পাপ্পন দাস (করিমগঞ্জ, অসম থেকে):
সভ্যতা আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা আমরা সবাই খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছি। বস্তুত মানব জাতি ধীরে ধীরে যে সভ্যতাকে আয়ত্ব করেছিল, তা আজ কোথাও যেন হারিয়ে গেছে।

আমার এই প্রিয় লেখিকা তসলিমা নাসরিন আরও একবার উগ্রদের জন্য আটকে গেলেন। মহারাষ্ট্রের এক বিমানবন্দরে তিনি নেমেছিলেন। কোথাও ঘুরতে যাবেন। কিন্তু বিমানবন্দরেই আটকা পড়লেন। এর চৌহদ্দি ছাড়িয়ে শহরে পা রাখতে পারলেন না তিনি। তারপর কী হলো? আবার তাকে ফিরে যেতে হলো। ধর্মান্ধদের কাছ থেকে অবশ্য এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। তারা তো উগ্রই। তাই তাদের কাছ থেকে একমাত্র পাওনা হলো নিদারুন উগ্রতা। তারা কট্টর এবং মৌলবাদী। তাই তাদের কাছ থেকে একমাত্র পাওনা হলো কট্টর মৌলবাদ।
সহিষ্ণুতা নামক কোনও বস্তু তাদের ডিকশনারিতে নেই। তাই তাদের কাছ থেকে তীব্র অসহিষ্ণুতা ছাড়া অন্য কিছুর প্রত্যাশাও অন্যায়। তারা ভালোবাসতে জানে না। তাই তাদের কাছ থেকে ঘৃণা ছাড়া আর কী পাওয়া যেতে পারে! এই ঘৃণা আর বিদ্বেষ নিয়েই তো তাদের সব কামকাজ। আর এসব নতুন কিছু নয়। খুব ভালোভাবেই আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি। কারণগুলোও আমরা খুব ভালোভাবেই জানি। সেগুলো হল—ধর্মের ভুলত্রুটিগুলোকে তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সবার সম্মুখে তুলে ধরেন।
এই কারণগুলোই আগেও অনেকবার তাঁর পথ আটকেছে, এই কারণগুলোই তো তাঁকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে, এই কারণগুলোর জন্যই নিজের দেশ ছেড়ে কখনও ইউরোপ, কখনও আমেরিকা, কখনও ভারতে তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে।দশকের পর দশক ধরে তিনি নির্বাসনে। অবশ্য এই কারণগুলোই তাঁকে বার বার মাথা তুলে দাঁড়াতেও সাহায্য করেছে।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আমার চোখ চলে যাচ্ছে। সেদিন সর্বভারতীয় এক নিউজ চ্যানেলের প্যানেলিস্টে থাকা এক উগ্র মৌলবাদীর কথা যারা যারা শুনেছেন, নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পেরেছেন যে, মাদ্রাসায় ভালো কোনও শিক্ষা হয় না—শুধুমাত্র নারীর অসম্মান, ধর্মের বড়াই আর ধর্মের ধ্বজাধারী হয়ে মানবতাবাদীদের অপমান করো, এমনটাই শেখানো হয়। যারা দেখেছেন, নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পেরেছেন যে, ধর্মের ধ্বজাধারী মোল্লারা নারীর সম্মান কীভাবে করতে হয়, তা জানে না। আসলে এই সুস্থ সমাজে তাদের কোনও স্থান নেই। কখনই তারা পুরুষ আর নারীকে সমান চোখে দেখে না। নারী নিয়েই তাদের যত আপত্তি।
ইসলাম বুঝি তাদের এই শিক্ষা দেয়? মেয়েদের দেখলে তাদের গা ‘ছমছম করে’। তাদের চোখে যে নারী সত্যি কথা বলে সে বেহায়া, তার চরিত্রে দাগ আছে। তাদের মতে, মেয়েদের লজ্জাবনত হওয়া উচিত। তারা মনে করে, মেয়েরা যদি পরনির্ভর না হয়, তা-হলে তা ভুল। তাদের মতে, মেয়েদের হওয়া উচিত শান্ত, ভিতু এবং এ জাতীয় কিছু। তাদের মতে মেয়েদের দু:সাহস থাকতে নেই। তারা মনে করে মেয়েদের দম্ভ, ক্রোধ এসব থাকতে নেই। তাদের মতে, মেয়েদের একটু অন্য ধরনের হওয়া উচিত। তারা মেয়েলি আর পুরুষালি স্বভাবের মধ্যে খুব পার্থক্য খুঁজে পায়। আর সবচেয়ে বড় কথা, যারা সব ধর্মের লোক একত্রে চলুক, এরকম কথা বলে, তাদের বিরুদ্ধে তারা ফতোয়া জারি করে।
আমি বলি কী, ভারতের মতো দেশের কোথাও এ জাতীয় মৌলবাদীদের (মোল্লা) স্থান নেই। তবে উগ্রতা এমন একটা বস্তু, যখন সেটা ধর্মীয় ভাবাবেগ, মিথ্যে দুশ্চিন্তা, অন্ধকারের পথে যাত্রা অথবা ধর্মীয় উন্মাদনার রূপ ধরে আসে, তখন তা সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
তবে তসলিমা নাসরিনই যে শুধুমাত্র উগ্র মৌলবাদীদের উগ্রতার শিকার হয়েছেন, ব্যাপারটা মোটেও এরকম নয়। এর আগেও অনেকে এর শিকার হয়েছেন। সব ধর্মের মধ্যেই কিছু উগ্র লোক থেকে থাকেন, এবং তারাই এ জাতীয় কর্মে সিদ্ধহস্ত। কখনও তাদের কবলে পড়েছেন বিখ্যাত লেখক সলমন রুশদি, কখনও তাদের উগ্রতার শিকার হয়েছেন শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন, কখনও শিকার হয়েছেন এম এম কালবুর্গি,কখনও ফরাসি পত্রিকা শার্লি এবদো এবং আরও অনেকে।
কী ঘটেছিল সেদিন? প্রবল বিক্ষোভের জেরে গত ২৯ জুলাই আওরঙ্গাবাদের চিকাল থানা বিমানবন্দরে নামার পরই মুম্বাইয়ে ফেরত পাঠানো হয় লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে। পুলিশ জানায়, মুম্বাই থেকে বিমানে চেপে সেদিন (শনিবার) সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ চিকাল থানা বিমানবন্দরে নামেন তিনি। সে সময় বিমানবন্দরের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন প্রায় কয়েক শ বিক্ষোভকারী। তাঁরা প্ল্যাকার্ড হাতে ‘তসলিমা ফিরে যাও’ স্লোগান দিতে থাকেন। এ অবস্থায় লেখিকা বিমানবন্দরের বাইরে বের হতে চাইলে তাঁকে বাধা দেয় পুলিশ। তাঁকে মুম্বাই ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।এবং অবশেষে তিনি তাদের কথা মেনে নেন।
আওরঙ্গাবাদ পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (জোন ২) রাহুল শ্রীরাম ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে বলেন, ‘মধ্য মহারাষ্ট্রে আইন ও শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা এড়াতেই তসলিমা নাসরিনকে পরবর্তী বিমানেই মুম্বাই ফেরত পাঠানো হয়। এখানে তিন দিন ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা ছিল তসলিমার। তিনি অজন্তা এবং ইলোরাতে ঘুরতে যাবেন বলেও ঠিক করেছিলেন। সেই কারণে আওরঙ্গাবাদের একটি হোটেলে দু’টি রুম বুক করাও ছিল। শনিবার বিকেল থেকে ওই হোটেলের বাইরেও বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন এক দল। এই গোটা বিক্ষোভ কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন দলের নেতা ইমতিয়াজ জলিল। যিনি আওরঙ্গাবাদ সেন্ট্রাল বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়কও।’
তাদের এই বিক্ষোভের পিছনে বক্তব্য ছিল, ‘তসলিমার লেখা গোটা বিশ্বের মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করেছে। তাই আমরা শহরের মাটিতে তাঁকে পা ফেলতে দেবো না।’
সত্যিই অবাক লাগে, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও উগ্র ধর্মান্ধরা আস্তে আস্তে তাদের বীজ শক্ত করতে সক্ষম হচ্ছে।সে-সব রক্তবীজরা আজ যেভাবে মুক্তচিন্তার গায়ে থু থু ছিটিয়ে দিচ্ছে,তা ভারতের মতো এই বিশাল দেশের জন্য দুশ্চিন্তার।আজই এদের পথ আগলে দাঁড়াতে হবে। সেজন্য আমাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে।
আরেকটি বিষয়, পুরস্কার ফিরত দলের লোকদেরও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, তারা আজ কেন চুপ? কেন তারা তসলিমা নাসরিনের সাথে হওয়া এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন না? তাই বলি কী, আসুন সবাই মিলে এই উগ্র ধর্মান্ধদের (পড়ুন মৌলবাদী) টুঁটি চেপে ধরি।
শেয়ার করুন: