আসমা খুশবু:
এগারো বছর আগে ‘মাসিক একাত্তর’র অফিসে নাহিদ আপা প্রশ্ন করেছিলেন, কী লিখতে চাও? খুব শক্ত আর বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলাম, ‘নারী যে নারীর শত্রু’ এসব নিয়ে লিখবো। উনি রেগে গিয়ে বললেন, কেন এটা মনে হলো? উত্তরে পারিবারিক ভায়োলেন্সের শিকার শাশুড়ির কাছে বউ— এমন একটি উদাহরণ দিয়েছিলাম। উনি বললেন, পড়াশোনা করো। নারীবাদ, পুরুষতন্ত্র নিয়ে পড়ো, তারপর নারীদের নিয়ে লেখার সাহস করো।

ওই বিখ্যাত লেখকের লেখায় খুব সাহস করে একখানা কমেন্ট লিখেছিলাম, যে শাশুড়ি এই আচরণ করেছেন, তিনি পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বকারি কি না, তার আচরণের প্রধান কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা মূল কারণ কি না— এসব উল্লেখ করেছিলাম। তো এই প্রশ্ন সম্বলিত একটি কমেন্টের বিপরীতে একশ নয়টি কমেন্ট পড়েছিল ওইদিন। বলতে গেলে, ওই একশ কমেন্টই ছিল ব্যক্তি আক্রমণ, কটাক্ষ। তিন-চারজন নারী বলেছিলেন পক্ষে, বাকি প্রত্যেকে বিপক্ষে— এর মধ্যে নারীরাও কম যাননি!
লেখক নিজেই রেগে গিয়ে বলেছিলেন, সব জায়গায় পুরুষতন্ত্র খুঁজে পাই কেন? যেসব নারী বিরোধিতা করে ব্যক্তি আক্রমণ করেছিলেন, তাঁদের আমার শত্রু মনে হয়নি। ওঁরা আসলে জানেনই না, অজান্তেই নিজের অস্থি-মজ্জায় পুরুষতন্ত্র ধারণ করছেন।
মোদ্দাকথা, আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষই জানেন না পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের পার্থক্য। পুরুষতন্ত্রের সাথে পুরুষ শব্দটি জড়িত বলে তাঁরা ধরেই নেন যে সকল নারী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তোলেন, তাঁরা বোধহয় তাঁদের বিরুদ্ধেই বলেন। আজকাল আবার নতুন টার্ম যোগ হয়েছে— শহুরে নারীবাদ, কিটিবাদ ইত্যাদি। আরও কত কী!
আপনি নারীর প্রতি হওয়া বৈষম্য নিয়ে কথা বলেন, আর আপনি বাস্তব জীবনে অসুখী, স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ, ডিভোর্সি (আপনি ভালো নারী নন, সংসারে কম্প্রোমাইজ করতে পারেননি)। কাজেই নারী, যাঁরা নারীমুক্তির পক্ষে কথা বলেন, তারা ভালো নারী নন, তাঁদের থেকে দূরে থাকা উত্তম, নইলে ভালো নারীও খারাপ হয়ে যেতে পারে। এর থেকে ভালো, যেসব পুরুষ ভালো ভালো কথা বলেন, ভেতরে পুরুষতন্ত্র আর বাইরে নারী নির্যাতনের বিপক্ষে থাকেন তাদের সঙ্গে বসে চা-সিঙারা খেয়ে নারীবাদীদের পিণ্ডি চটকানো!
