একটি ডিভোর্স সারা জীবনের কান্না? নাকি নতুন জীবনের হাতছানি?

রাখি আক্তার:

সমসাময়িক সময়ে ডিভোর্স একটি স্বাভাবিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এক্ষেত্রে নারীরাও এগিয়ে এসেছে। এখন সময় এসেছে সম্পর্কগুলো নতুন করে বিশ্লেষণ করার।

নারী হোক আর পুরুষই হোক দুজনকেই দাম্পত্য জীবনকে প্রতিনিয়ত যত্ন করতে হয়। নিয়মিত পানি না দিলে একটা গাছই বাঁচে না, সেখানে সম্পর্ক তো আরো জটিল বিষয়। আর সম্পর্কের যত্নের ক্ষেত্রে দুজনার মধ্যকার পারস্পরিক বোঝাপড়ার পাশাপাশি জরুরি কিছু জায়গায় ছাড় দেওয়ার মনোভাব।

নিজের জীবনকে আরেকটা মানুষের জীবনের সাথে খাপখাইয়ে নিয়ে চলাটা সহজসাধ্য বিষয় নয়, তাই সেখানে পারস্পরিক বোঝাবুঝি, আর সম্পর্কের প্রতি দায়িত্ববোধ না থাকলে সেখানে জন্ম নেয় তিক্ততা আর একঘেয়েমিতা। আর তারই ফলস্বরুপ সমাজে বাড়ছে বিবাহ পরবর্তী অবৈধ সম্পর্ক আর ডিভোর্সের মতো অহরহ ঘটনা।

আমাদের সমাজে সে সকল দম্পতিদের সংখ্যা কম নয়, যারা সমাজ আর সন্তানদের কথা চিন্তা করে নামমাত্র বৈবাহিক সম্পর্ককে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকে আবার ঘরের সম্পর্ককে শুধুমাত্র দায়বদ্ধতা আর নিরাপত্তার খাতিরে টিকিয়ে রেখে বাইরে ভালবাসার সম্পর্ক বহাল তবিয়তে টিকিয়ে রাখছেন। আমার প্রশ্ন হলো, দুজনার প্রতি দায়বদ্ধতা, স্বছতা, নৈতিকবোধ সবকিছুর জলাঞ্জলি দিয়ে শুধুমাত্র সামাজিকতা রক্ষার দায়ে একটি সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখা জরুরি? নাকি বিচ্ছেদ?

আমাদের সমাজে বিশেষ করে নারীকে একটি প্রেমের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কম কাঠখড় পোড়াতে হয় না, সেখানে ডিভোর্স তো আরও কঠিন বিষয়। বর্তমানে স্বয়ংসম্পূর্ণ অনেক নারীই অপমান আর তিক্ততার জীবনের থেকে শুধুমাত্র নিজের উপর আস্থা আর আত্মবিশ্বাস রেখে একা ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে সমাজের থেকে তার কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে তার নিজের ভাল থাকা। একইভাবে পুরুষের ক্ষেত্রে বিষয়টা প্রযোজ্য।

শুধু নারীরাই নয়, পুরুষকেও নিজের পরিবার, সমাজ আর স্ট্যাটাস এর কথা চিন্তা করতে হয়। তাই প্রাচ্যর দেশগুলোর মতো আমাদের সমাজে ডিভোর্স এর সংখ্যা এখন কম। তবে আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতির পাশাপাশি নিজেদের সম্পর্কগুলো যে পশ্চিমাকরণ করে ফেলছি সে বিষয়ে সন্দেহ নেয়।

আমার বিশ্লেষণকে এখানে সুস্পষ্ট করতে চাই। আমি ডিভোর্সের পক্ষে বলছি না, আবার টেনে-হিঁচড়ে নামমাত্র সম্পর্ককে টেনে নিয়ে জীবন শেষ করতে বলছি না। সব সম্পর্কে কম বেশি জটিলতা থাকে এবং সে জটিলতা দূর করার দায়িত্ব কারও একার নয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে কীভাবে নিজেদের সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব সহকারে দেখছেন এবং সেটার উন্নয়নে এগিয়ে আসছেন। কেউ পারিবারিক মূল্যবোধ, দায়িত্ববোধকে গুরুত্ব না দিয়ে বাইরের জগতকে গুরুত্ব বেশি দিয়ে ফেলছেন, আবার কেউ পরিবারকে গুরুত্ব দিয়ে দাম্পত্য সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। আসলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি জরুরি একে অপরের প্রতি স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, সম্মান আর নিজেদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার  জায়গাগুলোকে প্রসারিত করা।

এখানে একপাক্ষিক চেষ্টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বৃথা যায়। সম্পর্ক খারাপ হতে থাকলে একটা সময় পর্যন্ত তাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা যায়, তারপর আসলে চেষ্টা করে তেমন কোনো লাভ হয় না। সমাজ আর পরিবারের চাপে পড়ে নামমাত্র সম্পর্কের দায় নারী, পুরুষ এবং তার পরিবার কারোর জন্যই খুব বেশি সুখকর হয় না। যেখানে ভালবাসা থাকে না, সম্মান থাকে না, পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকে না, নৈতিকতা বোধ থাকে না, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সমীচিন নয় কি?

আসলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য যেমন যত্ন আর ভালবাসা লাগে, তেমনি তিক্ততার সম্পর্ককে আর না বাড়িয়ে অপমান আর ইঁদুর বিড়ালেরসম্পর্ককে না বলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সৎ সাহস লাগে।

কারো জন্য কারো জীবন জগত কখনোই থেমে থাকে না। বিচ্ছেদ তিক্ততা থেকে হয়, রাগ থেকে হয়, পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাবে হয়, কিন্তু তাই বলে সেটা যে একটা জীবনকে থামিয়ে দেয়, তা কখনো নয়। হয়তো কিছুদিনের জন্য তা দমিয়ে দেয়, কিন্তু আবার নতুন করে শুরু হয় অন্য একটা জীবন। সেটা মাঝে মাঝে মানুষকে নতুন করে শুরু করার সুযোগ দেয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে কীভাবে সে সুযোগটা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়! বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার, সে বিষয়ে একটা সময় পর্যন্ত সমস্যাগুলো সমাধানে অন্যদের প্রচেষ্টা গ্রহণযোগ্য।

কিন্তু দূর থেকে কিছু ইমোশানের বশবর্তী হয়ে যে মানুষ দুটি ঝামেলায় ভুগছে নিজেদের সিদ্ধান্ত তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত নয় কি? তাই আসুন, আমরা অনধিকার চর্চা বন্ধ করি, আর অন্যর উপর নিজের কতটুকু বলার এবং করার অধিকার আছে, সে বিষয়ে পুনরায় চিন্তা করি।

নৃবিজ্ঞানী পাবলিক হেলথ গবেষক

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.