শাশ্বতী বিপ্লব:
কয়েকদিন থেকেই ভাবছি কথাগুলো লিখবো, কিন্তু আলসেমী পিছু ছাড়ছিলো না। জহুরা আকসার “নারীবাদ এবং আমার ৩৫ বছরের জীবন” লেখাটা সেই আলসেমীকে একটা ধাক্কা দিলো। ভাবলাম লিখেই ফেলি।
আমি উইমেন চ্যাপ্টারে নিয়মিত লিখি। কিন্তু আমি উইমেন চ্যাপ্টারের সব লেখার সাথে একমত নই। আবার এখানে অন্যান্য লেখকরাও আমার সব লেখার সাথে একমত হয় না। আমরা প্রায়ই একজন আরেকজনের লেখার সাথে দ্বিমত পোষণ করে পাল্টা লেখা লিখি। সম্পাদক সবারটাই ছাপেন। এমনকি আমি সম্পাদকেরও সব মত বা অবস্থানের সাথে একমত নই। এবং সেটা জানাতেও আমি দ্বিধাগ্রস্ত নই। ঠিক তেমনি সম্পাদকও আমার সব মতের সাথে একমত নন। কিন্তু তিনি তবুও আমার লেখা ছাপেন। এভাবেই চলছে।
উইমেন চ্যাপ্টার নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কে যারা গঠণমূলক সমালোচনা করেছেন, সেখান থেকে আমি প্রধানতঃ তাদের যে উদ্বেগের জায়গাগুলো পেয়েছি তা হলো,
১. উইমেন চ্যাপ্টার ভুল নারীবাদের চর্চা করছে বা শেখাচ্ছে।
২. উইমেন চ্যাপ্টারে প্রান্তিক নারীদের নিয়ে কোন লেখা ছাপা হয় না। বিশেষ করে, গার্মেন্টস শ্রমিকদের কথা অনেকেই বলেছেন।
তার মানে উইমেন চ্যাপ্টার তার উদ্দেশ্য পরিস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে অনেকের কাছে এবং উইমেন চ্যাপ্টারের কাছে সেকারণে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। আর মূল ঝামেলাটা হয়েছে এখানেই।
নারীবাদ শেখানো নিয়েই প্রথমে বলি। সহী বা ভুল তো পরের কথা, উইমেন চ্যাপ্টার কি আদৌ নারীবাদ শেখায়? স্পষ্ট উত্তর হলো, না, শেখায় না। উইমেন চ্যাপ্টার কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা একাডেমিক ইন্সটিটিউশন নয়। উইমেন চ্যাপ্টার তাত্ত্বিক নারীবাদের প্রয়োজনকে অস্বীকার করে না। কিন্তু তাত্ত্বিক নারীবাদের চর্চাও করে না। নারীবাদ নিয়ে কেউ যদি তাত্ত্বিক আলোচনা করতে চান এখানে, উইমেন চ্যাপ্টার সেটা সানন্দে প্রকাশ করে। পাঠক সেই তাত্ত্বিক আলোচনাটা গ্রহণ করবেন কি করবেন না, সেটা পাঠকের উপরই ছেড়ে দেয়া হয়। চাইলে কেউ সেই আলোচনার বিপরীতে পাল্টা আলোচনা করতে পারেন। উইমেন চ্যাপ্টার সেটাও ছেপে দেবে।
দ্বিতীয়তঃ উইমেন চ্যাপ্টার কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠানও নয়। কোন নির্দিষ্ট পেশাজীবী বা শ্রেণীভূক্ত মানুষকে নিয়ে উইমেন চ্যাপ্টার কোনো গবেষণা করে না। উইমেন চ্যাপ্টারের সেই সক্ষমতাই নেই। উইমেন চ্যাপ্টারের উদ্দেশ্যও সেটা নয়। তবে, যারা কোনো নির্দিষ্ট পেশাজীবী বা শ্রেণীর নারীদের নিয়ে কাজ করেন, গবেষণার সাথে যুক্ত আছেন, তারা যদি উইমেন চ্যাপ্টারে তাদের গবেষণার ফল বা অভিজ্ঞতা লেখেন, তবেই একমাত্র উইমেন চ্যাপ্টার সেগুলো ছাপতে পারবে।
যারা বলেন, উইমেন চ্যাপ্টার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে লেখে না, তারা সবটা সত্য বলেন না। অথবা, তাদের হয়তো চোখ এড়িয়ে গিয়ে থাকবে। আমি নিজে এখানে অভিবাসী নারী শ্রমিক বা পার্বত্য অঞ্চলের নৃগোষ্ঠী নিয়ে লিখেছি। লিখেছি, বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন নিয়ে। লিখেছি, কর্মজীবী নারীর সন্তানের জন্য ডে কেয়ার সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। এমনকি জঙ্গিবাদ নিয়েও আমার লেখা আছে এখানে। আমি ছাড়াও, আরো অনেকে এসবসহ সমাজের আরো নানা অসঙ্গতি নিয়ে লিখেছেন একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে।
এখন প্রশ্ন হলো, উইমেন চ্যাপ্টারটা তবে কী? এর উদ্দেশ্যই বা কী?
সাধারণভাবে, আমি যতটুকু বুঝি, নারীদের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা, বঞ্চনা কিংবা অর্জন, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, চ্যালেঞ্জ, হতাশা – মোট কথা জীবনের না বলা কথা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করার জন্য উইমেন চ্যাপ্টার একটি উন্মুক্ত প্লাটফর্ম। যে কোন নারী (এবং পুরুষও) এখানে লিখতে পারেন, প্রকাশ করতে পারেন তাদের মনে জমে থাকা কথাগুলো।
এখানে লিখতে চাইলে মার্কসীয় নারীবাদ, সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ, র্যাডিকেল নারীবাদ, লিবারেল নারীবাদ, উত্তরাধুনিক নারীবাদ, পরিবেশ নারীবাদ বা সাংস্কৃতিক নারীবাদ না জানলে, না বুঝলেও চলে। নারীবাদের ফার্স্ট, সেকেন্ড বা থার্ড ওয়েভ নিয়ে পড়াশোনা না থাকলেও অসুবিধা নেই। সিমোন দ্য বোভোয়ার, এমনকি কমলা ভাসিনকে না জানলেও অসুবিধা নেই। কোন লেখাটা বা মতটা গ্রহণযোগ্য বা সঠিক, এবং কোনটা নয়, সেটা বিচারের ভার পাঠকের।
আমার জানামতে, তাত্ত্বিক বা অতাত্ত্বিক, কর্মজীবী বা গৃহিনী, শিক্ষার্থী বা শিক্ষক, সন্তান বা অভিভাবক, একা বা দোকা, জনপ্রিয় বা অতি সাধারণ সব ধরনের নারীকে একোমোডেট করার একমাত্র প্লাটফর্ম উইমেন চ্যাপ্টার। বাংলাদেশে এমন আরেকটা প্লাটফর্ম নেই।
এখানের লেখকরাও কখনো নিজেদের সহী নারীবাদি হিসেবে দাবী করেন না। আমি তো নইই। শুধু এটুকু বুঝি, শুধু তত্ত্ব দিয়ে সবার কাছে পৌঁছানো যায় না। তাত্ত্বিক নারীবাদের যেমন দরকার আছে, তেমনি প্রয়োজন আছে একদম সহজ, সরলভাবে নারীর জীবন পাঠের। আর, জহুরা আকসার লেখাটা সেরকমই একটা উদাহরণ।
উইমেন চ্যাপ্টারে রান্না শেখানো হয় না, ঘরকন্না শেখানো হয় না, সাজসজ্জা শেখানো হয় না। নারীবাদ তো নয়ই।
এখানে লিখতে সম্পাদকের কাছে ধর্না দিতে হয় না। তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেও হয় না। শুধু ছবিসহ ইমেইল করে দিলেই হয়। অনেকসময় সম্পাদক নিজে কষ্ট করে ছবি খুঁজে নেন। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এখানকার লেখকরা কোন সম্মানী পান না। যারা লেখেন, তারা সেটা মেনে নিয়েই লেখেন। এবং লিখতে লিখতে হাতটা পাকানোর সুযোগ পান। আমি নিজেও তেমনি একজন। জহুরা আকসাও তাই। একদম বিশুদ্ধ ভলান্টারিজমের চর্চা চলে এখানে।
তাই, শুভাকাঙ্খীদের কাছে অনুরোধ থাকবে, উইমেন চ্যাপ্টার পড়ুন, গঠনমূলক সমালোচনা করুন এবং আপনারাও লিখুন। এবং উইমেন চ্যাপ্টারের মতো বা আরো ভালো, আরো ইনোভেটিভ প্লাটফর্ম তৈরি করুন প্রয়োজনে। একাধিক প্লাটফর্ম থাকলে সেগুলোর মান ভালো হওয়ারও সুযোগ তৈরি হয়।
এরকম একটি প্লাটফর্মটি বেঁচে থাকা দরকার, তুমুলভাবে বেঁচে থাকা দরকার।