হাবিবা রিমা:
যখন আমি খুব ছোটো, তখন দৈত্য-দানব, জীন সবকিছুরই নিজস্ব রূপ কল্পনা করে নিতাম। এমনকি খারাপ মানুষগুলোরও। তারা কে, কেমন দেখতে, তার একটা ছবি তৈরি করে ফেলতাম মনে মনে, যেন দেখলেই বোঝা যায় সে কেমন। খুব অদ্ভুত ভাবে, মানুষের বেলায় মিলেও যেতো সেগুলো অনেকটা।
চেহারা দেখে টপ করে বলে ফেলতাম, কোনটা কেমন দেখতে বা কীরকম দেখতে হলে সেটা কী বা কেমন হবে? খারাপ হবে না ভালো, সুন্দর না ভয়ংকর? কোমল না কঠিন?
এই যেমন, আলাদীনের চেরাগ ঘষলে যেরকম দৈত্য বের হয়, আমার দৃষ্টিতে দৈত্যরা সব সেরকম।
অনেক লম্বা চুলের কেউ চুল এলিয়ে দিয়ে গাছে বসে আছে, তার এত্ত লম্বা চুলগুলো মাটি ছুঁই ছুঁই, তার মানেই
চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যে এটা পেত্নী!
লাল টুকটুকে চোখ, ইয়া লম্বা গোঁফ মানেই লোকটা ভয়ংকর রাগী!
তেমনি ভাবে তসবিহ হাতে পাঞ্জবী পরে আল্লাহু আল্লাহু যিকির করে চলে যাওয়া মানুষ দেখলেই ভাবতাম আল্লাহওয়ালা ভালো মানুষ!
মাঠে কোনো বক্তার সত্যনিষ্ঠ বক্তব্য শুনলে চোখ বুঁজে ধরে নিতাম লোকটা সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ আর
ভালো মানুষ। কী সুন্দর বলে, লেখে, আহা!
যে দেখতে যেমন বা যে যেমন করে দেখায় নিজেকে তাকে নিয়ে ঠিক তেমন করে একটা ব্যক্তিত্ব কল্পনা করে ফেলতো আমার সরল মন। তাছাড়া একজন মানুষের একটিমাত্র রুপই তো থাকবে, হোক সে সাদা বা কালো।
এক চেহারায় বহুরূপ আবার হয় নাকি!
তারপর আমি আরেকটু বড় হলাম, মানুষকে খুব ভালোই চিনতে পেরেছি বলে ভাবতাম। এইতো সেদিনও বন্ধুদের গর্ব করে বলতাম যে, লম্পটদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, একটু কথা বললে, একটু মিশলেই সত্যি রূপটা ধরা যায়।
আমি বড় হতে থাকি প্রতিদিন একটু একটু করে। আমার সরল অংকেরা ধীরে ধীরে জটিল থেকে জটিলতর হয়। বুঝি, আমাদের চারপাশে বছরের পর বছর ভালো মানুষের মতো দেখতে লোকগুলোই কখনো কখনো আমার সরল অংক জটিল হবার কারণ হয়ে যায়।
অনেক পথ চলেও, একসাথে মিশেও তাদের চেহারাটা অপরিচিতই থেকে যায় যদি না হঠাৎ কোন বুনো হাওয়া এসে তাদের মুখোশটা খুলে দিয়ে যায়!
আফসোস আমার, অসহায় দীর্ঘশ্বাসেরা আমার!
এখন বুঝি, বুঝতে হয় যে, যা দেখি বা যা দেখানো হয় সেটাই তার একমাত্র সত্য রূপ নয়। এর চাইতে ভয়ানক রূপও হতে পারে যা দেখা যায় না, বোঝা যায় না, এমনকি ধারণাও করা যায় না!
আমি অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখি আরমানেরাও দেখতে মানুষেরই মতো। তারাও ভালো মানুষটার মতো সত্য আর ন্যায়ের বাণী আওড়ায় রোজ!
আরমান সুমনেরা সুমন নামধারী হলেও তাদের মন সুন্দর হয় না! কুৎসিত তারা!
ওয়াক থু, আরমানেরাও যে হাতে তসবিহ টেপে!
আরমানেরা ধর্ষণ করে, নির্যাতন করে, আরমানেরা নিজের সৎ মেয়েকেও ছাড়ে না! কে জানে, নিজের মেয়েকেও ছাড় দিতো কীনা!
এখন দেখি, আরমানদের একই অঙ্গে কত রূপ! একই চেহারায়, একই রূপে আরমানেরা বহুরুপী!
আমার বমি পায়, ঘৃণায় জ্বালা করে অন্তর। জগৎময় কতো মানুষ! কারো চেহারার সাথে কারো মিল নেই। দেখি আর ভাবি। অবাক হই তখন যখন দেখি এখানেই বৈচিত্রময়তার শেষ নয়!
এতো এতো চেহারার মধ্যেও আবার কত শত চেহারা লুকিয়ে থাকে! যে চেহারা দেখি সেটাই একমাত্র নয়!
সুযোগ পেলেই চেহারার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে অন্য নতুন কোনো চেহারা, হতে পারে তা ভয়ংকর!
যে হাত তসবিহ টিপছে, সে হাতই সুযোগ পেলে খামচে ধরে রক্ত চুষে নিতে পারে কোন নারী শরীরের, সেই হাতই জোরপূর্বক টেনে নিতে পারে অবলাকে বিছানায়। করে দিতে পারে অন্তঃসত্ত্বা!
যখন শোনা যায়, যেই লোকটা বৈধ বা অবৈধ যে কোন শিশুর জীবনে বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে লিখেছিল, সেই মানুষটাই তার সৎ মেয়েকে আট বছর ধরে নিভৃতে ধর্ষণ করে অন্তঃসত্ত্বা করে দিয়েছিল। অতঃপর সেই মেয়েটিরই গর্ভপাত ঘটিয়ে সেখান থেকে লেখার উপাদান জোগাড় করেছিল সে, তখন আরেকবার বলতে ইচ্ছা করে, ওয়াক থু।
আমি বড় হয়েছি, অনেক নির্মম বাস্তবতা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। তসবিহ টিপলে, জপতপ করলে, আল্লাহ- নবী আর ইসলামের বাণী দিয়ে ফেসবুক ওয়াল ভরে ফেললেই আজ আর ধরে নেই না এটাই তার একমাত্র রূপ।
বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাইদের দেখেও নিশ্চিন্ত হই না যে তিনি সত্যিকারের বিদ্যান।
কী করে হবো? সমাজে আরমানদের মতো লোকের তো আর অভাব নেই।
তাছাড়া আমার দীর্ঘশ্বাসেরা, আমার যন্ত্রণারা প্রতিনিয়ত যে কেবলি আমায় মনে করিয়ে দিয়ে যায়, ‘আরমানেরা সত্যি বহুরূপী, আরমানেরা ভয়ংকর’!