তনয়া দেওয়ান:
আত্মহত্যা মহাপাপ। এটা জানে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। মহাপাপ জানার পরও কেন হাজার হাজার মানুষ এই মহাপাপের পথ বেছে নেয়?
ইতিহাস সাক্ষী, ধর্মযাজক থেকে শুরু করে তাবৎ সুন্দরী মেরিলিন মনরো থেকে ভারতীয় সুন্দরী দিব্যা ভারতী, বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক থেকে শুরু করে বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারও এই পথে হেঁটেছেন। কিন্তু কেন? তাদের জীবনে এমন কীসের অভাব ছিল, যার জন্য তাদেরকে এই মহাপাপের পথে হাঁটতে হয়েছে?
জরিপ বলছে, পুরো পৃথিবীতে প্রতি বছরে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, প্রতিষ্ঠিত হওয়া না হওয়া কোনো কারণ নয়, আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হলো দীর্ঘ সময়ের বিষন্নতা। বিষন্নতা নানাভাবে হতে পারে, দাম্পত্য জীবনের জটিলতা, প্রেমে ব্যর্থতা বা পরীক্ষার ফলাফলে অসন্তুষ্টি বা পেশাজীবনের জটিলতা বা পারিবারিক কলহসহ বিভিন্ন ধরনের ঘটনা থেকেই বিষন্নতার শুরু হতে পারে।
একটা মেয়ের জীবন থেকে কিছু কথা বলি, মেয়েটি ছিল খুব মিশুক, চঞ্চল, প্রাণবন্ত। হঠাৎ করেই সে চুপ হয়ে যায়। এক সময় মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। না, একদিনের সিদ্ধান্তে সে ওই পথ বেছে নেয়নি, কারো উপর রাগ বা অভিমান করেও নয়, বরং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তাকে বিষিয়ে তুলেছিল দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তাই দীর্ঘসময় সে বিষন্নতায় ভুগেছিল, একসময় হাতে মদ, সিগারেট টেনে ধরেছিল, তাতেও বিষন্নতা কাটেনি। বরং পাল্লা দিয়ে বিষন্নতা বেড়ে উঠেছিল। এর সাথে সাথে কমে গিয়েছিল জীবনের চাওয়া-পাওয়া, তার বিশ্বাসের দরজাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যে মেয়ে দিনরাত এক করে স্বপ্ন দেখতো, সেই মেয়ের জীবনের স্বপ্নের চাকা থেমে গিয়েছিল।
স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, কথাটা শতভাগ সত্যি। একটা স্বপ্নের মৃত্যু হলে মানুষ আরও নতুন নতুন স্বপ্ন দেখে, এটাই মানুষের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যখন মানুষের স্বপ্নের চাকা থেমে যায়, তখন নতুন কোনো স্বপ্নই তৈরি হয় না। তার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তাই শরণাপন্ন হয়েছিল মনোরোগ বিশেষজ্ঞের, কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ঠিকই এমনই একটা দিনে আত্মহত্যার পথকে উত্তম পথ মনে করে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিল। ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন, তাই এ যাত্রায় ব্যর্থতার সাথে সে বেঁচে গিয়েছিল। এরপরের দিনগুলি ছিল আরও কঠিন, খালি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। চোখে ঘুম ছিল না, দুই মিনিট পর কী হবে সেটাও ভাবতে পারতো না, হাসতে পারতো না, কথা বলতে পারতো না, খেতেও পারতো না, এক একটা দিন তার কাছে কতোটা যন্ত্রণার ছিল, ভাবা যায়?
তারপর একদিন মেয়েটি ভাবলো, কতটা সে আত্মকেন্দ্রিক, যার জন্য সে শুধু নিজের কথাই ভাবছে? ভালো তো সবাই থাকতে চায়, ভালো রাখতে চায় কতজন? কেন সে সবার মতো হবে? তার ভালো রাখার দায়িত্ব কেউ নেয়নি বলে কি সেও কাউকে ভালো রাখবে না? আরে ভাই, পৃথিবীতে সুখী মানুষ বলতে কেউ কি আছে? পাওয়া যাবে সেই সুখী মানুষটাকে? বাস্তবিক উত্তর হলো, না। তাহলে কেন, কীসের আশায় এই আত্মহনন?
পৃথিবীর কোনো মানুষই সম্পূর্ণ সুখী নয়। আজকে যে মানুষটা মিষ্টি হাসি দিয়ে নিজেকে সুখী দাবি করছে, খবর নিয়ে দেখুন তারও মনের গহীনে কতগুলো দুঃখ লুকিয়ে আছে। নিজের যা আছে তাই দিয়েই তারা সুখী হওয়ার চেষ্টা করে, কষ্টগুলোকে ভুলে থাকার চেষ্টা করে।
আচ্ছা, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করি, পেটে ক্ষুধা লাগলে ক্ষুধা নিবারণ করার মতো শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য কি আপনার আছে?
লজ্জা নিবারণ করার প্রয়োজন মেটাবার পরও বিলাসিতার জন্য দু চারটা জামাকাপড় আপনার কি আছে?
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে একটু বিশ্রাম নেওয়ার ঠিকানা আপনার আছে তো?
এই যে আপনি এমবি খরচ করে এন্ড্রোয়েড ফোনে বা কম্পিউটারে বসে এই লেখাটা কষ্ট করে পড়ছেন, তাতে মনে হচ্ছে আপনার উপরের সব প্রশ্নের উত্তরই হ্যাঁ।
আর যাদের উত্তর আসলেই না, তাদের কথা একবার ভাবুন তো, তারা কীভাবে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন! তাদের তো তাহলে সকালে একবার, বিকালে একবার আত্মহত্যা করার কথা, তাই নয় কি?
তারা যদি শুধুমাত্র মনের জোরে জীবনযুদ্ধে বীরের মতো যুদ্ধ করতে পারে, তাহলে আপনি পারবেন না কেন, বরং আপনার তো বেশি পারার কথা। চোখ খুলে দেখুন, রাস্তায় বেরোলে কত-শত মানুষ অন্যের দ্বারে দ্বারে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য হাত পাতে! সে যদি তার জীবনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করতো, তাহলে সে কখনোই বাঁচার জন্য আকুতি করতো না।
ভুলে যাবেন না, আপনার জীবনটাও গুরুত্বপূর্ণ। আপনার জন্য তো বটেই, আপনার আশেপাশের মানুষদের কাছেও আপনার জীবন গুরুত্বপূর্ণ, হয়তো আপনি বুঝতে পারছেন না অথবা অন্যরা বুঝতে পারছে না। নিজের জীবনের গুরুত্ব আগে নিজে বুঝুন, তারপর অন্যকে বোঝান।
জানেন তো, পালিয়ে যাওয়ার নাম জীবন নয়, যুদ্ধ করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার নামই জীবন।
মনে রাখবেন, জীবন চলার পথে সবাইকে বিশ্বাস করা যেমন বিপদজনক, ঠিক তেমনি কাউকে বিশ্বাস না করাটা আরও বেশি বিপদজনক। তাই যাকে যতটুকু বিশ্বাস করা প্রয়োজন, তাকে ঠিক ততটুকুই বিশ্বাস করুন।