মালবিকা লাবণি শীলা:
ফরহাদ মজহারের পক্ষে-বিপক্ষে লেখা পড়তে গিয়ে চোখে পড়লো একটি লেখা, যাতে অর্চনা রানীর অনাগত সন্তানকে (যদি তিনি আসলেই গর্ভবতী হয়ে থাকেন) পৃথিবীর আলো দেখানো আর অর্চনা রানীকে সামাজিক বৈধতা দিয়ে অর্থনৈতিক আনুকূল্য দেওয়ার আকুল আবেদন জানিয়েছেন লেখক।
এখানে আমার দুটো কথা আছে। যে কোনো শিশুকে মানুষ করার জন্যে অর্থই কি আসল উপাদান! তাহলে তো কোটিপতিদের গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা নেওয়া উচিত! ফরহাদ মজহারের আগের সম্পর্ক দেখে কি বোঝা যায়নি যে তিনি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী নন! তাহলে এখানে আপনি অর্চনা রানীকে কোন ধরনের বৈধতা দিতে চাইছেন!
দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দুজনকে ভালোবেসে বিয়ের শর্ত ছাড়াও শারীরিক সম্পর্ক করতে পারেন। সেটা সম্পূর্ণই তাদের নিজের ব্যাপার। এখানে সমাজ বা রাষ্ট্র তাদের জোর করে বিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতে পারে না। এটাকে আপনার অসভ্যতা মনে হলে আপনি এরকম সম্পর্ক এড়িয়ে চলুন। কিন্তু অন্যে বিয়ে করবে কি-না, বাচ্চা নেবে কি-না সেটার সিদ্ধান্ত আপনি নিতে পারেন না।
মনে করুন, একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লো, আপনি কি সেই মেয়েটাকে জোর করে সেই ধর্ষককে বিয়ে করাতে বাধ্য করিয়ে বাচ্চাটির “বৈধতা” দিতে চাইবেন? সৎ বাবার ঘৃণ্য ধর্ষণের খবর হজম করার আগেই আর একটি খবর নিউজফিডে জায়গা করে নিয়েছে। জামালপুরে এক অমানুষ পিতা তার নিজের বারো বছর বয়েসী কন্যাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে এসেছে। মেয়েটি এখন পাঁচ মাসের গর্ভধারণ করছে। এই ক্ষেত্রে আপনি কী করবেন! কী বলবেন! গর্ভপাত কারোই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে গর্ভপাত ছাড়া উপায়ও থাকে না। হয়তো উদাহরণটি একটু বেশি রূঢ় হয়ে গেল!
কিন্তু ঘটনা যতো ন্যাক্কারজনকই হোক, ঘটেছে তো! আইন যতো কঠোরই হোক, ফাঁকফোকর গলে এরকম অনেক ঘটনাই ঘটবে। আমরা এর এক শতাংশও জানতে পারবো কি-না সন্দেহ! আমরা নিজেদের সমাজের আলোকিত, শিক্ষিত মানুষ হিসেবে দাবী করতে গিয়ে অন্যের স্বাধীন ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারি না।
ফরহাদ মজহার বিয়ে করবেন কি করবেন না সেটা তাঁর নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। অর্চনা রানী তাঁর অনাগত সন্তান রাখবেন কি রাখবেন না সেটাও তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। ফরহাদ মজহারের রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা চেতনা আমার বোধগম্য হয় না, আমি তাঁর অনেক চিন্তার সাথেই একমত নই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়ে আমি নাক গলাতে যাবো!
অন্যায়ের বিরোধিতা করুন, সোচ্চার থাকুন, প্রতিবাদ করুন- এ সবই আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু সেটা অতি অবশ্যই অন্যের স্বাধীন ইচ্ছা অনিচ্ছার অধিকারকে খর্ব করে নয়। আজ আপনি আপনার প্রেমাষ্পদকে বিয়ে করবেন, নাকি লিভ টুগেদার করবেন, নাকি ব্রেকআপ করবেন, সেটা যেমন আপনার নিজস্ব অভিরুচি, সেরকম প্রত্যেকটি মানুষেরই এই স্বাধীনতাটুকু থাকুক। অনিচ্ছুক দুজন মানুষকে বিয়ে করিয়ে দিয়ে আপনি কি- খুব একটা ন্যায় করা হলো বলে ভাববেন! তা কিন্তু নয়।
অনিচ্ছুক পিতামাতাকে জোর করে একটি সন্তান এই পৃথিবীতে আনালে সেটা কারো জন্যেই সুখকর না-ও হতে পারে! এই বাচ্চা বড় হয়ে যদি অসুখী হয়, অসুস্থ হয়, তার দায় তো টাকা দিয়ে মেটানো যাবে না! কাজেই কে বিয়ে করবে, কে বাচ্চা নেবে, সেই সিদ্ধান্ত তাঁদেরকেই নিতে দিন। ধরুন আজ আপনি ফরহাদ মজহারকে বাধ্য করলেন অর্চনা রানীকে বিয়ে করে সন্তান নিতে, কাল বাচ্চাসহ তিন তালাক দিলে অর্চনা রানীর অবস্থা কি আজকের চেয়ে ভালো হবে! মানুষের স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে আপনারা কি পরোক্ষে মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন না?