সাদিয়া সুলতানা:
আমি বিকালে বা সন্ধ্যায় প্রায় দিনই হাঁটতে বের হই। দীর্ঘদিন ধরে অামার সাথে সঙ্গী হয়ে হাঁটে আমাদের ভাড়া বাড়ির কেয়ারটেকার হারুনের স্ত্রী মিলির মা। ত্রিশোর্ধ্ব মিলির মা হাসিখুশি, উচ্ছল মানুষ। তার শরীর বয়সের তুলনায় ভারি, তবে মিলির মায়ের চোখে-মুখে সবসময় অদ্ভুত এক সারল্য খেলা করে। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট মিলির মায়ের বড় ছেলে যে গার্মেন্টসে চাকরি করে তা নিজের চোখে না দেখলে অামি বিশ্বাস করতাম না। প্রায় বারো-তেরো বছর বয়সে মিলির মায়ের হারুনের সাথে বিয়ে হয়। মিলির মায়ের ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে, বড় মেয়েটা ক্লাস এইটে পড়ে, ছোট মেয়েটা ক্লাস ফোরে পড়ে।
ভদ্রমহিলার নাম মিলির মা’ই। অামি কখনো তার প্রকৃত নাম জানার চেষ্টাই করিনি। অামার বদলির চাকরি। যেখানেই যাই সেখানেই সাথীর মা, মিন্টুর নানী, শিলার মা, ময়নার মায়ের মতো সাথী পেয়ে যাই। যারা অন্যের নামে পরিচিত হতে হতে নিজের নামটাই ভুলে যায়। অামরাও কখনো তাদের প্রকৃত নাম জানতে চাই না। অাগে দুএকবার অাগ্রহ দেখিয়ে বুঝেছি, এতে তারা বিব্রত বোধ করে। অাজকাল অামিও অার তাই ওদের নাম জানতে চেয়ে ওদেরকে বিব্রত করি না। এই যে নতুন শহরে অাসা অবধি দেখছি, মিলির মাকে সবাই এ নামেই ডাকে। সবার মতো আমিও তাকে মিলির মা নামেই ডাকি।
একদিন দুজনে হাঁটতে বের হয়েছি। পদ্মার পাড়ে টি বাঁধে যাবো বলে পর্যটন মোটেলের সামনে যখন মোড় নিচ্ছি, তখন আমার হাত ধরে মিলির মা বললো,
-ভাবী, আপনের নাম কি সাদিয়া?
-হুম। অাপনার নাম?
মিথ্যে বলবো না, সেদিনই প্রথম আমার মিলির মায়ের নাম জানার কৌতূহল হলো, হাসিমুখে বললাম,
-আপনার নাম কী মিলির মা? ছি, ছি, কোনোদিন আপনার নামটাই শোনা হলো না!
লাজুক হেসে মিলির মা বললো,
-আমার নাম, অানোয়ারা। বাপজান অাদর কইরা ডাকতো, অানু।
কেমন যেন লজ্জা লাগলো অামার। অানু নামের সাথে কতই না ভালোবাসা জড়িত, সেই নামেই ওকে ডাকিনি কোনোদিন! এরপর থেকেই যেন অানু আর আমার মধ্যে বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়ে যায়। হুট করে আমার জন্য অানু বাটিতে করে আমভর্তা, অামের অাচার, পাকান পিঠা বা গ্রামের বাড়ি থেকে আনা ছাতু, জামরুল, আম ইত্যাদি নিয়ে আসে। কোনো কোনো বিকেলে অালসেমি করে আমি ফাঁকি দিতে চাইলে ও আমাকে জোর করে হাঁটতে নামায়। হাঁটতে হাঁটতে কোনো রিকশা আমার শরীর ঘেঁষে গেলে অানু রিকশাওয়ালার সাথে তীব্র রোষে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়,
-অই ব্যাডা, চক্ষে দেখ না! কত বড় মানুষ! জেলের ভাত খালি বুঝপি!
আবার ড্রেনের পাশ দিয়ে হাঁটলে ছো মেরে আমাকে সরিয়ে দেয়,
-অত বেদিশ ক্যান ভাবী! গাদায় পড়বেন! বেটি ছইল কোমর ভাঙলে স্বামী অাদর-সোহাগ করবো না আর!
