নারী কেন মেরুদণ্ডহীন হবে?

নাদিয়া ইসলাম:

টানা আট বছর নিজের সৎ কন্যারে ধর্ষণ করছেন নিউজ-২৪ এর শব্দ প্রকৌশলী আরমান হোসেন সুমন (৩৮)। তিনি ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করছেন, ছবি তুইলা রাখছেন, ধর্ষিতরে এই বাবদ ব্ল্যাকমেইল করছেন, তারে এ্যাবরশান করাইতে বাধ্য করছেন। এই ঘটনা ধর্ষিতর মা জানতেন, তিনি ঘটনা গোপন কইরা গেছেন এবং মেয়েরে তার দ্বিতীয় স্বামীর সাথে এই সম্পর্ক চালায়ে যাইতে বাধ্য করাইছেন এবং ধর্ষিতরে দিয়াও ঘটনা গোপন রাখতে চাপ দিছেন।

আমি আরমান হোসেন সুমনরে নিয়া চিন্তিত না। বাংলাদেশে বাস করেন এমন বেশিরভাগ মেয়েই কোনো না কোনো সময় পরিবারের কোনো না কোনো পুরুষ সদস্য দিয়া যৌন নির্যাতনের স্বীকার হইছেন। আমরা যতই সেইসব পুরুষদের আমার পরিবারের অংশ না বইলা ভাইবা এক ধরণের আত্মপ্রসাদে ভুইগা থাকি না ক্যানো, এইসব পুরুষেরা আমাদের কারো না কারো বাবা, কারো চাচা, কারো শ্বশুর, কারো ভাই, কারো মামা, কারো খালু। আমি তাই বাংলাদেশের ধর্ষকামী পুংদণ্ডদের, যাদের এক লাত্থিতে ভর্তা বানানো যায়, তাদের নিয়া চিন্তিত না।

আমি চিন্তিত ধর্ষিতর মা’রে নিয়া। কোন্‌ মা নিজের সন্তানরে বছরের পর বছর ধর্ষিত হইতে দেইখাও চুপ কইরা থাকেন? ভদ্রমহিলা নিজেই কি যৌনবিকারগ্রস্থ নাকি তিনি নিজেও কোনো প্রকার নির্যাতন এবং ব্ল্যাকমেইলের শিকার? নাকি তিনি ধর্ষণরে অপরাধ মনে করেন না? নাকি তিনি পুরুষতন্ত্রের কাছে নিজেরে বেঁইচা দেওয়া মেরুদণ্ডহীন একজন নারী যিনি ভাবেন মেয়েদের অত্যাচারিত হওয়াই মানায়? নাকি তিনি একজন লোভী মানুষ যিনি মেয়ের মারফত স্বামীরে ‘সেবা’ দিয়া নিজে কোনোপ্রকার সুবিধা পাইতেছিলেন?

আমি নিজে ফেইসবুকে সারাক্ষণ মেয়েদের “আমার পক্ষে ডিভোর্স দেওয়া সম্ভব না” “অমুকে কী বলবে” “আমার বাচ্চাকে নিয়ে কই যাবো” “আমার তো একলা চলার সামর্থ্য নেই” “আমার বাবা মা’ই আমাকে সাপোর্ট দিবে না” মার্কা গল্প শুইনা কনক্লুশানে আসছি যে বিদেশবাসের কারণে বাংলাদেশের মেয়েদের পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা আমার নাই। আমি পরিস্থিতি বুঝতেও চাই না। এই দেশের মেয়েদের ‘পরিস্থিতি’ বুইঝা যদি নির্যাতনরে সাপোর্ট দিয়া, নির্যাতনরে একশ’ একচল্লিশ বছর টাইনা নিয়া গিয়া বালিশে মুখ ঢাইকা কান্নাকাটি হয়, তাইলে আমার সেই পরিস্থিতি ফরিস্থিতি বুঝার দরকার নাই।

আমি শুধু চাই এই দেশের মেয়েরা জানুক নির্যাতন কারে বলে। আমি চাই মেয়েরা নিজেরা নিজেদের উপর হইতে যাওয়া নির্যাতন ঠেকাক। আমি চাই প্রথমবার নির্যাতনের সাথে সাথে তারা তা নিয়া প্রতিবাদ করুক। আমি চাই মেয়েরা বাপের কাছ থিকা, পুরুষতান্ত্রিক মা এবং পুরুষতান্ত্রিক আন্টিকূলের কাছ থিকা “আরেকটু মানিয়ে নাও মা!” “মেয়েদের জীবন এমনই হয় সোনা!” “এই বাচ্চা নিয়ে তুমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?” “সব পুরুষই এক রকম! তাই ডিভোর্স দিয়ে লাভ নেই!” “বিয়ে ভাংলে আল্লার আরশ কাঁপে, এই কাজ করো না!” “এসব কথা বাইরে জানাজানি হলে লোকে তোমাকেই খারাপ বলবে!” “সংসার মানেই কম্প্রোমাইজ!” “পোলিসের কাছে গেলে পরে তোমার বিয়েই হবে না!” ইত্যাদি কথাবার্তার মুখে থুতু দিয়া বাইরে বাইর হইয়া আসুক, আমি চাই বাংলাদেশের মেয়েরা নিজের গায়ে নষ্ট, খারাপ, বেশ্যা, মাগী ইত্যাদি টাইটেল লাগাক কিন্তু তারা যেন কখনোই কখনোই কখনোই নির্যাতনের সাথে আপোশ না করেন।

আমি পৃথিবীর বহু দেশের মেয়েদের সাথে মিশছি। আমি আমার নিজের দেশের মত অন্য কোনো দেশের মেয়েদের এতটা মেরুদণ্ডহীন হইতে দেখি নাই। এত লোভী, এত পুরুষনির্ভর, এত আত্মসম্মানহীন, এত পরমুখাপেক্ষী মানুষ দেখি নাই। আমার দেশের মেয়েরা পড়ালেখায় ভালো হইয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী হইতে পারেন, পোলিস হইয়া ইউ-এন মিশনে দেশ বিদেশ ঘুরতে পারেন, সায়েন্টিস্ট হইয়া ওরাল সেলাইন আবিষ্কার করতে পারেন, কিন্তু দিনশেষে ঘরে গিয়া স্বামীপ্রবরদের সামনে তাদের গলা থিকা মিউঁমিউঁ ছাড়া আর কিছু বাইর হয় না। না, আপনার পার্টনার ভালো মানুষ হইলে আপনার হ্রেস্বাধ্বনি দিয়া চিঁহিচিঁহি ডাক পাইড়া “অর্থাৎ কীনা কোলে চড়েছি এখন আমায় দেখো!” বইলা উদ্বাহু নৃত্যের দরকার নাই। কিন্তু আপনার পার্টনার আপনারে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলে, আপনারে মৌখিক, শারীরিক, যৌন, অর্থনৈতিক নির্যাতন করলে বা করার চেষ্টা করলে, আপনারে অবহেলা করলে, আপনার প্রাপ্য সম্মান না দিলে, আপনার অনুভূতি না বোঝার চেষ্টা করলে আপনি কী কারণে তার সাথে থাকবেন? উনি আপনার বাসা ভাড়া দেন বইলা? উনি আপনার শাড়ি কিনা দেন বইলা? উনি আপনার বাচ্চার বাপ বইলা? আপনার যাওয়ার জায়গা নাই বইলা? বিয়া একটা পবিত্র বন্ধন বইলা? আপনার বাপ মা আপনারে সাপোর্ট দিবেন না বইলা? সমাজ আপনারে ছিঃছিঃ করবেন বইলা?

করুক ছিঃছিঃ, কেউ সাপোর্ট না দিক, আপনি দশ কোটি টাকার ফ্ল্যাট ফালায়ে বস্তিতে আইসা থাকেন, বাংলা সিনেমার মত শেলাই কইরা অর্থ উপার্জন করেন, নিজের পায়ে দাঁড়ান, কিন্তু আত্মসম্মান বিক্রি কইরা দিয়েন না। কিন্তু নির্যাতিত হইয়া নাঁকি কান্না কাইন্দেন না। কিন্তু নিজে নির্যাতিত হইয়া আরেকজন মেয়ের নির্যাতিত হওয়ার রাস্তা পরিষ্কার কইরা দিয়েন না। কিন্তু নিজে নির্যাতিত হইছেন বইলা বাকি সবার নির্যাতিত হওয়া জায়েজ বইলা ফতোয়া জারি কইরেন না। কিন্তু নিজের সন্তানের কাছে ছোট হইয়া যায়েন না। কিন্তু সমাজের চোখে সেকেন্ড সেক্স হইয়া থাইকেন না। কিন্তু নিজেরে ছোট, অসহায়, দুর্বল বানায়ে রাইখেন না।

মনে রাইখেন, এইসব পুরুষদের আপনি নয় মাস আপনার পেটে রাখছেন। মনে রাইখেন, এইসব পুরুষদের আপনি আপনার ভ্যাজাইনা মারফত জন্ম দিছেন। মনে রাইখেন, এইসব পুরুষদের আপনি আপনার নিজের শরীর থিকা তৈরি হওয়া খাবার খাওয়াইছেন। তাই আপনি আজকে ভ্যাজাইনা শেলাই কইরা বন্ধ কইরা দিয়া নিজের শক্তি দেখান। আপনি আজকে সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টনের সমস্ত শ্রেণির মেয়েদের নিয়া রাস্তায় নামেন, হরতাল দেন, অবরোধ দেন, বলেন, নির্যাতন বন্ধ না হইলে আপনি আজকে থিকা আর একজন শিশুরও জন্ম দিবেন না। বলেন, আপনারে আপনার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া না হইলে আজকে থিকা আপনি ঘরে বাইরে কোথাও আর একটাও কাজ করবেন না, বলেন, রাষ্ট্র মারফত আপনার সমান অধিকার আদায় না হইলে আপনি আজকে থিকা সমস্ত অফিস আদালত বন্ধ কইরা দিবেন। বলেন। বলতে শিখেন।

জানতে শিখেন নির্যাতন কারে বলে। আপনি এবং আপনার পার্টনার একসাথে অফিস কইরা বাড়ি আসার পরে আপনার যদি একলার রান্নাঘরে ঢুকতে হয়, জানবেন, সেইটাও নির্যাতন। জানবেন, আপনার বাচ্চারে যদি আপনার একলার দেখাশোনা করতে হয়, সেইটাও নির্যাতন। জানবেন, আপনার অনিচ্ছায় আপনার বিবাহিত পার্টনারের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাও নির্যাতন। জানবেন, আপনারে মানসিকভাবে অবহেলা করাও নির্যাতন। জানবেন, আপনারে আপনার নিজের বাবা মা’র প্রতি দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়াও নির্যাতন। জানবেন, আপনারে আপনার কলিগদের সাথে, বন্ধুদের সাথে বাইরে যাইতে না দিতে চাওয়াও নির্যাতন। জানবেন, আপনার সন্তানের নামের সাথে আপনার নামের অংশ না জোড়া দিতে দেওয়াও নির্যাতন। জানবেন, আপনার প্রতিটা সিদ্ধান্তে আপনার পার্টনারের হস্তক্ষেপ করাও নির্যাতন। জানবেন, আপনার বেতনের টাকা পুরাপুরি তার হাতে তুইলা দিতে বাধ্য হওয়াও নির্যাতন।

তাই কথা বলতে শিখেন। তাই জানতে শিখেন। তাই প্রতিবাদ করতে শিখেন। তাই এন-এস-ইউ থিকা শখের বি-বি-এ এম-বি-এ না, পড়ালেখার উদ্দেশ্যে পড়ালেখা করতে শিখেন, নিজের পিৎজা খাওয়ার টাকা জোগাড় করতে না, নিজের সম্পূর্ণ খরচ চালানোর যোগ্যতা অর্জন করতে শিখেন। এতবছর এইসব হইয়া আসছে বইলা আপনারও আরো পঞ্চাশ বছর নির্যাতিত হওয়া জাস্টিফায়েড হইয়া যায় না।

তাই পুতুপুতু টাইপ মেয়ে হওয়া ছাড়েন। তাই আপনার স্বামী আপনারে ধর্ষণ করতে আসলে তার পুরুষাঙ্গ বরাবর লাত্থি দেওয়া শিখেন। তাই আপনার স্বামী আপনার চোখের সামনে আপনার কন্যারে ধর্ষণ করতে আসলে তারে খুন করেন। এরপর হাসতে হাসতে ফাঁসিতে যান। কিন্তু নিজেরে অক্ষম, অসহায়, কদাকার, বিবেকহীন, নিচু, যৌনবিকারগ্রস্থ, লোভী, স্বার্থান্বেষী মা এবং একজন মানুষ নামের কলংক মানুষ হিসাবে প্রমাণ কইরেন না।

শেয়ার করুন: