সুপ্রীতি ধর:
আমার একটা লেখা নিয়ে বন্ধুমহলের অনেকেই কষ্ট পেয়েছেন, সমালোচনা হচ্ছে। আমি এটা পজিটিভলিই নিচ্ছি, কারণ ভুলটা আমারই হয়েছে। শিরোনামটা মোটেও ঠিক হয়নি, স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু এটা ভাবা ভুল হবে যে, শিশু নির্যাতক আয়শা লতিফকে বাঁচানোর জন্য আমি এ লেখা লিখেছি।
আমাকে যারা জানে, তারা এটা ভাবলে এর চেয়ে কষ্টের কিছু হবে না। আমি শুধু দুটো উদাহরণ এনেছিলাম যে, মুদ্রার অন্য পিঠও থাকে। কিন্তু তার মানে নির্যাতনকে জায়েজ বলিনি। উইমেন চ্যাপ্টারেই আমার লেখাটা ছাড়াও আরও তিনটা লেখা হয়েছে, এবং সেগুলোও আমারই লেখা। এবং সম্ভবত প্রথম অনলাইন কোনো পোর্টালে এখানেই বিষয়টি নিয়ে লেখা হয়েছে।
কাজ করলেই ভুল হয়, ভুল হয়ই। যারা কাজ করে না, তাদের কোনদিন কোন ভুল হয় না। এটাই চরম সত্যি। আমিও একহাতে কাজ করি বলে ভুল হতেই পারে। সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আমি যখন যে হাউজেই কাজ করেছি, প্রচুর কাজ করেছি নেশা থেকেই, পেশার জন্য নয় যতোটা। এবং সেইসব কাজেও ভুল হতো। যারা কাজ করতো না, তারা বসে বসে সেইসব ভুল ধরিয়ে দিতো বসের কাছে। এমনই হয়।
তবে একটা মারাত্মক ভুল যেমন আমি করেছিলাম একজন শিল্পীর বাসায় গৃহকর্মির আত্মহত্যার ঘটনা বেমালুম চেপে গিয়ে। একজন সাংবাদিক হিসেবে ‘বন্ধুত্ব’টাকে মোটেও প্রশ্রয় দেয়া তখন ঠিক হয়নি আমার। একটা লাইনও তখন লিখিনি, না পোর্টালে, না স্ট্যাটাসে। এজন্য কাছের অন্য বন্ধুরা এখনও পারলে কথা শোনায়। আমি শুনি। কথা তো সত্য। কাজেই এখন যারা বলছেন, আমি তাদের কথাও শুনবো। কিন্তু ভুল ধরতে গিয়ে তারা রীতিমতো আমাকে জেরা করছেন, এটা কতোটা ঠিক হচ্ছে, জানি না।
তবে আমাকে যারা চেনেন, জানেন, আমার এতোদিনের আন্দোলনের জায়গাটার কথা জানেন, তারা এতো সহজে যে উপসংহারে চলে আসতে পারলেন, তাই দেখে কিছুটা আশ্চর্যই হচ্ছি। যাকগে, এ আপনাদের ব্যাপার।
আমি আয়শা লতিফের নির্যাতনের কথা শোনার পরপরই তৎপর হয়েছিলাম। সেই রাতেই পল্লবী থানায় যোগাযোগ করেছিলাম, বাচ্চাটি তখন ওসিসিতে সেই কথা থানার ওসিই আমাকে জানিয়েছিলেন। তারপর সেখান থেকে মেয়েটিকে সিএমএইচএ নিয়ে যাওয়া হলো, পুরো ঘটনাটিই আসলে নজরে ছিল। এ নিয়ে দুদুটো লেখা তখনই ছাপা হয়। পরে নাদিয়া ইসলামের একটি লেখা, এবং আমার ভুলে ভরা (আপনাদের ভাষায়) লেখাটি। বিষয়টা অনেকটা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, সমালোচকদের কারও বাসায় কোনো শিশু গৃহকর্মি নেই, থাকলেও তারা রাজার হালেই আছে, যেমন আছে সমালোচকদের গর্ভজাত সন্তানেরা। তাইতো?
