তানিয়া মোর্শেদ:
ইদানীং ফেইসবুকে একটু কম আসি। পৃথিবীর এত এত নেতিবাচক খবর, কথা নিতে নিতে অধিকাংশ সময়ই দমবন্ধ লাগে। ক’দিন আগে আবারও দেখলাম ঢাকা শহরের এক নারী দশ/বারো বৎসরের একটি মেয়েকে (যার পরিচয় গৃহকর্মী) বীভৎস ভাবে আহত করেছে। ইচ্ছে করেই “করেছেন” লিখলাম না। অবশ্য “তুমি”, “আপনি”, “তুই” ব্যবহার নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। সেকথা অন্যদিন হবে।
আমি শুধু ছবি দেখেই সরে গেছি, পড়িনি। মানুষের বর্বরতার কথা পড়তে পড়তে, জানতে জানতে এমন অবস্থা যে হেডলাইন পড়েই মাথা খারাপ হয়। গতকাল ফেইসবুকে এসে পড়লাম সুপ্রীতির লেখাটা। প্রথমে হেডিং দেখেই ধাক্কা খেয়েছি। তাকিয়ে থেকেছি কিছুক্ষণ। এমন কিছু হলে ওকে ইনবক্সে জানাই। গতকাল কিছুই করিনি।
ওর সাথে আমার পরিচয় ফেইসবুকের মাধ্যমে। পরিচয়ের শুরুর দিক থেকেই ও আমার লেখা উইমেন চ্যাপ্টারে দিতো। আমি বলছি উইমেন চ্যাপ্টারের শুরুর দিকের কথা। সম্ভবত ২০১৩ থেকে আমার লেখা দিতো। কোনো কোনো সময় একইদিনে দুটো লেখাও দিয়েছে। এসব কথা কেন লিখছি? এটা বোঝাতে যে উইমেন চ্যাপ্টারের সাথে আমার সম্পর্ক কবে থেকে সেটা বলতে।
আমার লেখা প্রকাশ করলেও আমি নিজেকে কখনো লেখক বলে ভাবি না। লিখলেই যেমন লেখক হওয়া যায় না, সেরকম প্রতিটি মানুষের লেখার অধিকার আছে, যতক্ষণ না তা কোন না কোনভাবে কারো বা কোন কিছুর ক্ষতির কারণ হচ্ছে। এখন উইমেন চ্যাপ্টার অনেক বড় পরিসরে পৌঁছেছে। অনেক পাঠক, অনেক লেখক। পৃথিবীতে সাত+ বিলিয়ন মানুষের সাত+ বিলিয়ন চিন্তা, মতামত এটা আমি বিশ্বাস করি। অনেকের সাথেই মতপার্থক্য থাকবে, আছে।
কারো মতবাদ, চিন্তাকে প্রশ্ন করতে হলে, কারও লেখা অপছন্দ হলে যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন করা, প্রতিবাদ করায় বিশ্বাসী। এখানেও দুটো কথা আছে, “যৌক্তিক” শব্দটাও অনেক সময় আপেক্ষিক। একজন রাজাকার যে “যুক্তি” দেবে, বা একজন সাম্প্রদায়িক মানুষ যে “যুক্তি” খুঁজবে, তা ক’জনের কাছে যৌক্তিক? সেভাবেই অন্য মানুষের সাথেও “যৌক্তিকতা” নিয়েও মতপার্থক্য থাকতে পারে।
উইমেন চ্যাপ্টারের সব লেখাই যে আমার মতের সাথে যায়, বা ভালো লাগে তা নয়। কিন্তু সবারই লেখার অধিকার আছে, কাদের নেই তা বলেছি আগে, সেভাবেই দেখি। উইমেন চ্যাপ্টার অসংখ্য মানুষের (অধিকাংশই নারী) কথা বলার জায়গা হয়ে উঠছে, উঠবে এভাবেই দেখি।
আগেও বলেছি, পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার হয়ে হাজার হাজার বৎসর ধরে থাকতে থাকতে কোন নারী যদি এমন ভাবে, ভাষায় কথা বলেন, যা অনেকের কাছেই অশ্লীল মনে হয়, তবুও সেই নারীর কন্ঠরোধ করা দূরে থাক, কী বলছেন এটাও বলায় বিশ্বাসী নই। কথা বলতে দিন। অধিকাংশ নির্যাতিত মানুষেরই কাউন্সেলিং এর সুযোগ নেই। নেই পাশে দাঁড়ানো কেউ। লেখকের যেমন স্বাধীনতা আছে, পাঠকেরও আছে সেই স্বাধীনতা। লেখা পছন্দ না হলে পড়বেন না। আর যদি পাল্টা কিছু বলার থাকে, লিখুন। সেজন্য লেখক হবার দরকার নেই। সহজ করেই নিজের যুক্তি দিয়ে লিখুন।
গতকাল সুপ্রীতির লেখা পড়ার পর থেকে এনিয়ে অনেক মানুষের লেখা পড়ছি আজ পর্যন্ত। এনিয়ে আমারও কিছু বলার আছে। যা আমি ইনবক্সেই ওকে জানাতে পারতাম। কিন্তু এটা নিয়ে এতো এতো কথা হচ্ছে, দুটো পক্ষ যেভাবে লেখালেখি করছেন, তাতে মনে হয়েছে আমার কথা এখানেই লিখি।
শুরুতেই বলে নেই, যারা সুপ্রীতির লেখার সমালোচনা করতে যেয়ে ব্যক্তি আক্রমণ করছেন, উইমেন চ্যাপ্টারকে গালি দিচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্য আর যাঁরা লেখাটির যৌক্তিক সমালোচনা করছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য যে এক নয় তা বোঝার মতো মানসিকতা আমার আছে। যারা নোংরা কথা বলছেন সুপ্রীতিকে আর উইমেন চ্যাপ্টারকে, তাদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যাঁরা যৌক্তিক সমালোচনা করছেন লেখাটির, তাঁদের লেখা পড়া ও লেখার উত্তর দেবার কিছু থাকলে যৌক্তিকভাবে দেওয়ার অনুরোধ সবার প্রতি।
কেন তাঁরা লেখার সমালোচনা করেছেন? কারণ তাঁরা উইমেন চ্যাপ্টারকে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে দেখতে চান। গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করতে পারাটাও একটি দক্ষতা। উইমেন চ্যাপ্টারের পাঠক, লেখকদের এটা ভাবার প্রয়োজন নেই যে গঠনমূলক সমালোচনার উদ্দেশ্য সুপ্রীতি বা উইমেন চ্যাপ্টারকে হেয় করা।
এখন আসি সুপ্রীতির এই লেখাটি সম্পর্কে আমার মতামত নিয়ে। জানি এটা পড়ার পর অনেকেই, সুপ্রীতিও হতে পারে, আমাকে ভুল বুঝতে পারেন। আমি আমার কথা বলি, লিখি আমার একান্ত ব্যক্তিগত চিন্তা, বোধ থেকে। তবে যা লিখি প্রথমে তা বিশ্বাস করি, পালন করি, পরে লিখি। আমি বরাবর আত্মসমালোচনায় বিশ্বাসী। আমি আমার সবচেয়ে বড় সমালোচক। আমার কোন অসুবিধে হয় না নিজের খুব কাছের মানুষকে তাঁর ভুল ধরিয়ে দিতে। আমার জীবনের দীর্ঘ সময় শুধু দেখেছি, বুঝেছি, জানার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুই প্রায় বলিনি। এখন বলি, অনেক বলি।
একবার আমার জীবনের পথচলার সংগী আমার নিজের ভাইকে বলেছিল আমারই সামনে আমার বিষয়ে কথা প্রসঙ্গে,” ও এতোটাই নিরপেক্ষ, নির্মোহভাবে অন্যায় বা ভুলের কথা বলতে পারে যে, যে ওকে জানে না সে প্রথমে ধাক্কা খাবে।” ক’দিন আগে অন্য প্রসঙ্গে বলেছে আমাকে, আমি এতোটা নিরপেক্ষ ভাবে ভুল, অন্যায়কে চিহ্নিত করি, ভাবি, বলি, অথচ সেই ভুল করা মানুষের প্রতিও মানবিকতার বিষয়ে কোন ছাড় দেই না।