গত রোববার ছিল ‘ব্ল্যাকআউট ফর উইমেন টুডে’। আমি যখন ইনবক্সে ম্যাসেজটি পেয়েছি, সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই ক্যাম্পেইনের সঙ্গে থাকার। তখনও জানি না এর উৎস কোথায়, কারা এর উদ্যোক্তা। যেটা মনে হয়েছে— কে, কোথা থেকে এই উদ্যোগের ডাক দিয়েছেন তা জানার দরকার নেই, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি মানুষও যদি কোন ইভেন্টের ডাক দেন, বিনা প্রশ্নে কারও কোনো ক্ষতি না করে সেই ইভেন্টে আমি একাত্মতা প্রকাশ করবো।
সবচেয়ে আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয়, ফেসবুক সেলিব্রেটিদের বেশ বড় একটা অংশ এই প্রোপিক বদলাবার বিষয়টিকে নিয়ে খুব তামাশা করেছেন। নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ইস্যুতে এগিয়ে আসা এই সকল পুরুষ খুব গভীরে যে পুরুষতন্ত্র লালন করেন, তা আর চেপে রাখতে পারলেন না। আর সমাজের একটা বড় অংশের কাছে তাদের দ্বারা যে ম্যাসেজটি পৌঁছালো তা আদতে ক্ষতিকরই। কারণ যাঁরা এই ধারণায় বিশ্বাসী তাঁদের বিশ্বাস আরও গভীর হলো। বিষয়টি এমন, সব পুরুষ এক নয়, কিন্তু সব পুরুষের চিন্তার শেকড়েই পুরুষতন্ত্রের বীজ বপন করা, শত শিক্ষাও তাঁদেরকে পরিবর্তন করতে পারবে না, যদি না নিজেরা উপলব্ধি করেন।
পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহক একজন পুরুষ যেমন হতে পারেন, একজন নারীও হতে পারেন। ব্যক্তিপুরুষ আর পুরুষতন্ত্র এক নয়। পুরুষতন্ত্র একটি সামাজিক ব্যবস্থা, দুর্বলের উপর সবলের ক্ষমতা প্রয়োগ। নিজের ছেলেসন্তানটিকে শেখানো হয় মেয়েসন্তানটিকে মারা যাবে না, কারণ মেয়ে দুর্বল। এটা পুরুষতন্ত্রের শিক্ষা। মেয়েকে শেখানো হয় মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটবে, পোশাকে সচেতন থাকবে, রাতে বাইরে বের হবে না, রাস্তায় ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়েও চুপ থাকবে, ঘরে আত্মীয়ের হাতে নির্যাতিত হয়েও চুপ থাকতে হবে, শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিত হয়েও চুপ থাকতে হবে, বাচ্চার দেখাশোনা ঠিকমতো হচ্ছে না, রান্না ঠিকমতো হচ্ছে না, চাকরি ছাড়তে হবে মেয়েটিকে, ধর্ষিতা মেয়েটির ‘নষ্টা’ খেতাব পেয়ে আত্মহত্যা— এ সবই পুরুষতন্ত্র। এই চেতনা আমাদের বেশিরভাগ নারী-পুরুষের মগজে-মননে, চেতনে-অবচেতনে।
নারীর শারীরিক গঠনকে দুর্বল ভেবে পুরুষের তাঁর উপর প্রভুত্ব নির্ধারণ করার মানসিকতা পুরুষতন্ত্রের অংশ। নারী যখন সন্তানকে লিঙ্গবৈষম্যের শিক্ষা দেন, নারী যখন মেয়ে ও বউমার সাথে ভিন্ন আচরণ করেন, তখন পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিষ্ঠা করেন। এর শেকড় এত গভীরে যে, যুগযুগ ধরে ক্ষমতাবানদের দ্বারা এই বীজ বপন হয়েছে, আর তার প্রতিপালন করেছেন নারী-পুরুষ উভয়ই। আর এখন তা মহীরূহ হয়েছে। একজন নারী আরেকজন নারীকে দমিয়ে রাখলে সেটা শত্রুতা থেকে করেন না, করেন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে। এই চর্চায় পুরুষতন্ত্র আরও শক্তিশালী হয়। নারীর এমন আচরণের পেছনে অশিক্ষা, অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা অনেকাংশে দায়ী।
যে দেশে পুরুষতন্ত্র বললে সমগ্র পুরুষজাতি বেদনা অনুভব করে, নিজেদের অধিকারের কথা বললে নারীকে পুরুষবিদ্বেষী বলা হয়, একজনকে আরেকজনের মুখোমুখি প্রতিযোগিতায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, সেই সমাজে পুরুষকে বাইরে রেখে পুরুষতন্ত্র ভাঙার কথা ভাবা যায় না। যে অশিক্ষা, জীবনাচার, অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নারী, সেই একই কারণে পুরুষতন্ত্রের কানাগলি থেকে পুরুষও মুক্ত হতে পারছেন না। সমান ও ন্যায্য লিঙ্গসম্পর্ক তৈরি করতে হলে নারী-পুরুষ উভয়কেই পরিবর্তিত হতে হবে।
নারীকে নারীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিতে পারলে হাততালির কানফাটা শব্দ শোনা যাবে, কিন্তু আদতে সমাজের কোনো পরিবর্তন হবে না। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুধু নারীকেই অধীনস্ত করে রাখেনি, পুরুষকেও পরাধীন করে রেখেছে। এই সত্য পুরুষরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারবে, তাতে নারী-পুরুষ উভয়েরই মঙ্গল। আজকের নারী তাদের বিরুদ্ধে হওয়া বৈষম্যের বিরুদ্ধে যখন কথা বলা শুরু করেছেন, তখন সহজ অস্ত্র ‘নারীই নারীর শত্রু’ ব্যবহার করে, একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে না দাঁড় করিয়ে পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে আসুন। তারপর মুক্তির কথা বলুন, আমরা শোনার জন্য কান পেতে থাকব।
শেয়ার করুন: