একজন যোদ্ধার ডায়েরি (৩য় পর্ব): আত্মগ্লানি!

tania morrshed
তানিয়া মোরশেদ

(উইমেন চ্যাপ্টার): মে ১৭, ২০১২, যে কোনো মৃত্যুই ব্যথিত করে। আর তা যদি হয় একজন মুক্তিযোদ্ধা স্কুল শিক্ষকের মিছিলে অংশ নেবার জন্য পুলিশের মারের কারণে! ঘটনাটি এখানেই শেষ নয়! তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় (পুলিশ করুণ সুর বাজিয়েছে) দাফন করা হয়েছে! আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের রিকশা চালাতে দেখি, কুলিগিরি করতে দেখি, ভিক্ষা করতে দেখি, বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালের বারান্দায় মৃত্যুবরণ করতে দেখি। তবুও আমাদের বিবেক ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু এখন আমরা তাঁকে তাঁর মৃত্যুর পরও অপমান করলাম! আমরা কী এই প্রহসন (রাষ্ট্রীয় মর্যাদা) বন্ধ করতে পারতাম না? মারা যাবার আগে কি ভাবছিলেন সেই মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক?
১৯৭১ -এ ১২ বৎসরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা লালু (বীর প্রতীক), ক’ বৎসর আগে যখন হাসপাতালের বারান্দায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি কি ভেবেছিলেন? তাঁর ছেলের সাথে কথা বলবার পর একজন আমাকে বলেছিল “আপা ও মুক্তিযুদ্ধ, ওর বাবার অবদান ইত্যাদি বোঝে না। বাবার উপর বরং রাগ আছে।” আমি তাকে বলেছিলাম যে, যার খাবার নেই তাকে মুক্তিযুদ্ধের মানে বোঝানো আরো পরের কাজ। আমি ভাবি, লালু যদি বেঁচে থাকতেন আর আবারও যদি মুক্তিযুদ্ধের মত যুদ্ধের প্রয়োজন হতো তিনি কি অংশগ্রহণ করতেন? কেন?
স্বাধীনতা আমাদের যা দিয়েছে সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু সেই অর্জন কি আমরা সবার কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি? খেটে খাওয়া মানুষ কি মুক্তির দেখা পেয়েছেন? ১৯৭১ -এর মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় অবদান গ্রামের সাধারণ মানুষ আর ছাত্র সমাজের। সেইদিনও একজন মুক্তিযোদ্ধা বলছিলেন (টিভির অনুষ্ঠানে), তাঁর সাথীরা প্রায় সবাই ছিলেন গ্রামের অশিক্ষিত মানুষ। অথচ ১৯৭১-এর পরেই শহরের শিক্ষিত সমাজ তাঁদের ভুলে গেলেন, দূরে ঠেলে দিলেন! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তখন হয়ে গেল “শিক্ষিত সমাজের”! আর এই শিক্ষিত সমাজ যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত তখন রাজাকাররা কিন্তু বসে থাকেননি। আর যেহেতু রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে একটি বাক্সে বন্দী করে চাবিটি হারিয়ে ফেলা হলো, তখন ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানোও আরো সহজ হয়ে গেল। আমি নিজে এই শিক্ষিত সমাজের অংশ। আমার যে ক’জন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের চেনা আছে তাঁদের যখনই দেখেছি মনে কষ্ট পেয়েছি। অথচ এই আমি এসএসসি পর্যন্ত আর এক শহীদের সন্তানের সাথে পড়েছি এবং কিছুই জানিনি! ছেলেটি খুব শান্ত এবং কোনোদিন বাবার কথা বলেনি বলে কী! না আমি এখন বুঝি, আমি জানিনি কারণ তার বাবা বুদ্ধিজীবী নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারী ছিলেন! একই কারণে হয়ত তার বোনটির আজও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো চাকুরি হলো না। আমি কখনো কোথাও কারো বিষয়ে সুপারিশ করা প্রচণ্ড অপছন্দ করি, কোনোদিন করিনি, সেই আমি আমার মা’কে দিয়ে অনেকবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে বলিয়েছি মেয়েটির যোগ্যতা অনুযায়ী একটি কাজ দিতে। জানামতে আজো হয়নি! আমি যে সেই স্কুলের সহপাঠির হাত ধরে ক্ষমা চাইবো তার বাবা সম্পর্কে না জানার জন্য তারও উপায় নেই। সে অনেক আগেই না ফেরার দেশে চলে গেছে!
ক’ বৎসর আগে (দেশে গিয়ে) জানলাম যে আমার মা’র অফিসের অতি চেনা ফজলু মামা একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমি হতবাক! মা বললেন যে, তিনিও জানতেন না অনেক বৎসর পর্যন্ত! আমার সন্তানকে তাঁর সাথে পরিচিত করিয়ে তাঁকে অনুরোধ করলাম মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে। তিনি বলতে থাকলেন আর অঝোর ধারায় আমার অশ্রু ঝরতে থাকলো, সবার সামনে! না জানার অপরাধে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি! তিনি যদি কোনো বড় পদে কাজ করতেন তাহলে কি আমার তাঁর এই পরিচয় পেতে এত বৎসর লাগতো?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.