নারী কেবল মাংসপিণ্ডে মোড়ানো ভোগ্যবস্তু নয়

ঈশিতা দাস:

পৃথিবীর সেই সব পুরুষকে বলছি, সেই সব মেয়েদেরকেও বলছি যারা পুরুষের দাস হয়ে তাদের সুরে কথা বলে, মেয়েকে ঘোমটার আড়ালে কেবল এক ভোগ্যবস্তু হিসাবে দেখতে চায়।

মেয়েদেরকে একদলা মাংসপিণ্ডের স্তুপে, পুরুষের শস্যক্ষেত্র ভাবা থেকে বের হয়ে আসুন দয়া করে। অনেকে আবার মেয়েদেরকে মাটির পাত্রের সাথে তুলনা করে বলে মেয়েরা হলো মাটির পাত্রের মতো। মাটির পাত্র অন্য জাতে ছুঁয়ে দিলে তা ফেলে দিতে হয়, ঘরে তোলা যায় না, মাটির পাত্র সহজলভ্য হওয়ায় সেটা খুব সহজে ফেলে জাত রক্ষা করা যায়। এসব ভাঁওতাবাজি থেকে বের হয়ে মূল্যবোধ গড়ে তুলুন দয়া করে।

আপনি যদি বাবা অথবা মা হয়ে থাকেন তবে আপনার কন্যা সন্তানের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন, যদি বাবা অথবা মা না হয়ে থাকেন তবে কল্পনা করেন, তারও একটা মন আছে যে তার ভাই, দাদা বা বন্ধুর মত খোলা মাঠে আকাশ দেখতে চায়, দলবেঁধে ঘুড়ি উড়াতে চায়, হা-ডুডু, গোলাছুট, ক্রিকেট, ফুটবল সবই খেলতে চায়, পাঁচটা ছেলের মতো সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়, আড্ডা দিতে চায় অনেক রাত অবধি বন্ধুদের সাথে, পার্টিতে গিয়ে নাচ-গানও করতে চায় তার স্বামীর মতো, পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বই পড়তে চায় নিরিবিলি, সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে চায় নিরাপদে।

মেয়েদেরকে একটা লোভনীয় শরীর ভাবা পুরানো অভ্যাস বদলে মন প্রাণ সমৃদ্ধ একটা উচ্ছল মানুষ ভাবার অভ্যাস গড়ে তুলুন পরিবার থেকে। দেখবেন সমাজটা এমনিতেই বদলে গেছে। দেখবেন, আপনার কন্যা সন্তান, আপনার বোন নিরাপদে স্কুল,কলেজ কর্মস্থল থেকে ফিরতে পারছে। দেখবেন টেলিভিশনে আর ধর্ষণ নিয়ে ব্রেকিং নিউজ আসছে না। পত্রিকার পাতা উলটে কোন বীভৎস মুখ দেখতে হচ্ছে না। 

ধর্ষণ কেবল জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন নয়, মুখে, অঙ্গভঙ্গিতেও ধর্ষণের মতো যথেষ্ট অসম্মান করা যায়, করেও থাকে। প্রায় প্রতিটি মেয়েই কোন না কোন সময় এর সম্মুখীন হয়। ইদানিং তো বাচ্চা, প্রতিবন্ধী শিশুও বাদ যাচ্ছে না। কতটা মূল্যবোধের অবক্ষয় হলে এটা সম্ভব, একটু অনুধাবন করার চেষ্টা করুন। ধর্ষণের কথা উঠলেই এক শ্রেণীর লোক পোশাক, অবাধ মেলামেশাকে দায়ী করে ধর্ষিতাকেই দায়ী করে। এটা সম্পূর্ণ ভুল। পর্দা নিয়ে চলা মেয়েটি, যৌবন যাকে স্পর্শ করেনি এমন মেয়েরাও কিন্তু ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

খালি গায়ে একটা পুরুষও তার প্রিয়তমার কাছে আকর্ষণীয়, জড়িয়ে ধরে আদর করার ইচ্ছা হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু পৃথিবীর সব পুরুষকে খালি গায়ে দেখলেই যদি আদর করতে ইচ্ছা করে তবেই তা অস্বাভাবিক। আমরা সেটাকে অপরাধ বলতে পারি। ধারণা করতে পারি সে নষ্ট, বিকৃত মনের। একই কথা পুরুষের জন্যও প্রযোজ্য। সুখের বিষয় হলো মেয়েদের শিক্ষাটা এভাবে গড়ে ওঠে যে তার এই ধরনের নিচু কাজ করতে রুচিতে বাধে বা ইচ্ছাই জাগে না।

