেকজন আপনার স্বজনের জন্যে ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। ক্রমশ সহিংস হয়ে ওঠা কালচে পৃথিবীটা ভালোবাসার ঊষার রক্তিম আভায় উজ্জ্বল হোক!
বিশ্বাস করলেন না? আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠে জুটিদের জন্যে বেশিরভাগ সময় ডাবল সিট ছেড়ে দেই। পাশাপাশি বসা জুটি দেখতে আমার ভালো লাগে। একদিন বাংলামোটর রিক্সার জন্যে দাঁড়িয়েছিলাম দু বন্ধু। এক ভদ্রলোক রিক্সায় উঠেছেন। রিক্সা ছেড়েও দিয়েছে গন্তব্যের পথে। তিনি আমাদের দেখে রিক্সা থামালেন। তারপরে নেমে আমাদের এসে বললেন, “আপনারা উঠে যান রিক্সায়, আমি পরের রিক্সায় আসছি” আমি হতবাক হয়ে চিন্তা করছিলাম আমি কী এই আচরণ কারও সাথে করেছি? হ্যাঁ, করেছি বলেই পেয়েছিলাম।
আরেকদিন বাসে বসে আছি। ভোরে উঠেছি বিধায় ঘুম পাচ্ছিল খুব। ঘুমিয়ে গিয়েছি। মুখের উপরে রোদ এসে পড়ছিল। এক আঙ্কেল সেটা দেখে তার পেপার এগিয়ে দিলেন আমার দিকে বললেন, “মামনি, এই পেপারটা মুখের উপরে দিয়ে রাখ, রোদ পড়বে না।” আমি অবাক। এই একই আচরণ আমি এক বয়োবৃদ্ধ ভদ্রলোকের সাথে করেছিলাম। ব্যাগে রাখা পাখা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, “আঙ্কেল, আপনার মুখের উপরে রোদ পড়ছে। এটা নিয়ে বসুন রোদ পড়বে না”।
হ্যারাজমেন্টটাতে নিশ্চুপ থাকলেন মানে অংশগ্রহণ আপনিও করলেন। প্রিয় পুরুষ, আমি জানতে চাই কেন এই হঠকারিতা? তবুও আপনি ভাবেন আপনার মেয়েটি বড় হোক নির্মল পরিবেশে, আপনার স্বজনেরা ঘরে ফিরুক নিরাপদে!
পুরুষ নারী কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নয় সমাজে। সমাজ এবং এই রাষ্ট্রকে নিরাপদ করার জন্যে সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করার এই প্রক্রিয়াতে আপনার অংশগ্রহণ আপনার স্বজনের জন্যে দরকার। আমাদের সবার জন্যে দরকার।
ভালোবাসা সবার জন্যে!
জীবন ভালোবাসাময় সুন্দর