প্রমা ইসরাত:
একটা গল্প বলি? গল্পের চরিত্র খুব কমন, মা–বাবা এবং সন্তান। এই গল্পে কোন নায়ক নেই, নায়ক দের জিততে হয় ,এই গল্পে কি কেউ জিতবে কিনা বলতে পারছি না। ছোট্ট একটি ছেলে, ধরে নিলাম তার নাম বাবলু। বাবলু ছোট থেকে ছবি আঁকতে ভালবাসে। মানুষ যেমন ভাত খায়, মানুষ যেমন হাই তোলে, মানুষ যেমন হাসতে জানে, বাবলু তেমনি আঁকতে জানে।
স্কুলে ভর্তি হয়ে বাবলু খুব খুশি। তার সবচেয়ে পছন্দের ক্লাস,আর্ট ক্লাস। বাবলু খুব চুপচাপ থাকে, নিজের কথা, নিজের অনুভূতি সে অত সহজে বলতে পারে না যেমন টা পল্টু পারে, যেমনটা বিল্টু পারে। পল্টু ,বিল্টু বেশ মনোযোগী, ভাল করে পরীক্ষায় । মিস ওদের কতো আদর করে। মাও ওদের আদর করে, সবসময় বলে ওরা কতো ভাল দেখো না, ওদের মতো হও।
বাবাও বলে ওদের মত হতে। বাবলুকে অবশ্য আর্ট মিস অনেক আদর করেন, বাবলুর ড্রইং সচেয়ে ভালো হয়, কিন্তু কী লাভ! ড্রইং এর নাম্বার আর বাংলা–ইংরেজি–অংকের নাম্বার বুঝি এক হলো!
সেইবার দাদু যখন জিজ্ঞেস করেছিল বাবলু স্কুলে তোমার কি ভালো লাগে? বাবলু মিথ্যে করে বলেছিল, অংক। রিফাত মামার ছেলে ‘বিঙ্গো’ বাবলুর চেয়ে বছর তিনেক বড় হবে, বেড়াতে এসে বাবলুর ড্রইং দেখে খুব হেসেছিল, বললো তুই কি মেয়ে নাকি রে, এই সব কী আঁকিস! রিফাত মামা সেদিন খুব হেসে হেসে বলেছিল, আজকাল বাচ্চাদের মাল্টি টাস্কিং করতে হয়, শুধু আঁকিবুঁকি করলেই হয় না, আইনস্টাইনও হতে হবে, রবীন্দ্রনাথ হতে হবে, আবার শচীন এর মতো ব্যাটও চালাতে হবে।
সত্যিই কি তাই! এতো কিছু কি বাবলু হতে পারে? বাবলু সবার সাথে খুব একটা মিশতে পারে না। পল্টু বিল্টু ক্যাপ্টেন হয়, বাবলুকে কেউ গ্রুপেও ধরে না। বাবলু তবু ওদের সাথে মিশতে চায়, বন্ধু হতে চায়। বাবলুর এই না মিশতে পারাটা বাবা– মাও পছন্দ করে না, বাবা একদিন এক অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিলেন সবাইকে নিয়ে। বাবলু চুপচাপ বসেছিল, আরো একটু ছোট হলে মায়ের আঁচলের কাছে ঘেষে থাকতো, বাবাকে তাঁর এক বন্ধুর কাছে বলতে শুনলো “ ভাই, বইলেন না, ছেলেটা হয়েছে একটা গাধা, কী যে করবো এটাকে নিয়ে”।
সেদিন বাবার কথায় মনটা খুব খারাপ হয়েছিল বাবলুর, আর ঐ দিন পরীক্ষার খাতায় যেদিন ভালো করতে পারলো না, মা তো ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল, বললো, “কী খাস না তুই? তোকে কী দেওয়া হয় না? পড়তে ভালো না লাগলে, এখন থেকে বাসার কাজ করবি, আর পড়ালেখা বাদ দিয়ে ড্রয়িং করতে দেখলে আঙ্গুল ভেঙ্গে দিব”।
এর পর থেকে বাবলু পড়ালেখায় আরো মনোযোগী, তার সমস্ত রঙ পেন্সিল, ছবি আঁকার খাতা, সবকিছু একটা ড্রয়ারে রেখে তালা মেরে দেয়। মা খুশি হয়, বাবলু শুধু মাকে বাবাকে খুশি দেখতে চায়। মাঝে মাঝে পড়তে পড়তে হাতের পেন্সিল বা কলম দিয়ে খাতায় কিছু একটা আঁকিবুঁকি করে, তারপর পাতাটা ছিড়ে ছুঁড়ে ফেলে ডাস্টবিনে।
বাবলু চরিত্রটি যদিও কাল্পনিক, কিন্তু সে আর কেউ নয়, আমাদেরই একজন। এমন অনেক অনেক বাবলু আছে যারা তাদের স্বপ্ন বা প্যাশন (passion) গুলোকে তালা মেরে রেখে দেয়। হয়তো কেউ কেউ নিজের স্বপ্নগুলোকে আবার আলোতে নিয়ে আসতে পারে। তারা অসাধারণ,তারা সত্যিই বিজয়ী।
এবার আরেকটা গল্প বলি এটা বাস্তব।
ঈদে আমার কাজিন সৌরভ ভাই-শ্রাবণদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য অনেক, সবার সাথে দেখা হওয়া, একটু ভাল সময় কাটানো, প্লাস নতুন বাড়ি দেখা। বাড়ি ডিজাইন করেছে শ্রাবণ নিজেই। সে আর্কিটেক্ট। খুব মুগ্ধ হয়েছি তাদের বাড়ি দেখে। চমৎকার ডিজাইন, খোলামেলা, আলো-বাতাসে পরিপূর্ণ একটা বাড়ি। বাড়ি তৈরিতে বেশ খরচ হয়েছে, কিন্তু আভিজাত্য প্রদর্শনের জন্য অনেকে বাড়ি করে থাকেন, এই বাড়ি সেরকম না। একটা শান্তির নীড়, যেখানে জীবন যাপন করা যাবে, বাস করা যাবে। বাড়ি ভর্তি লোক হলেও এই বাড়িতে ভালো লাগবে, কেউ একা থাকলেও এই বাড়িতে ভালো লাগবে। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মতামত, আমি একা থাকতে ভালোবাসি, পছন্দনীয় সঙ্গী না পেলে আমি একা থাকাকেই বেছে নিতে চাই, তাই হয়তো আমার এমন মনে হচ্ছে।
কিন্তু আমি অনেককেই বলতে শুনি যে, বাড়ি থেকে লোকজন চলে গেলে বাড়ি খালি হয়ে যায়, কিংবা বলে থাকে যে শূন্য বাড়ি। কিন্তু এই বাড়িটা এমন না। বাড়িটা জীবন্ত, এটার প্রাণ আছে। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্য বাড়ির মানুষদেরই ভূমিকা বেশি। আমার কাছে তাই মনে হয়েছে।
শ্রাবণদের বাড়ি দেখার আগ্রহ ছিল এবং আশাবাদ ছিল চমৎকার কিছু একটা দেখতে যাচ্ছি। ঠিক তাই হয়েছে। বাড়ি দেখে কেমন জানি একটা আনন্দ পেয়েছি। আনন্দটা হয়ত শুধু এই জন্য না যে সুন্দর একটা নান্দনিক কাজ দেখলাম,আনন্দটা অনেকটা এই জন্য যে শ্রাবণ এই বাড়ি ডিজাইন করেছে এবং এই জন্য তাদের বাড়ির সবাই তাকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ করে।
অথচ এই ছেলেটাকে আংকেল আন্টি একসময় মেডিকেলে পড়াতে চেয়েছিলেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, বিসিএস ক্যাডার, অর্থনীতিবিদ যেকোনো কিছুই সে হতে পারতো। কিন্তু সে তার প্যাশন খুঁজে নিয়ে সেটাই করেছে যেটাতে সে খুশি থাকে, নিজেকে খুঁজে পায়, বারবার আবিষ্কার করে। যার ফলাফল এই চমৎকার বাড়ি, সেই সাথে সে আরো অনেক কাজই করছে যার সবগুলোই খুব ভাল। সে তার জীবনের সবচেয়ে সেরা কাজগুলো করবে, তার প্রতি আমাদের সবারই এই শুভকামনা।
সবাই তাদের প্যাশন খুঁজে পায় না। আবার খুঁজে পেলেও নানান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট সামলাতে গিয়ে নিজের প্যাশন বিসর্জন দেয়। ছোটবেলার প্রাণচঞ্চল মানুষ বড়বেলায় মাছের চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কাঠখোট্টা মন নিয়ে নিজের অফিসের টেবিলে বসে, অনেক টাকা খরচ করে ব্যাংকক, মালদ্বীপ ট্যুর দিয়ে আসে, কিন্তু শান্তি খুঁজে পায় না।
প্যাশন খুঁজে পেয়েও সেটায়, নিয়োজিত না হতে পারাটা একটা ট্রাজেডি। এই সমাজের বেশিরভাগ মানুষ ছকে বেঁধে ফেলেন নিজেকে। একটা নির্দিষ্ট জীবন, একটা মাপমতো জীবন। বাড়ি হবে, গাড়ি হবে, বিদেশে ট্যুর দিতে পারবো, ভালো রেস্টুরেন্ট এ খাবার খেতে পারবো, লোকজনের সাথে নানান গল্প করতে পারবো, গল্প দিতে পারবো এই হচ্ছে জীবন। যারা সেই ছকে নিজেকে বাধতে চায় না, যারা নিজের স্বপ্ন গুলো কে কোন শেকল পড়ায় না তাদের গ্রহণযোগ্যতা আর কতটুকু? নেই বললেই চলে।
“জীবনে তুমি অনেক বড় হও” এই চাওয়া বাবা ,মা, আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী সবার। এই বড় হওয়ার ব্যাপারটি করতে গিয়ে কেমন একটা প্রতিযোগিতায় নেমে যাই আমরা। বড় হতে গিয়ে , অনেক বড় কাজ করতে চেয়ে, আমরা সেরা কাজটা করতে পারি না। আমরা ভুলে যাই ছোট ছোট কাজগুলোও সেরা হতে পারে। ছোট ছোট কিছু মূহুর্ত অসাধারণ হতে পারে। সেই মুহুর্ত গুলোতেও অসামান্য সুখি হওয়া যায়।
সেই যে একটা পূর্ণ চাঁদের জ্যোৎস্না রাতে নৌবিহারে গিয়েছিলাম, সেই যে অসাধারণ সুর্যডোবা দেখেছিলাম, সমুদ্রের বুকে ডুবে যাচ্ছে কুসুম কুসুম সূর্যটা। সবুজ ধানের ওপরে কমলা বিকেলটা যে হঠাৎ করে লাল-গোলাপি হয়ে উঠলো, যেন এক মুঠো রঙ উড়িয়ে দিল আকাশে। কিংবা সেই যে ঝুম বৃষ্টিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক কাপ চা খেয়েছি, রাস্তায় আটকে দাঁড়িয়ে মানুষের ছুটোছুটি দেখেছি সেই মূহুর্তগুলো, সেই অনুভূতিগুলো কি আমি কোন প্রতিযোগিতায় জিতে নিতে পারবো?
সাফল্য একটা অনুভূতি ছাড়া কি আর কিছু?
প্রত্যেক মানুষ আলাদা, আলাদা মনের, আলাদা ভাবনার, আলাদা ভাবে সীমাবদ্ধ, আলাদা ভাবে অসীম। কারো সাথে কি কারো তুলনা চলতে পারে?
“পৃথিবীতে সবাই জিনিয়াস;
কিন্তু
আপনি যদি একটি মাছকে তার গাছ
বেয়ে উঠার সামর্থ্যের উপর বিচার করেন
তাহলে সে সারা জীবন নিজেকে শুধু
অপদার্থই ভেবে যাবে”
—আইনস্টাইন।
লেখক: আইনজীবী