বেশির ভাগ পুরুষ সেখানে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হীনমন্যতার পরিচয় দেয়।আবার পরিবারে, সমাজে প্রচলিত মেয়েদের শরীর নিয়ে বিদ্রুপ বাণী আওড়ায়, নিজের শরীর নিয়ে গর্ব করে বলে” বারো হাত শাড়িতেও ঢাকা যায় না তোমার শরীর, নারী। “লালায়িত জিহ্বা যদি পুরুষের সর্বদাই বের হয়ে থাকে, নারীর শরীরের দিকে তবে বারো হাত কেন, গোবিন্দের দেওয়া অফুরন্ত শাড়িতেও দ্রৌপদীকে উলঙ্গই দেখাবে।

যারা বাবা হয়েছেন, তাদের বলছি, ভাবুন আপনার আদরের মামনি পুরুষের লালায়িত দৃষ্টির ভয়ে পরতে পরতে উড়না পেঁচিয়ে রিকশা, ভ্যান,মটোর যানে চলছে,জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তাকে সব সময় তার শরীরের পোশাকের দিকে সচেতন থাকতে হচ্ছে। উদার প্রকৃতি দেখে একটু অসচেতন হলেই ঝরে যাচ্ছে কত প্রাণ। কাউকে আবার নার্ভ ড্যামেজ হওয়ায় কারণে,মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার করণে আজীবন পঙ্গুত্ব বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অনেকে আবার এই প্রসঙ্গে বলে থাকে মাথার উড়না গলায় রাখলে বিপদ তো আসবেই।

তাদেরকে বলছি, আমাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে চলতে হবে কেন? যাদের মোটামুটি সাধারণ জ্ঞান আছে তারা জেনে থাকবেন, হাড় সুস্থ রাখার অন্যতম উপাদান “ভিটামিন ডি” এর প্রধান উৎস সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি। যেটা সরাসরি তকের সংস্পর্শে আসতে হয়। পোশাক যেখানে বাঁধা হয়ে দাড়ায়।

একটা মেয়ে প্রকৃতির এই উদার দান থেকে বঞ্চিত হবে কেন? হরিণ যেমন তার মাংসের জন্যই নিজের শত্রু, মেয়েও কি তার শরীরের জন্য নিজের শত্রু? মোটেই তা নয়। কেবল পুরুষ ছেলে বড় হতে হতে পরিবার থেকে শিখতে থাকে সে তার বোনের থেকে আলাদা, বা মেয়েদের থেকে আলাদা। সে ইচ্ছে করলে সবকিছু করতে পারে, যেটা মেয়েরা করলে অশোভন দেখায়। আসলেই কি অশোভন দেখায়? নাকি দেখার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যর জন্য দেখায়? ভেবে দেখবেন।

পরিবারের শিক্ষার কারণেই সে নারীকে মন, প্রাণ এক সমৃদ্ধ স্বাধীন সত্ত্বা ভাবতে পারে না। কেবল পুরুষের ভোগ্যবস্তু বলেই চিনে। সেই  চোখে সে সম্মান দেখাতে পারে না। আমারও একটি যুবক ভাই আছে,আমি গ্যারান্টি সহ বলতে পারি,সে একাধিক দিন কোন মেয়ের সাথে থাকা সত্ত্বেও মনের সাথে সম্পর্ক গড়ে না উঠলে কোন ধরনের অসভ্যতা করবেনা।এটা আমি আমার পারিবারিক শিক্ষার উপর বিশ্বাস রেখে বললাম।
আপনার সন্তান ধর্ষিতা এই কথাটার চেয়ে আপনার সন্তান ধর্ষক কথাটাই নিকৃষ্ট এটা নিজের মনে স্থান দিন।এবং সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দিন।

ছেলে মেয়ে সমান,নারী পুরুষ সমান সুবিধা লাভের অধিকারী। নারী পুরুষ অবাধ মেলামেশা নিয়ে যারা সমালোচনা করে তাদের বলছি,শুধু ছেলে মেয়ে বলে নয়, প্রত্যেকটি আলাদা মানুষ, আলাদা জাতীর ভিন্ন ভিন্ন মত, ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ আছে,যা একত্রিত হলে ভাল কিছু সৃষ্টি  হতে পারে।

সুতরাং নিজেকে তৈরি করুন যথেষ্ট মূল্যবোধ দিয়ে, সংযমী করে, আত্মপ্রত্যয় নিয়ে। সন্তানকে গড়ে তুলুন একই শিক্ষা দিয়ে। দেখবেন বিশ্ব সংসারটা শান্তিতে ভরে উঠেছে।
দয়া করে প্রচলিত ধর্মের অজুহাতে বিতর্ক করবেন না। মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। সৃষ্টিকর্তা মহান হলে তিনিও এই মতের বাইরে নয়।

শেয়ার করুন: