দেশটা যেন মগের মুল্লুক হয়ে গেছে

জেরিনা শাবনাজ আক্কাস:

কীভাবে যে শুরু করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। একটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নতুন আরেকটি ঘটনা সামনে আসছে।  আমরা যারা এই সমাজে বসবাস করছি দিনকে দিন কেমন যেন দানব হয়ে উঠছি। নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি যেন প্রতিফলিত হচ্ছে চারিদিকে। যার যেভাবে ইচ্ছে হচ্ছে সেভাবেই সে তার বর্বরতা প্রদর্শন করছে। বছরের শুরু থেকে এই পর্যন্ত সবকিছু অবলোকন করে মনে হচ্ছে দেশটা যেন এক মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে।

ঘটনা ১: গত ১৪ জুন ফেসবুকের বরাতে হঠাৎ একটা ভিডিও নজরে এলো – দেখলাম, একজন নারী ঘোমটা দিয়ে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার চারদিকে অসংখ্য পুরুষমানুষ। হঠাৎ একজন শক্ত সামর্থ মাঝবয়সী পুরুষ কতগুলো বেত একসাথে করে ওই নারীর পশ্চাতে মারতে লাগলো। বেত্রাঘাতের ধরন দেখেই মনে হচিছল লোকটি তার শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছিল ওই নারীটিকে আঘাত করতে। চার থেকে পাঁচটি বেত্রাঘাত খাওয়ার পরই সেই নারী মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। কিন্তু এতেও রক্ষা পেল না, সেই পুরুষটি আরো দু’ঘা লাগিয়ে দিল। লুটিয়ে পরা নারীটির দিকে সবাই কয়েক পলক তাকিয়ে থাকার পর ২/৩ জন পুরুষ এসে আবার তাকে দাঁড় করিয়ে দিলো। আর সেই মানুষরুপী দানবটি এসে আবার পেটাতে লাগলো। এবার আর বোধহয় সহ্য করার এতোটুকু শক্তিও ছিল না, তাই ১/২টি বেত্রাঘাতের সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। এটি নাকি ইসলামী শরিয়াহ আইনের বিচার!

ভিডিওটি দেখার পর থেকে কিছুতেই সেই দৃশ্য আমি মন থেকে মুঝে ফেলতে পারছি না। বার বার শুধু ঐ  বেত্রাঘাতের দৃশ্যটিই চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এতোগুলো পুরুষ মানুষ নিরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল একজন নারীর মার খাওয়া। কী নিষ্ঠুরতা! এটা মধ্যযুগীয় বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

মানুষের বিবেক কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয় কেমন করে? সমাজ নিয়ে এতো চিল্লাচিল্লি হয়, জাত গেলো জাত গেলো বলে এতো ফাটাফাটি হয়…..কিন্তু চারিদিকের এতো নিষ্ঠুরতা দেখে সমাজ কী করছে? সমাজের মানুষরাই বা কী করছে? কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?

ঘটনা ২: সেদিন পত্রিকায় দেখলাম ধর্ষণের পর ধর্ষক নিজেই নির্যাতিত মেয়েটিকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরেই ফেলেছে জনগণের সামনে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১১ জুন)। কেউ কোন টুঁ শব্দটিও করেনি, শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই নিষ্ঠুর র্নিযাতনকে উপভোগ করেছে আর দাঁড়িয়ে থেকে একজন মানুষ যে কিনা একজন নারী, মার খেতে খেতে কীভাবে না ফেরার দেশে চলে গেল, তার সাক্ষী হয়ে রইলো।

বলাই বাহুল্য, এই ধর্ষকই আবার আট বছর আগে এই মেয়েটির স্বামীকেও খুন করে এবং পরে তার চাচাকেও খুন করে। এতোগুলো অন্যায় করার পরও লোকটি দিব্যি বুক ফুলিয়ে এতোদিন এই সমাজেই ঘুরে বেড়িয়েছে, সমাজে বাস করেছে (যদিও মেয়েটিকে হত্যার পরই ঐ লোকটিকে গ্রেফতার করা হয়)। তাহলে এই সমাজ কী ভূমিকা রেখেছে একজন খুনি ও ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে?

