তামান্না ইসলাম:
মনে করুন কোনো দম্পতি দীর্ঘদিন ধরে নিঃসন্তান, তাদের কথা উঠলে, আমাদের বাঙ্গালি মন সব সময় হাহাকার করে ওঠে ‘আহারে তারা না জানি কত দুখী।’ তাই না? অর্থাৎ, আমরা সুখের যে সংজ্ঞা জানি, সে অনুযায়ী, বিবাহিত দম্পতির সুখ, জীবনের সফলতা নির্ভরশীল হলো সন্তানের জন্মদানের উপর।

তারপরে ধরুন, কারও ডিভোর্স হয়েছে। বা স্বামী বা স্ত্রী মারা গেছে। অবশ্যই কাছের মানুষরা ঘটনার সাথে সাথে সমবেদনা জানাতে পারে, কিন্তু কেউ ভাববে না ডিভোর্সি, বিধবা বা বিপত্নীক মানে তার জীবন সেখানেই ফুরালো। একজন অবিবাহিত মানুষের মতোই তাদের জীবনেও সমস্ত সম্ভাবনার দ্বারই খোলা আছে। তারা হয়তো নতুন সঙ্গী খুঁজে নিতে পারে বা চাইলে একাও থাকতে পারে। একা থাকা মানেই যে তার জীবন দুঃখ ভারাক্রান্ত বা সে জীবনে একজন পুরোপুরি ব্যর্থ মানুষ, তা নয়। বরং তার জীবন হয়তো অনেক বেশি শান্তিপূর্ণ, আর দশজন বিবাহিত তথাকথিত সুখী মানুষের চেয়ে।
সন্তান মাত্রই বাবা, মায়ের কাছে অনেক প্রিয়। সব বাবা, মাই চায় তার সন্তান সুখী এবং সফল হোক। কিন্তু বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সুখের সংজ্ঞা নাও মিলতে পারে। বাবা, মায়ের শেখানো সুখী হওয়ার থিয়োরি সন্তান বিশ্বাস নাও করতে পারে। সে একজন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। সেই আলাদা মানুষটি যখন পূর্ণ মানুষ হয়ে তার স্বাধীনতা মতো চলে, তখন বাবা, মা বা তাদের আশে পাশের মানুষের সুখের সংজ্ঞার বাইরে গেলেই, সে কারণেও বাবা মাকে দায়ী করা হয় এবং সেই সাথে বাবা, মায়ের জীবন কতখানি অসুখী বা অসফল, সমাজ সেটাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
অনেক চেষ্টার পরও কিন্তু সবার বাচ্চাই ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হবে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে তা নয়। সেই জন্য তার বাবা, মায়ের জীবন ব্যর্থ হবে কেন?
সমাজের শিখিয়ে দেওয়া এই সব সুখের সংজ্ঞাগুলো আমাদের জীবনকে প্রচণ্ডভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা নিজেরাও এই সব সংজ্ঞায় গভীর ভাবে বিশ্বাস করি, এর বাইরে আসতে ভয় পাই। আমরা নিজের কাছে, অন্যের কাছে প্রকাশ করতে ভয় পাই যে আমরা এই সব সংজ্ঞা অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই সুখী না।
কারণ তার মানেই হলো আমরা আমাদের জীবনের কাছে হেরে গেছি। আর তাই আমরা অবিরত সুখের অভিনয় করে চলি সমাজের কাছে, আত্মীয় পরিজন, বন্ধুদের কাছে। বিবাহিত জীবনে অসুখী থেকেও আমরা সেটা সব সময় ঢেকে রাখি, অর্থনৈতিক কষ্ট ঢেকে রাখি, সন্তানদের যেকোনো ধরনের ছোটখাটো ভুল থেকে শুরু করে সব ধরনের সমস্যাই আমরা ঢেকে রাখি, নিজেদের গভীর মানসিক সমস্যা, ডিপ্রেশন ঢেকে রাখি। এই সব কিছু ঢেকে রেখে আমরা সুখী হওয়ার অভিনয় করে চলি। সমাজের শেখানো ফরমুলা অনুযায়ী।
অথচ ভেবে দেখুন, আমার সুখের সংজ্ঞা নির্ধারণ করার কথা আমার নিজের। আমার নিজেরই সবচেয়ে ভাল জানার কথা কিসে আমি সুখী। সমাজের এই ভয় গুলো যদি আমাদের মধ্যে কাজ না করতো, তাহলে অনেক বেশি সুস্থ চিন্তা করতে পারতাম আমরা, অনেক বেশি যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। আমাদের জীবনটা কী তাহলে অনেক বেশি সহজ হতো না?
শেয়ার করুন: