শারমিন শামস্:
বগুড়ায় এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েটিকে ধর্ষণ, প্রতিবাদ করায় গণধর্ষণ এবং শেষে মা ও মেয়েকে মেরে, মাথা মুড়িয়ে দেবার ঘটনার ধাক্কাটা সামলে নেবার চেষ্টা করছি যখন, তখন ঢাকার বাড্ডায় পৌনে চার বছরের বাচ্চাকে ধর্ষণ করে হত্যার সংবাদটি পেলাম।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তখন প্রগতিশীলরা ব্যস্ত নারীবাদীদের সমালোচনায়। নারীবাদকে তারা মনে করেন আল্ট্রা মডার্ন নারীদের সময় কাটানোর মাধ্যম। তারা নারীবাদ চর্চাকে এইভাবে কুৎসিত সমালোচনা করে নিজের মূর্খতাকে আরও প্রকট করে তোলেন। সঙ্গে কিছু সাঙ্গপাঙ্গ জুটে যায়। তারা নারীবাদ, নারী স্বাধীনতার আন্দোলনকে নানাভাবে অশ্লীল, অভব্য শব্দবাণে আহত করে আঘাত করে নির্মল আনন্দ পেতে থাকেন। তাতে আসলে কিছুই এসে যায় না এই বিচারহীন সমাজের। এখানে যা ইচ্ছে তাই করা চলে। নিতান্ত দুধের শিশুকে পুরুষাঙ্গের উৎপাতে রক্তাক্ত হয়ে মরে যেতে হয়। তখন এই আল্ট্রা মডার্ন নারীবাদীদেরই কলম ধরতে হয়, চিৎকার চেঁচামেচি করে শোরগোল তুলে জানান দিতে হয়, চাপ সৃষ্টি করতে হয়, এবং তাতে আসামি গ্রেফতার হয়।
খবর পেলাম, বাড্ডায় শিশু তানহার ধর্ষক ও হত্যাকারী শিপনকে পুলিশ ছয় ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করেছে। পুলিশের কাছে এই ধর্ষক জানিয়েছে, শিশুটিকে খাবারের লোভ দেখিয়ে টান মেরে ঘরে ঢুকিয়ে তাকে ধর্ষণ করেছে সে। এতে শিশুটির রক্তে কাপড়চোপড় ভিজে গেলে সে বাচ্চাটার গলা টিপে মেরে ফেলে লাশ টয়লেটে ফেলে দেয়। আর রক্তমাখা কাপড় ভিজিয়ে রাখে বালতিতে।
বাহ! ঠাণ্ডা মাথার পিডোফাইল। দিনমজুরের কাজ করতো লোকটা। বয়স ত্রিশের মতো। গালে দাড়ি, সাধারণ চেহারা, দেখে বোঝার উপায় নাই এর অন্তরের বিকৃতি। এরা মিশে আছে আমাদের মধ্যেই। আমরা যারা সমাজের অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থায় আছি, তারা চেষ্টাচরিত্র করলে কিছুটা হয়তো নিরাপদে রাখতে পারি আমাদের শিশুদের। কিন্তু যারা নিতান্ত বস্তি এলাকায় বাস করেন, যাদের সন্তানদের দেখে রাখবার কেউ নেই, তাদের জন্য এই পিডোফাইলরা ওঁৎ পেতে থাকে। কারণ শিশুকে কব্জা করাই সবচেয়ে সহজ।
ধর্ষক খুনি শিপনকে দ্রুত ধরা গেছে। কিন্তু আমি জানি না শিশু ধর্ষণ ও হত্যার এই মামলা কতদিন ধরে চলবে! আর শেষে কী বিচার পাবে শিশু তানহার পরিবার!
আমি অনুভব করতে চেষ্টা করি সেই মায়ের কষ্ট, যে মা দীর্ঘ নয় মাস কোনো শিশুকে গর্ভে ধারণ করে, তারপর এক অসম্ভব যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়ায় তাকে জন্ম দিয়েছিলেন পৌনে চার বছর আগে। এরপর তিলতিল করে বড় করে তুলছিলেন শিশুটিকে বুকের দুধে, স্নেহে, মমতায়, আদরে। সেই বুকের ধনের কচি শরীরের রক্ত সেই মাকে কী অনুভূতি দিয়েছিলো, আমি খুব ভাবতে চেষ্টা করি! ভাবনা আগায় না। যে শিশুর যোনি এই সমাজে একটি লোভাতুর বস্তু হয়ে উঠছে দিন দিন, সেই সমাজে আর কোন মা কীভাবে নিশ্চিন্ত মনে কোনো সন্তান জন্ম দেবেন, আর কেনই বা দেবেন, সেই চিন্তাটাই মাথায় আসে।
আমার পরিচিত বন্ধু, সহকর্মী, স্বজনরা বাড্ডার এই ঘটনায় খুব কষ্ট পাচ্ছেন। একজন বললেন, কেন এভাবে শিশু ধর্ষণ বাড়ছে? কী হলো এই সমাজটার?
আমি খুব অবাক হলাম তার বিস্ময়মাখা প্রশ্নে। এই সমাজ কি হঠাৎই এমন হয়েছে? যুগ যুগ ধরে এই সমাজ কি এমনই কুৎসিত, ক্লেদাক্ত নয়?
ঘর থেকে রেব হওয়া মাত্র এই সমাজ আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমি মেয়ে। আমার শরীরে কোথায় কতটুকু বেরিয়ে আছে, সেটুকু চোখ দিয়ে গিলে খেতে চায় তারা। সেই চাহনিতে এতোটুকু লজ্জা নেই, গ্লানি নেই। সব শ্রেণি, সব বয়সের পুরুষই এই চাহনি হানতে থাকে। পথে-ঘাটে অশ্লীল কটুক্তি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
এমন কোনো মেয়ে নেই যে পথ চলতে আজেবাজে কথার শিকার হয়নি। অফিসে, বাজারে, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যখন তখন যৌন হয়রানি অতি সাধারণ একটা ব্যাপার এই দেশে। এই তো আমাদের সমাজে এক শ্রেণির পুরুষের যৌনতার অবদমিত রূপ। তাদের কুৎসিত মনোজগতের একটি প্রকাশ। এই পুরুষরা ততক্ষণই ধর্ষক হয়ে ওঠে না, যতক্ষণ তারা সুযোগ পায় না। সুযোগ পেলে এই চাউনিহানা, গায়ে নোংরা হাত রাখা, কুৎসিত উক্তি করা পুরুষরা কি ছেড়ে দেবে কোন মেয়েকে? এখন একজন পূর্ণবয়স্ক মেয়েকে সে যদি কোনো কারণে কব্জা করতে না পারে, সে হাত বাড়াবে শিশুর দিকেই। কারণ শিশুকে ধর্ষণ করতে কোন বেগ পেতে হয় না।
আমরা যতই সন্তানকে দেখে রাখবার চেষ্টা করি, আমরা যতই সতর্ক থাকি না কেন, এই দারিদ্র্য পীড়িত দেশে পিডোফাইলদের হাত থেকে শিশুদের রক্ষা করা খুব কঠিন। যেহেতু এই দেশে বিচার এক সোনার হরিণ, আইনের ফাঁকফোকর গলে অপরাধীর পার পেয়ে যাবার নজির শত শত, টাকা দিয়ে জামিন পেয়ে বিচার এড়িয়ে যাওয়ার উদাহরণই বেশি, তাই এই দেশে পিডোফাইলদের উদ্দীপনা দিন দিন আরো বাড়বে।
ধর্ষকদের মহোৎসব তো শুরু হয়ে গেছে সেই কবেই। এই উৎসব থেমে যাবে না এতো সহজে। সরকারের বিস্ময়কর নীরবতা আমাদের কোনো আশার আলো দেখায় না। কোনো কঠিন কঠোর আইন আসবে কী না আমরা কিচ্ছু জানি না। দ্রুত বিচার আইনে অপরাধীদের শাস্তিদান শুরু হবে কি না, জানি না। শুধু জানি, ধর্ষণ চলছে, চলবে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা আমাদের চমকে থমকে দেবে। আমরা স্তব্ধবাক হয়ে বসে থাকবো। আমাদের সন্তানদের বুকে জড়িয়ে নেব। নিজেরা অশুভ চিন্তা বুকে ধরে পথ চলবো।
কারণ এদেশে ধর্ষকেরা ক্ষমতাবান। এবং ক্ষমতাবানেরা ধর্ষণ করে ক্ষমতাকে সেলিব্রেট করে। তাই ক্ষমতাসীন দলে তুফান জন্মায়। ধর্ষিতার মাথা মুড়ে তারা তার বিচার চাওয়ার পাওনা মিটিয়ে দেয়। কারণ ধর্ষক জানে, ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির সামনে নারী নির্যাতন নিতান্ত মামুলি একটি বিষয়। আর ধর্ষক শিপন জানে, পুরুষের ক্ষমতা তার পুরুষাঙ্গে কেন্দ্রীভূত। আর তা দিয়ে সে যত্রতত্র নারী ও শিশুকে ধরাশায়ী করবে, এতে দোষের কিছু নেই।
এদেশে ধর্ষণ চলবে, এই মহামারী থামবে না। যদি থামারই হতো, তবে হযরত আলী ও আয়েশার ঘটনার পর নড়েচড়ে বসতো সরকার, পূজার বীভৎস ধর্ষণের পর সক্রিয় হতো আইন ও বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন। তা হয়নি। কী হয়েছে তবে?
ধর্ষণের বিচারে গণধর্ষণ আর মাথা মুড়িয়ে দেবার উদাহরণটি তৈরি হয়ে গেল। এরপর একসময় তুফান হারিয়ে যাবে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার জটাজালে। কিন্তু ধর্ষক সমাজের মনের ভিতরে ধর্ষিতাকে শাস্তি দেবার আকাঙ্ক্ষাটি নানাভাবে বাস্তবায়িত হতে থাকবে। আর সরকার ভাববে, ধর্ষণের মতো মামুলি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় তাদের নাই। এই মূল্যবান সময়টি বরং তারা উন্নয়নকর্মে নিয়োগ করতে পারবেন।
হায় আমার সমাজ, হায় আমার রাষ্ট্র! নারীত্বের যে দায় নিয়ে আমি জন্মেছি এই দেশে, সেই দায় শুধতে হবে আমাকেই। যোনির ক্ষত আর মৃত্যু দিয়ে।
একটি ধর্ষকামী রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তুলতে পরার এই সফলতা- এটি যেন তেন কোন ব্যাপার নয় মোটেই। আপনাদের অভিনন্দন!