এটা না কি আমার বিশেষ গুণ! কেন নিজের গুণগাণ করছি? কারণ এখন আমি সুপ্রীতির লেখার সমালোচনা করবো। এটা অন্য কেউ লিখলেও একই কথা লিখতাম তা বোঝানোর জন্য এতো কথা বললাম। প্রথমেই আসি হেডিং নিয়ে। ভীষণভাবে অপছন্দ করেছি। সেটা যে ভুল ছিল তা ও স্বীকার করে পরে লিখেছে। লেখার মধ্যে ও ওর এবং অন্যান্যদের সাথে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা শেয়ার করেছে।
প্রথমেই আসি, শিশুদের সাথে পৃথিবীর সব দেশে সব সমাজে সব “শ্রেণী”-তে অমানবিক ঘটনা ঘটেই চলেছে। উচ্চ শিক্ষিত থেকে শুরু করে অশিক্ষিত সব ধরনের মানুষের মধ্যে শিশু নির্যাতক আছে। শারীরিক, মানসিক, যৌন সব সব ধরনের নির্যাতন হয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্যাতিত গোষ্ঠী নারী নয়, শিশুরা। এই শিশুদের মধ্যে নারী এবং পুরুষ শিশু আছে। সে অর্থেই নির্যাতিতদের সংখ্যায় নারীকে অতিক্রম করে যায় শিশুরা। সবচেয়ে ভালনারেবল হচ্ছে শিশুরা। অনেকে জানেই না তারা নির্যাতিত হচ্ছে। নারী যেমন প্রেমিক, বর, বাবা, ভাই থেকে শুরু করে অচেনা যে কোন পুরুষ দ্বারা নির্যাতিত হতে পারেন, শিশুদের ক্ষেত্রে তার সাথে আরেকজন যোগ হতে পারে, তিনি হচ্ছেন নিজের মা।
ধাক্কা লাগলো বুঝি? রিক্সাচালক যেমন বৌকে পিটিয়ে, (সব রিক্সাচালক নয়) তাঁর প্রতি পৃথিবীর সব অন্যায়ের প্রতিশোধ নেন, সেভাবে অনেক মা সমস্ত অন্যায়ের প্রতিশোধ নেন একটু চঞ্চল থেকে শুরু করে “হাড় জ্বালানো ছেলে বা মেয়ে ” পিটিয়ে। এখানে কাজ করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সবলের ব্যাপার। সব বাবা-মা সন্তানকে পিটান তা অবশ্যই বলছি না। কেউ আবার ভেবে বসেন না ব্যক্তিগত ভাবে আমি মার খেয়েছি তাই লিখছি!
যখনই কোন শিশু “গৃহকর্মী”-র অত্যাচারের কথা আসে তখনই জানা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্যাতক একজন নারী। কারণ, নারীই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংসার দেখেন। একথায় অনেকেই ভাবতে পারেন, নারীই তো একজন বড় নির্যাতক। কেন নারীটি নির্যাতক? এটা বুঝতে হলে আরও গভীরে ভাবতে হবে। ঐ যে হাজার বৎসর ধরে পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার, সে নিজেই সেই সিস্টেমের অংশ হয়ে গেছে! ঠিক সেভাবেই “গৃহকর্মী”দের দিয়ে গৃহের শিশুটির নির্যাতন, শারীরিক-মানসিক-যৌন, অবহেলা ইত্যাদি সব কিছুর উত্তর পাওয়া যাবে।
শিশুটি এখানে “দুর্বলের” প্রতীক। যদিও সে “ক্লাস” সিস্টেমে অনেক উপরে! একই ভাবে অসুস্থ, বৃদ্ধ মানুষও “ক্লাস” সিস্টেমে অনেক উপরে হয়েও “দুর্বল” হওয়ার কারণে নির্যাতিত। কজ নিয়ে কথা না বলে কেবল ইফেক্ট নিয়ে কথা বলে বেশী দূর যাওয়া যায় না! কর্মজীবী মায়েরা শিশুদের “গৃহকর্মী”র কাছে রেখে যান, বাধ্য হোন তা বুঝতে আমার কোন অসুবিধে নেই।
