শৌনক দত্ত:
ধর্ষণের খবর শুনলেই আমি পুরুষের চেহারাটা টেনে নিয়ে আয়নায় ডুব দেই। আমি যে প্রতিদিন অবিশ্বাসী হয়ে উঠছি গোটা কতক পুরুষের জন্য তার ছায়া রোজ রোজ বেড়েই যাচ্ছে। মনের গহীনে ঘিরে আসে চেনা নারীর মুখ। তারা কেউ বোন, কেউ বন্ধু, কেউ সহযোদ্ধা।
তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে বড্ড ভয় হয়, কেননা তাদের বিশ্বাসী চোখের পাশে দেখি স্বরবর্ণের ‘অ এ অজগর আসছে তেড়ে’-র মতন অ বর্ণটি গিলে খাচ্ছে বিশ্বাস। আপনি কি কখনও ভেবেছেন প্রিয় নারীটির কাছে আপনিও আজ একটি সন্দেহের দৃষ্টি?
সুদীপ্তা চক্রবর্ত্তীকে আজ খুব মনে পড়ছে। অনেক বছর দেখা নেই। শুনেছি প্রেসিডেন্সিতে পড়ায় কয়েকবার গেছি, ওকে পাইনি। আমরা তখন কলেজ। সুদীপ্তার মা ও বাবা দুজনেই ছিলেন চাকরিজীবী, তাই সুদীপ্তার বাড়ি গেলে অধিকাংশ সময় সুদীপ্তাকে একাই পাওয়া যেত। দ্বিধাহীন সুদীপ্তা গ্রিলের তালা খুলে আমায় ও আমাদের ঢুকতে দিতো। ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা স্টাডিতে কাটিয়েছি, আড্ডা দিয়েছি। কখনো মনে হয়নি এই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ওর সরলতাকে কলঙ্কিত করি।
জানি গোটাকতক পুরুষ এই লেখা পড়তে পড়তেই আমার ও আমার সেই বন্ধুদের পুরুষত্ব নিয়ে অবজ্ঞার হাসি হাসছেন।ঠিক এই ভাবনাটাই আপনাকে তাড়িত করে, আমায় দেয় লজ্জা। একজন নারী হেসে হেসে তার খালি বাড়ির দরজা খুলে আপনায় ঢুকতে দিলো মানেই আপনি তাকে নোংরাভাবে ছোঁয়ার পারমিশন পাননি। কোনো নারীবন্ধু আপনার লেট নাইট পার্টিতে এটেন্ড করে আপনার সাথে বসে মদ খেলো, এর মানে এটা প্রমাণ করে না সে ‘সুলভ’, তাকে যা খুশি তা করা যায়।
তাহলে সমীকরণের যোগফলে আপনিও নষ্ট পুরুষ! এতো বছর পরে সুদীপ্তার সাথে যদি দেখা হয় সে কি সেই সরল বিশ্বাসেই বলবে, কী রে কেমন আছিস? বাড়িতে আসিস। নাকি আপনাদের মতো গোটাকতক পুরুষের জন্য সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলবে, ভালো থাকিস।
কেউ কেউ বলেন, পোষাক ঠিকঠাক পড়ছে না নারীরা। কেউ কেউ ধর্মহীনতা, অবাধ মেলামেশা, নারীর স্বাধীনতার দিকে প্রশ্ন তোলেন। মজার ব্যাপার হলো, যারা এইসব বলেন প্রকাশ্যে, মনের ভেতর তারাই নারীকে স্লিভলেসে কামনা করে কত রাত ভাসেন তা তারাই জানেন।
পোষাক, ধর্ম, চলাফেরা কিংবা স্বাধীনতা কোনটাই ধষর্ণের কারণ নয়, বরং আমরা পুরুষরা দিন দিন মূল্যবোধ হারাচ্ছি।অনেকেই সুনিশ্চিত করতে চাইছেন বিচার। বলছেন ধর্ষণের পরে দ্রুত বিচার হলে ধর্ষণকারীর সাজা হলে ধর্ষণ কমবে। কিন্তু শুধু বিচার ব্যবস্থা, রাষ্ট্র কিংবা ধর্ম দিয়েই ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না। পর্নো সাইট বন্ধ করে দিয়েও না। তার আগে আমার মনে হয় ঘর থেকে শুরু করা উচিত।
আমরা সন্তানের সামনে তার মাকে কিংবা বাবাকে যথার্থ মূল্যায়ন করছি কি? যথাযথ সম্মান দিচ্ছি কি? সন্তানের সামনে একে অপরকে বড় দেখাতে গিয়ে আদতে সন্তানের মনে অবজ্ঞার বীজ বুনে দিচ্ছি না তো সম্মানের বদলে?
নারী মানেই পণ্য ভাবার দিন ফুরিয়েছে। বরং তাকে মানুষ ভাবতে শেখার দিন এসেছে। আপনি যখন আপনার পুত্র সন্তানের সামনে দিনের পর মাস, বছর তার মাকে অসম্মান করে নিজের পৌরুষ দেখাচ্ছেন, তখন সেই ছেলেটি বড় হচ্ছে এই বিশ্বাস নিয়ে যে, নারী মানেই শুধু কাম আর সংসারের ভারবাহী। সে তখন ধরেই নেয় পুরুষ মানেই নারীর শরীর ও জীবনের মালিক। সে যখন খুশি তখন তাকে ভোগ করতে পারে, তার ইচ্ছেতেই নারীর ইহকাল-পরকাল। এই বিকৃত মস্তিষ্কের প্রজন্ম আমরাই তৈরি করছি।
একজন পুরুষতান্ত্রিক বাবার কন্যা যখন ধর্ষিত হোন, সে পিতা কি মরমে মরে যান না?
প্রভু না হয়ে প্রতিটি পুরুষ যেদিন সমান্তরাল আকাশের নিচে মানুষ হয়ে দাঁড়াবে। যেদিন প্রতিটি নারীর প্রতি থাকবে তার বিনম্র শ্রদ্ধা। সেদিনই হয়তো আরশি নগর থেকে আমায় লজ্জায় পালাতে হবে না। কোনো বান্ধবীকে ব্যাচেলার ঘরে ডেকে শুনতে হবে না অবিশ্বাসের আদলে ব্যস্ততার কথা। কোনো সহযোদ্ধা মাঝরাতে অফিস থেকে ফিরতে ভয় পাবে না আমার সাথে। কিংবা সেইদিন সব পুরুষের শরীরে দ্বিধাহীন হেঁটে যাবে অর্ধনারীশ্বর…….
বৃষ্টি বিকাল
১৪ মে,২০১৭