স্বামী-সোহাগের কথা বলেই অানুর শ্যামলা মুখবর্ণে আলোর ছটা লাগে। আমিও বেশ আমোদ নিয়ে জানতে চাই,
-আপনার স্বামী বুঝি আপনাকে খুব সোহাগ করে?
-হয়। করে না আবার! এক ঘরে দুই মায়া-ছইল নিয়া শুই, বুইড়া শান্তি দেয় না। মাঝরাইতে টুক মারে। কনতো শরমের কতা, বিটিরা বড় হইছে যদি দেইখা ফালায়! হের কী লাজ-শরম আছে! কয়, চল বারান্দায় যাই।
বলেই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে অানু হাসে।
-বাপরে, যেই আনন্দ নিয়া বলতেছেন, আপনারও তো বিষয়টা ভালো লাগে মনে হইতাছে।
-হ। মিছা কমু না, ভালা তো লাগেই তয় কেইস ঘটলে অামারি তো মরণ!
আমি বেমক্কা প্রশ্ন করে বসি,
-কেইস মানে?
-দুরো, ভাবী যে কী কয় না! এতা বলে বোঝে না। কেইস মানে পেট বানানি।
অানুর চাপা কণ্ঠস্বর শুনে আমি কিছুটা বিব্রত হই। আমার প্রশ্রয়ে ওর কোনো আড়াল নেই আজ। নিজের জীবনের গোপনীয়তাটুকুর ভাগীদার ও আমাকে করছে অনায়াসেই।
-তো, আপনার বুড়ার যখন অত শখ তারে কন ব্যবস্থা নিতে।
অানু আঁতকে উঠে জিহবাতে কামড় দেয়,
-ওরে আল্লাহ! হেয় ব্যাডা-ছইল, খোঁজা হইব কীসের জইন্য?
-ক্যান হইলে অসুবিধা কী! আপনার তিন সন্তান। কদিন পর মেয়ের বিয়ে দিবেন, মেয়ের সামনে পেট বানায় ঘুরবেন? আর নিজের শরীরটা দেখবেন না? আপনার যা ওজন আর প্রেসার, এখন আরেকটা বাচ্চা হইলে কত দুর্গতি জানেন?
বেশি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছি বুঝতে পেরে নিজেকে সংবরণ করে বলি,
-ওকে ফাইন। সে না নিক। আপনি ব্যবস্থা নেন।
আমার কথা শুনে অানু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
-হেয় ওইসবেও রাজি না। কয় ছইলপইলের জনম বন্ধ করা আল্লার সাথে দিগদারি করা। তবু লুকাইয়া লুকাইয়া একবার ইনজিকশন নিছি, বড়ি খাইছি। শইলে ধরে না। মাথা ঘুরায়। খারাপ লাগে। তাই অহন আর কোনো রাস্তা না পাইয়া খালি আল্লা আল্লা করি। তয় আরেকবার যদি হেয় আকাম করে, এইবার নারকেলের গ্যাড়া অর পিঠে ভাঙুম।
-মানে কী!
-হয়। জানেন না ভাবী। একবার ইনজিকশন নিছি দেইখা সেই কী রাগ! আমারে নারকেলের গ্যাড়া দিয়া পিটাইছে। এই ডানা দুইটার মইদ্দে কালা দাগ পইড়া গেছিল। পায়ের রান দুইটার মইদ্দেও।
-ইস!
-সে আপনাকে মারেও! দুজনের তো খুব ভাব দেখি!
-ও আল্লা! পিটাইতো না! এক কালে তো এমনই আছিলও রোজ ভাত গিলনের লাহান আমারে পিটান লাগতো। অহন শহরে আইসা কমছে। কমছে কী, আর নাই’ই। অহন শহর বাড়িত পিটাইলে কইছি সোজা ভাবীর কাছে যামুগা। ডরে চুপ থাহে, ভাবী। বুঝছেন।
বলেই অানু খিলখিল করে হাসে। সেই হাসি দেখে আমার চোখে পানি আসে। আমার কাগজ কলমের শিক্ষা আর এতো বছরের লব্ধ ঠুনকো ব্যক্তিত্ববোধের কারণে আমি অানুর ব্যক্তিগত জীবনে আর প্রবেশ করতে পারি না। নিশ্চুপ হয়ে অানুর হাতে হাত রেখে পদ্মার পাড় ধরে হাঁটতে থাকি।
(লেখাটিতে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে)
মিলি’র মা যখন আমার বন্ধু ‘অানু’
শেয়ার করুন: