নিউ ইয়র্কের সাদাকালো জীবন

সুলতানা রহমান:

স্টুডিও এপার্টমেন্ট কী জিনিস নিউ ইয়র্কে আসার আগে আমার কোনো ধারণা ছিলো না। বন্ধু-বান্ধবদের কাছে জানলাম- মোটামুটি বড় একটা রুম, তার মধ্যেই কিচেন এবং বাথরুম। ভাড়া কিছুটা সাশ্রয়ী।

সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকায় এমন একটি স্টুডিও এপার্টমেন্ট ভাড়া হবে বিজ্ঞাপন পেলাম। ব্রুকলিনে। ভাড়া ৮০০ ডলার। ফোনে কথা বলে রওয়ানা হলাম। তার আগে ম্যাপ দেখে লোকেশন, ট্রেন কানেকশন বুঝলাম। এক্ষেত্রে আমার ছেলে আমার মাস্টার! তাকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হলাম। পৌঁছে সাক্ষাৎ পেলাম বাড়িওয়ালার। সিলেটি। মুখে পান। পরনে লুঙ্গি- পাঞ্জাবী।

বাসা দেখাতে বেজমেন্টে যেতেই আমার ছেলে ভেটো দিলো, সে একটা মুভিতে দেখেছে বেজমেন্টে ভূত থাকে! সুতরাং চলবে না। এখানে থামলেই হয়তো ভালো হতো, কিন্তু জীবন যে আমায় সবই দেখাতে চায়! 

বাড়িওয়ালার পেছন পেছন বেসমেন্টে ইতস্তত ঢুকলাম, জীবনে প্রথম বেজমেন্ট দর্শন। ঘুটঘুটে অন্ধকার সিঁড়ি পেরিয়ে স্টুডিও এপার্টমেন্টের দরোজার সামনে দাঁড়াতেই আমার নাড়িভুড়ি মোচর দিলো। মাটির নিচে আলো-বাতাসহীন ঘরে শুঁটকির বোঁটকা গন্ধ! এক লোক খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে কোমরে গামছা বেঁধে রান্না করছে! বিব্রতকর অবস্থা।

বাড়িওয়ালাকে বললাম, স্টুডিও এপার্টমেন্ট দেখান। বললেন- এটাই তার সেই স্টুডিও এপার্টমেন্ট। একটা খাট বসানো যাবে এমন সাইজের তিনটা রুম আছে, বাথরুম কিচেন শেয়ারিং। রুম তিনটির একটি খালি। সেই এক রুম আট শ ডলারে ভাড়া হবে! নিতে চাইলে ভাড়া নিয়ে আলাপ করতে পারি।

ছেলেকে নিয়ে আমি কোনোরকম দৌড়ে পালালাম। আমরা কেউ কারো দিকে না তাকিয়ে ফুটপাথে বসে পড়লাম! বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। হঠাৎ দুজনে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম! বললাম, আমার সঙ্গে থাকলে অনেক কষ্ট করতে হবে, অনেক কষ্ট! সবকিছু অনিশ্চিত। ছেলে মন খারাপ করে বললো- তুমি না রাখলে আমাকে এতিমখানায় দিয়ে এসো! আমরা জড়াজড়ি করে কাঁদি।

বিষন্ন মনে ফিরতে ফিরতে মনে হলো, ঢাকায় রেললাইনের দুপাশের সারি সারি বস্তি ঘরগুলো ভালো? নাকি এমন বেজমেন্ট? আমি বস্তি ঘরগুলোকে বেশি নম্বর দিলাম। কারণ ঢাকার বস্তিতে অন্তত প্রাকৃতিক আলো-বাতাস আছে, মাটি চাপা পড়ে মরার আশংকাও কম! এই দেশের মানুষ নাকি আইনকে শুধু ভয় পায়, আইন খুব কড়াকড়ি। আইন লংঘিত হলে দফারফা। আমি নিশ্চিত এদেশের আইনে ওই পরিবেশে মানুষের বসবাস কিছুতেই বৈধ হতে পারে না। তাহলে এমন অন্ধকার ঘুটঘুটে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানুষ থাকে কেমন করে? কী করে এ দেশের হাউজিং অথোরিটি? কী করে পুলিশ? আমাদের গরিব বাংলাদেশে এসব অস্বাভাবিক লাগে না, তাই বলে বিশ্বের এক নম্বর দেশ, যে উন্নত দেশের উদাহরণ শুনি কথায় কথায়, সেই আমেরিকার একটি মানুষেরও কি এমন পরিবেশে জীবন যাপনের কথা? আমার জানা ছিলো না! 

সেই দিনটি বিষন্নতায় কেটে গেলো! স্টুডিও এপার্টমেন্ট দেখে হতাশার কথা বলতেই বন্ধুরা জানালো, ওই বাড়িওয়ালা বাটপার। স্টুডিও এপার্টমেন্ট একজনের জন্য চলনসই থাকার ব্যবস্থা। কেউ কেউ ফ্যামিলিও থাকে। কিন্তু স্টুডিও এপার্টমেন্ট শুনলেই আমি এখন নাকে শুঁটকির বোঁটকা গন্ধ পাই, আমার ছেলে আঁতকে ওঠে! 

নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশিরা বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য সাধারণত ঠিকানা পত্রিকা কেনে, নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ঐতিহ্যবাহী সাপ্তাহিক এই বাংলা পত্রিকাটির দাম এক ডলার! আমিও কিনেছিলাম একখানা। কত ধরনের বাসার ভাড়ার বিজ্ঞাপন হতে পারে এ সংক্রান্ত ক্লাসিফায়েড পাতাগুলো না দেখলে অনুমান করা কঠিন। বেশির ভাগ বিজ্ঞাপন রুম ভাড়ার, বাসা তুলনামূলক কম। তাতে অনুমান করলাম, এখানে বসবাসকারীদের একটি বড় অংশ সাবলেট থাকে।

কারণটা পরে বুঝেছি। বেশি ভাড়া, রোজগারের প্রায় সবটুকু চলে যায় বাসা ভাড়ায়, যেমনটা হয় ঢাকাতেও। এরাই সম্ভবত এদেশের গরিব বা নিম্ন মধ্যবিত্ত বা দরিদ্রসীমায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠী! যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়! 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.