ঘটনা ৩: দৈনিক আমাদের সময়ে প্রকাশিত একটি ঘটনা মনে খুবই নাড়া দিয়েছে। ২৩ বছর বয়সী এক তরুণী বখাটে যুবকদের হয়রানি থেকে রক্ষা পাবার জন্য বনানী থানায় জিডি করলো। কিন্তু বিধিবাম, জিডি করার পরদিনই তরুণীটি গণর্ধষণের শিকার হয়। এ নিয়ে গত ১৪ মে দৈনিক আমাদের সময়ে ‘জিডির পরদিনই গণর্ধষণ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। এতে তুলে ধরা হয় যে, ধর্ষকরা এলাকায় বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচেছ এবং তাদেরকে পুলিশ ধরছে না। উল্টো ধর্ষকদের হুমকিতে দিশেহারা মেয়েটির পরিবার। এর পরের ঘটনা আরো ভয়াবহ। ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে মেয়েটি থানাতেও নির্যাতনের শিকার হয়। মামলাটি এক পর্যায়ে যখন বনানী থানা থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের উইম্যান সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে পাঠানো হয়, তখনই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। ভিকটিমের ভাষ্যানুযায়ী, মোটিভেশনের কথা বলে থানাতে নিয়ে ধর্ষকদের সাথে আপোস করার জন্য মেয়েটির উপর নেমে আসে নানারকম শারীরিক নির্যাতন (আমাদের সময়, ১১ জুন)।

ঘটনা ৪: কালের কন্ঠ অনলাইনে গত ৯ জুলাই প্রকাশিত একটি খবর আমাকে বিচলিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ঘটনাটি ঘটেছে টাঙ্গাইলের নাগরপুর গ্রামে। মো. সিরাজ মিয়া নামে এক লোক প্রতিবেশীর স্ত্রীকে পাট ক্ষেতে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ সময় স্থানীয় লোকজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে ধর্ষক পালিয়ে যায়। স্থানীয়রা ওই নির্যাতিতা নারীকে উদ্ধার করে স্থানীয় একজন ইউপি সদস্যের জিম্মায় রাখেন। পরেরদিন শনিবার বিকালে  এই ঘটনা নিয়ে সালিশ বসে। সালিশে ধর্ষকের কী বিচার হলো সেটা মুখ্য বিষয় নয়, চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, নির্যাতিতাকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা ও শারীরিক শাস্তিরও আদেশ করেন মাতব্বরেরা। যেই আদেশ সেই কাজ, ওই নারীকে সকলের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে পেটানো হচ্ছে,  আর তা দেখে উপস্থিত সকল পুরুষ হাসছে। দৃশ্যটি দেখে মনে হয়েছে, নাগরপুরের পুরুষগুলো বুঝি খুবই আনন্দের একটা কিছু দেখছেন। কী ভয়ংকর সেই নির্লজ্জতা! এই ঘটনার দৃশ্যপটও আমাকে খুবই বিচলিত করেছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ করেছে যে, আমরা কি সামনের দিকে এগুচ্ছি? নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি?   

ধর্ষণের শিকার একটি মেয়েকে আবার শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতন করা হলো এই সালিশের রায় অনুযায়ী। এ কেমন বিচার? কেন মেয়েটিকে দণ্ডিত করা হলো? তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে? ভিকটিম নিজেকে ধর্ষণ থেকে বাঁচাতে পারলেন না বলে? সবচেয়ে অভিনব হলো, সালিশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জরিমানার মোট ৪৫ হাজার (ধর্ষকের ৩০ হাজার ও ধর্ষিতার ১৫ হাজার) টাকা স্থানীয় ক্লাবের উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। চমৎকার বিচার! চমৎকার দেশ!

আজকাল পত্রিকা খুললেই ধর্ষণ এবং গণ ধর্ষণের খবর চোখে পড়ে। নির্যাতনের ধরণ এবং মাত্রাও ভয়াবহ আকার নিয়েছে। পিটিয়ে হাড়-গোড় ভেঙ্গে দিচেছ, শরীর পুড়িয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে, কেউ বা আবার নানারকম ভয়-ভীতির কারণে নিজের পিতা, বা পিতাসম কারো দ্বারা বছরের পর বছর ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কেউ প্রেম করলেও প্রেমিক ও তার সঙ্গীদের দ্বারা গণর্ধষণের শিকার হচ্ছে, আবার প্রেমে অসম্মতি জানালেও ক্রোধের শিকার হয়ে ধর্ষণের শিকার হচেছ। এ যেন উভয় সঙ্কট! আর এই ধরনের উপুর্যপরি নির্যাতন, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের কারণে রীতিমতো আতংক শুরু হয়েছে এই পুরো সমাজে!

গত ১ জুলাই ২০১৭, বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক রিপোর্টে দেশের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তা প্রতীয়মান হয়। এতে দেখা যায় যে, গত ছয় মাসে ২৮০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৬ জনকে, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে ২৩ জন নারী। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩৪ জন নারী। যৌতুকের দাবিতে ১৪৩ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫৮ জন। যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয়েছে ৬৮ জনকে, আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ৬ জন। এচাড়া যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৫৮ নারী। এর মধ্যে তিনজন নারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ৯৫ নারী ও পুরুষ। সালিশ  ও ফতোয়ার শিকার হয়েছেন চারজন নারী, এসিড সন্ত্রাসের আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ জন নারী। গৃহকর্মি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২২ জন। এর মধ্যে চারজন মারা গেছে, একজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং সাতজনের রহস্যজনক মৃত্যু।

এই রিপোর্ট অনুযায়ী (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১ জুলাই) সারাদেশে শিশু হত্যা ও নির্যাতনের সংখ্যা ছিল আশঙ্কাজনক। এতে দেখা যায়, বিগত ছয় মাসে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে ৬২৯ শিশু। এর মধ্যে খুন হয়েছে ১৩২ শিশু, আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে ৩৭ জন শিশু। এছাড়া নিখোঁজের পর ১৮ জন এবং বিভিন্ন সময়ে আরও ৪৪টি শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ১৫ জন শিশুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।

আমার লেখাটির উদ্দেশ্য সংখ্যাগুলোকে তুলে ধরা না, কারণ এগুলো আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই লেখার মধ্য দিয়ে আমার কিছু জিজ্ঞাসা এখানে তুলে ধরতে চাই, আর তা হলো মানুষ এতো সাহস পায় কোত্থেকে? মানুষের মূল্যবোধ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? কেন মানুষের নিষ্ঠুরতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়ে যাচ্ছে? এমনকি কেউ কেউ ঘটনার ভিডিও করে তা প্রকাশ্যে ছেড়ে দিতেও কুন্ঠাবোধ করছে না। এতো সাহস আসে কোত্থেকে? দেশে তো আইন আছে তাহলে মানুষ বিনা চিন্তায় বিনা ভয়ে প্রকাশ্য দিবালোকেও কোন নির্যাতন, হত্যা এমনকি ধর্ষণ করতেও ভয় পাচ্ছে না, কেন? নাকি সমাজের মানুষগুলো ধরেই নিয়েছে যে, ’যার যা ইচ্ছা সে তাই করবে কারণ সমাজের অন্য কেউ তার কিচ্ছুটি করতে পারবে না’, ….কেন এতো সাহস?

কিছুদিন আগে অন্য আরেকটি মাধ্যমে একটি খবর দৃষ্টিগোচর হয় যে, মিরপুরের উবার এর এক চালক একজন নারী আরোহীকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল, এবং বলেছিল যে, স্থানীয় কমিশনার তার বন্ধু, সুতরাং কেউ তার কিচ্ছু করতে পারবে না। একইভাবে আমিন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে যখন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির মেয়েগুলোকে নির্যাতন করছিল, তখন সেও বলেছিল যে, তোদেরকে  (মেয়েগুলোকে) যদি আমি মেরেও ফেলি, তবে কেউ আমাদের কিচ্ছু করতে পারবে না। এখন প্রশ্ন হলো, এই যে ”কিচ্ছু করতে পারবে না” এই কথাটি বলার মতো এতো সাহস আর বুকের পাটা একজন ড্রাইভার থেকে শুরু করে একজন ধনীর দুলালের হয় কেমন করে?

আমরা জানি বাংলাদেশে শিশু ও নারী নির্যাতন রোধে কঠোর আইন রয়েছে, তবুও অপরাধ কমছে না। বরং দিন দিন, বছরের পর বছর অপরাধ বেড়েই চলছে। কেন? বিচার-বিলম্বের কারণেই দেশে ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকগণ। তাদের মতে, স্বল্প সময়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সমতাভিত্তিক আইনি নীতি বাস্তবায়িত হলেই এই সহিংসতা কমবে (আমাদের সময়, ৯ মে, ২০১৭)।

অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এক সাক্ষাতকারে বলেন যে, দেশের ৯৫ শতাংশ ধর্ষণের মামলাগুলোর বিচার হচ্ছে না। এমনকি আসামিরাও জামিন নিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে, আবার অনেক মামলার আসামি গ্রেফতারই হচ্ছে না। তাই এই সহিংসতা নিরসনে তিনি মনে করেন যে, অপরাধী যেই হোক না কেন তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৯ মে ২০১৭)।

পরিশেষে বলতে চাই, শুধু আইন থাকলেই হবে না বরং এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় নারী – পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে শক্ত হাতে। সর্বোপরি স্বল্প সময়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবেই, হবে। আর এটা নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা একটি সুস্থ, সুন্দর সমাজ পাবো এবং পাবো একটি নিরাপদ রাষ্ট্র।

জেরিনা শাবনাজ আক্কাস, পিএইচডি: গবেষক-জেন্ডার বিশেষজ্ঞ

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.