প্রান্ত পলাশ:
ভারতের মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গাবাদ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই অজন্তা-ইলোরা গুহা। গুহার দেওয়াল কেটে তৈরি চোখ ধাঁধানো অপরূপ নিদর্শন দেখতে হাজারও মানুষ ভিড় করেন সেখানে। নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন ওই চমকপ্রদ স্থাপত্যশৈলী দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিমানবন্দরে নামার আগেই হাজারও মৌলবাদির ভিড়। তাদের হাতে হাতে ‘গো ব্যাক তসলিমা’। উগ্র-বিদ্বেষী স্লোগান। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে পুলিশও তাঁকে বাধা দেয়। আর তাঁকে মুম্বাইয়ে ফিরে যেতে হয় গুহাদর্শন ছাড়াই। কিন্তু বারবার কেন তাঁকে ফিরে যেতে হবে?
এই ক’দিন আগে, ২৯ জুলাইয়ের ঘটনা এটি।
এ বছরের শুরুর দিকে রাজস্থানের জয়পুর লিট ফেস্টে প্রথমবারের মত আমন্ত্রণ জানানো হয় তসলিমা নাসরিনকে। নিরাপত্তার ‘কারণ’ দেখিয়ে প্রোগ্রাম লিস্টে তাঁর নামও উল্লেখ ছিল না। আগের রাতেই তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তিনি যেন ঠিক তাঁর অনুষ্ঠানের দু’ মিনিট আগে ফেস্টিভ্যালে যান এবং অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। কিন্তু হায়, এতসবের পরেও, কিছু অশিক্ষিত মৌলবাদি তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। নিষিদ্ধের দাবি তোলে। আর ওই বর্বরদের দাবি মেনে নিয়ে আয়োজকেরা তাঁকে নিষিদ্ধ করে। উৎসব পরিচালকেরা ‘নাকে খত’ দিয়ে মৌলবাদিদের সামনে ‘হাত জোড়’ করে বলেন, ‘মাথা পেতে মেনে নিচ্ছি আপনাদের ডিমান্ড, প্রতিজ্ঞা করছি আমরা আর কখনও তসলিমাকে জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে আমন্ত্রণ জানাব না।’
বাহ্ কী চমৎকার!
আওরঙ্গাবাদে ওই বিক্ষোভে উসকানি দেন উগ্রবাদী দল এআইএমআইএম–এর বিধায়ক ইমতিয়াজ জলিল। তসলিমা নাসরিন যে হোটেল বুক করেছিলেন তার সামনে তিনি সাঙ্গপাঙ্গ জড়ো করেন। সাঙ্গপাঙ্গ জড়ো করেন বিমানবন্দরের সামনেও। তারা ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ বলে রোষ দেখায়। ‘গো ব্যাক তসলিমা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয় বিমানবন্দর ও হোটেলের আশপাশ। বিধায়ক ইমতিয়াজ জলিলের হুঙ্কার : ‘আমাদের শহরের মাটিতে তসলিমাকে এক কদমও ফেলতে দেব না।’ কারণ তসলিমা নাসরিন না কি তথাকথিত ইসলামানুভূতিতে আঘাত হেনেছেন আর তা বিশ্বজুড়ে মুসলিমমানসে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। আমরা জানি, এ অজুহাত নতুন নয়, বহু পুরোনো। কিন্তু পুলিশের কী কাজ? তারা কেন বর্বর মৌলবাদিদের কাছে বারবার পরাস্ত হবে? পুলিশ কেন তাঁকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না? পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের জন্য এ কি লজ্জা নয়?
জয়পুরে লিট ফেস্টে নিষিদ্ধের পর তসলিমা নাসরিন লিখেছিলেন : ‘সবকিছুর একটা সীমা আছে। আমাকে নিষিদ্ধ করার, মনে হয়, কোনো সীমা নেই। দেশ নিষিদ্ধ করে, রাজ্য নিষিদ্ধ করে, রাজনীতিক নিষিদ্ধ করে, প্রকাশক নিষিদ্ধ করে, সম্পাদক নিষিদ্ধ করে, বইমেলা নিষিদ্ধ করে, সাহিত্য উৎসব নিষিদ্ধ করে। চারদিকে নিষিদ্ধ আমি। অনেক কাল আমি একঘরে, অনেক কাল যুদ্ধ করছি বাকস্বাধীনতার জন্য। বারবার হেরে যাচ্ছি। যদিও বলি তলোয়ারের চেয়ে কলম শক্তিশালী, কিন্তু শেষ অবধি দেখি জয় তলোয়ারেরই হয়, কলমের নয়।’ এ বেদনা আমাদের সবার। এ লজ্জা পৃথিবীর প্রত্যেক স্বাধীনচেতা মানুষের।’
কিন্তু এই যে এতক্ষণ ভারতকে একহাত নিলাম, বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিশেবে তার লজ্জার কথা বললাম, এই কথাগুলো কি একজন বাংলাদেশি হিশেবে আমার মুখে মানায়? না, এতখানি মানায় না! ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মৌলবাদিদের আন্দোলনের মুখে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হন তসলিমা নাসরিন। আজ প্রায় ২৪ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত। কোনো সরকারেরই তাঁকে নিয়ে রা নেই। আমরাই বা কী করেছি তাঁর জন্য? আমরা কি রুখে দিতে পেরেছি মৌলবাদিদের? না, পারিনি। আমরা তাঁর জন্য কিছুই করতে পারিনি। বাংলাদেশের জন্য এ বড় লজ্জার। যে চেতনা নিয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, অনেক প্রাণের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম, সেই দেশ দিনে দিনে হয়ে উঠেছে মৌলবাদিদের আখড়া। আর এইসব মূর্খ-বর্বরদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে সব সরকার। অন্য দেশগুলোর সবাই জানে, এখন বাংলাদেশে তথাকথিত ‘সেক্যুলার’ আওয়ামী লীগ দল রাষ্ট্রক্ষমতায়। তাঁরাও কি তসলিমা নাসরিনকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো রকম উদ্যোগ নিয়েছে? না, নেয়নি, নেবে বলে আশাও করি না।
দিনে দিনে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই দলটি আজ মৌলবাদিদের সাথে আপোস করছে, নারীকে ‘তেঁতুল’ বলে ধৃষ্টতা দেখানো হেফাজতের আমির শফি হুজুরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মৌলবাদিদের কথায় পাঠ্যপুস্তক থেকে মুক্তমনা লেখকদের লেখা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, মাধ্যমিকে চারুকলা বিষয়টি বাতিল করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে থেমিসের ভাস্কর্য সরানো হয়েছে— এসব কি আমাদের জন্য লজ্জার নয়? মৌলবাদিদের জন্য বাংলাদেশ প্রতিকূল না হয়ে স্বর্গরাজ্য হচ্ছে।
এ বছরের এপ্রিলে ভারতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তসলিমা নাসরিন তখন ভারতে ছিলেন। সে সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তসলিমা টুইটারে বলেন, ভারত সফর চলাকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁকে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।
টুইটে তসলিমা নাসরিন বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি আসছেন। আমাকে কি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দেওয়া হবে? অবশ্যই না। তিনি কি ২৪ বছর ধরে আমাকে আমার দেশে প্রবেশে বাধা দেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন? হ্যাঁ, তিনি দিয়েছেন।’ তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘কেউ চায় না আমি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করি ও প্রশ্ন করি, আপনি কেন আমাকে আমার দেশে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না?’
আমরা ভেবেছিলাম, হয়ত প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎ দেবেন। তসলিমা নাসরিনের নির্বাসিত জীবনের অবর্ণনীয় কষ্টকথা শুনবেন। কিন্তু না, সে আশায় গুঁড়েবালি। দেখাই মিলল না আর তাঁর দেশে ফেরা!

তসলিমা নাসরিনকে নিষিদ্ধ করা এতো সহজ! তাই তিনি আওরঙ্গবাদে অজন্তা-ইলোরা দেখতে পারেন না। শুনেছি, ৩৪টি গুহা নিয়ে নির্মিত ইলোরায় শুধু বৌদ্ধ নয়, রয়েছে সনাতন ও জৈন ধর্মের মন্দির। ইলোরাকে বলা হয় তৎকালীন ‘ধর্মীয় সংযোগস্থল’। ভিন্নধর্মের মানুষের মধ্যকার ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও একতার পরিচায়ক ওই মন্দিরগুলো। কিন্তু হারানো সেই সহিষ্ণুতা বাধা হয়ে দাঁড়ালো তসলিমার ইলোরা দর্শনে। তাঁকে ফের ফিরে যেতে হলো।
আনন্দবাজার পত্রিকায় অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘সভ্যতার দুর্বলতা ছাড়া আর কিছু বলতে পারছি না একে… নিদারুণ উগ্রতা, কট্টর মৌলবাদ, তীব্র অসহিষ্ণুতা, ঘৃণার রাজনীতি, বিদ্বেষের কারবার— কারণগুলো আমাদের জানাই। এই কারণগুলোই আগেও পথ আটকেছে লেখিকার, এই কারণগুলোই তাঁকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে, এই কারণগুলোই তাঁকে বার বার ঠাঁইনাড়া করেছে। তবু এর নিবারণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। একে আমাদের সভ্যতার দুর্বলতা ছাড়া আর কোন নামেই বা ডাকা যেতে পারে?’
হ্যাঁ, ‘সভ্যতার দুর্বলতা’ ছাড়া আর কিছু আমিও ভাবতে পারছি না। এই দুর্বলতা কাটিয়ে কবে আমরা সভ্য হব? হায়েনার মত একজন লেখকের ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়ে কবে আমরা লেখার প্রতিবাদ লেখা দিয়ে করবো?
লেখক : কবি ও সাংবাদিক