যে যুগে হাতে গোণা ক’জন নারী ঘরের বাইরে যেতেন সেযুগ থেকে আমার মা কর্মজীবী ছিলেন। কিছুদিন আগে পঞ্চাশ বৎসর পার করেছি আমি। আমার দু’বৎসর বয়স থেকে আমার মা কর্ম জগতে প্রবেশ করেন। না কোন যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠিনি। আমার মায়ের কাজ ছিল সক্কালবেলা থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত। মাসে একাধিকবার ঢাকায় যাওয়া, অনেকবার বিদেশে যাওয়া। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অন্য সময় লিখবো হয়তো। বাংলাদেশে অনেক বৎসর আগেই সময় পার হয়ে গেছে শিশুদের ডে-কেয়ার, একটু বড় বাচ্চাদের আফটার স্কুল কেয়ার সেন্টার নিয়ে কাজ নয়, আন্দোলন করার। অশিক্ষিত, কোন ধারণা নেই শিশুর লালন পালনের এমন মানুষের কাছে বাধ্য হয়ে নিজের সবচেয়ে বড় ও দামী পাওয়াকে রেখে যাবার আগে জানতে হবে না কার কাছে রেখে যাচ্ছেন?
উন্নত সমাজে লাইসেন্স লাগে শিশু রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নেবার জন্য। ট্রেনিং নিতে হয়। তারপরেও অনেক সময় অনেক অপরাধ ধরা পরে। আর অদক্ষ বেবী সিটারের কাছে কিছু সময়ের জন্য বাচ্চা রাখতে হলে নিজ দায়িত্বে রাখতে হবে। একটি বাচ্চাকে সারাদিন একা একা সামলানো কী জিনিস তা প্রবাসী মাদের, ক্ষেত্র বিশেষে বাবাদের, জিজ্ঞাসা করুন। বাচ্চাদের ছোট্টবেলা থেকে গুড টাচ ব্যাড টাচ শেখানো কতটা জরুরি, তা আর কতবার লিখবো!
আর যে শিশু বুঝেই না, বলতেই পারে না তাকে নিয়ে এ’দুশ্চিন্তা সব স্থানেই সব দেশেই, কম আর বেশী, এই যা! গৃহকর্মীর শয্যায় নিজের বরকে আবিষ্কার যদি কোনো নারীর জীবনে ঘটে, তাহলে বলতে হবে চরম ধাক্কা খেয়ে জানলেন সে কখনোই পুরোপুরি আপনার নয়, হয়তো ছিল একসময়। এখন আর নয়। এখানেও সেই ইজি টার্গেট! এজন্য কেউ যদি সেই গৃহকর্মীকে দোষ দেন তাহলে বুঝতে হবে ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক বা আচরণকে ধর্ষণের “কারণ” হিসাবে দেখানোর মানসিকতা!
সুপ্রীতি গৃহকর্মীদের অমানবিক আচরণ নিয়ে লিখেছে যা অবশ্যই লেখার বিষয় হতে পারে, লিখবে। এটা নিয়ে ভাবতে হবে, করণীয় যা যা তা করতে হবে। কিন্তু লেখার ভাষা, কিছু বিষয় এবং সর্বোপরি সময়টা সঠিক হয়নি। সেই বাচ্চা মেয়েটির প্রতি অন্যায়ের বিচার নিয়ে এখন সবার কথা বলার কথা ছিল। যা সুপ্রীতি করেছে ব্যক্তিগতভাবে। অথচ ফেইসবুক ছেয়ে গেছে সুপ্রীতিরই লেখার সমালোচনায়! সময়টা বড়ই ভুল হয়েছে।
আর বারে বারেই বলি আবারও বলছি, ইফেক্ট নিয়ে কথা বলেন, বলবেন, সব ঠিক আছে, কিন্তু কজগুলো সঠিক ভাবে চিহ্নিত না করলে বেশী দূর যাওয়া যাবে না। মানুষের জীবন একটিই। ভিন্ন মত নিয়েই সুন্দর একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা যায় না?