মোটেও নিজের ভুলের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য বলছি না, এক বন্ধুর ছোট্ট বাচ্চার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা আমি নিতে পারছিলাম না একইভাবে। সেজন্যই এরকম একটি লেখার অবতারণা। আমি যদি আমার বাচ্চাদের সাথে সংঘটিত ঘটনার বর্ণনা দেই, তাহলে পুরো পোর্টাল জুড়ে লিখতে হবে সেই কাহিনী। একটা কথাই বলবো, আমি দুটো পিঠই পেয়েছি। বেশি পেয়েছি গৃহকর্মিদের ভালো দিকগুলোই। ওরা আমার জীবনের অংশ, আমার পরম আত্মীয়। আমার নির্বান্ধব, একাকি জীবনে ওদের সহায়তা ছাড়া দু’দুটো বাচ্চা নিয়ে একসাথে একটি চাকরি এবং আরও দুটি কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না মোটেও।
ওদের অত্যাচার আমি সহ্য করেছি। কারণ বাধ্য হয়েছি। ওরা আমার ছেলেকে ছোটো অবস্থায় যেমন না খাইয়ে রাখতো, মারধর করতো, বাড়ির সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো, পোড়া খাবার খেতে দিয়ে বলতো, ‘খাইলে খাইবেন, না খাইলে নাই’, আবার এই ওরাই আমার একরাতে ভয়াবহ ব্লিডিংয়ের সময় বাথরুমে দাঁড়িয়ে থেকে রক্ত পরিস্কার করেছে দুহাতে, বিছানাজুড়ে রক্ত ধুয়ে দিয়েছে এতোটুকু ঘৃণা না করেই। রাতের পর রাত জেগেছে হাসপাতালের বারান্দায়। এরাই তো! এদের জন্য আমি গায়ের রং মিলিয়ে সুন্দর প্রিন্ট দেখে শাড়ি কিনে নিয়ে এসে বলি, ‘খালা, শাড়িটা কিন্তু প্রথমদিন আমি পরবো, এরপর আপনার’…তারা ভীষণ খুশি হয়। এই সেদিনই অনেক পুরনো একজন এসে আমার মেয়েকে বলে গেল, ‘আফা যখন বুড়া অইয়া যাইবো, আমারে খালি খবর দিও, আমিই থাকবাম তার সাথে তখন’। এ হচ্ছে আকলিমা। অনেকেই চেনে তাকে। আমি ডাকতাম সাংবাদিক আকলিমা বলে। কতো খবর যে পাওয়া যেত তার কাছে!
আমার বিপর্যস্ত জীবনে প্রচণ্ড চিৎকার করে যখন কাঁদতাম, আকলিমা গান ধরতো। ওর ভিতরে বাউল ভাব আছে। অনেকদিন সে মিরপুর মাজারে গান করতো। ওকে নিয়ে আমি স্টোরি পর্যন্ত করেছি প্রথম আলোতে। ওই মারতো আমার ছেলেকে আমার অজান্তে, আবার ঘরে ফিরে দেখতাম, সে ঘুমাচ্ছে আর তার বুকের ওপর আমার ছেলে ঘুমাচ্ছে। কী বলবেন এসব গল্পকে?
আবার ওর জন্যই বাসায় পুরুষ মানুষ আসতো না, ঝামেলা করতো কিছু না কিছু। পরে বুঝেছি, স্বামী পরিত্যক্তা আকলিমারও তো নিডস আছে, শরীর জাগে তারও। একেক জনের প্রকাশ একেক রকম। আমি ওকে ফেলে দেইনি কখনও। পরে যখন সে আবার বিয়ে করে সংসারি হয়, সিএনজি চালক জামাইকে নিয়ে এসে কতদিন আমার বাসায় রাতে থেকে গেছে! ছোট বোনকে দিয়ে গেছে আমার কাছে। যার বয়ো:প্রাপ্তি ঘটেছে আমার কাছেই। বাচ্চারা তিন ভাইবোনের মতোন করে বড় হয়েছে। প্ল্যানচেট থেকে শুরু করে ঘরের ভিতরে বস্তা দৌড়, ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে আলমারির গ্লাস ভাঙা, এসবই তিনজনের দৌরাত্ম্যে হয়েছে। তিনজনকে শাস্তি দিয়েছি একসাথে।
গল্প তো গল্প নয়, এসবই জীবন। এরকম কত গল্প যে আছে! আপনারা যারা আমার লেখায় ভুল বুঝেছেন, আমাকে ভুল বুঝেছেন, তাদেরকে বলছি, আসুন আমরা সমালোচনায় সময় না কাটিয়ে বরং সমাজ ব্যবস্থাটা পাল্টাই, সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ফ্রি করে দিই। তাহলেই আর শিশুশ্রম থাকবে না। তখন শিশু নির্যাতনের প্রশ্নও আসবে না। তনু হত্যার বিচার পাইনি বলে কী হয়েছে, আসুন আমরা সাবিনা নির্যাতনের বিচার দাবি করি। বন্ধ হোক শিশু নির্যাতন, আর বিশেষ করে বন্ধ হোক শিশু গৃহকর্মি নিয়োগ। ওদের লেখাপড়ায় ফেরত পাঠানো হোক, ওদের মা-বাবার ঘরে যেন অঢেল খাবার থাকে, সেই ব্যবস্থা করি চলুন। মূলে হাত দিতে হবে।
আবারও বলছি। আমার লেখার শিরোনামটা আসলেই ভুল হয়েছিল। চেঞ্জ করে দিয়েছি। কিন্তু ভিতরের গল্পগুলো সত্য। তাই লেখাটা তুলতে পারলাম না বলে দু:খিত। মুদ্রার দুটি পিঠই আমি দেখতে শিখেছি। তাই দেখি, এবং যা দেখি তা বলিও।
আয়শা লতিফের শাস্তি হোক, জরিমানা হোক, অন্যদের মতোন টাকা দিয়ে যেন মুখ বন্ধ করা না হয়। যেন আরেকটি শিশুও নির্যাতিত না হয়, আত্মহত্যা না করে। যারা আমরা মানবাধিকার নিয়ে বড় বড় বলি কপচাই, তাদের বাসায় শিশু গৃহকর্মি যেন না থাকে। আমার বাসায় আমি শিশু এবং বয়স্ক কাউকে কাজ করতে দেই না। তাদেরকে দিয়ে আমি পারি না কাজ করাতে। আপনারাও তাই করুন। নিজ ঘর থেকেই শুরু করুন পরিবর্তন। তারপর না হয় কথা বলি!!!!