কালশিটে দাগ নিয়েও দীপারা বাঁচে (শেষ পর্ব)

মালবিকা লাবণি শীলা:
৫.
দুজন দুজনকে ঠিকমতো বোঝার জন্যে প্রায়ই বের হয় দীপা আর মহসীন। কখনো উদ্দেশ্যহীন লং ড্রাইভ কখনো বুড়িগঙ্গায় নৌকায় ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নিজেদের হারিয়ে। কখনো চাইনীজ খেতেখেতে অর্থহীন কথায়। এরকম একদিন মহসীন হঠাৎ বলে বসলো,
– দীপু চলো আজ আমার দুজন বন্ধুর বাসায় যাই।
দীপা আপত্তি করবে কী, ও নিজেও চায় মহসীনের সাথে সবসময় লেপ্টে থাকতে। রাজী হয়ে গিয়ে দীপা বলে,
– ওদের জন্যে কিছু কিনে নেয়া উচিৎ না?
– আরে নাহ ওরা আমার ওই ধরনের বন্ধু না, সামাজিকতার ধার আমরা কেউই ধারি না। ওখানে গিয়ে কিছু খাবার আনিয়ে নেবো, পর্যটন থেকে একটা ভদকা নিলেই হয়ে যাবে। ভদকার নাম শুনে মনে মনে একটু উৎসাহিত হয়ে ওঠে দীপা। সেই কোনকালে ড্রিংক করেছে দীপা ঠিক মনেও নেই। টিএসসির পেছনে বসে পানির বোতলে মিক্স করা হুইস্কি খেয়ে আনন্দময় একটা ঝিমঝিমানি নিয়ে রুমে গিয়েই ঘুম দিয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু আগ্রহ থাকলেও আর খাওয়া হয়ে ওঠেনি। আজ সে তার হবু স্বামীর সাথে খাবে, কী যে একটা উত্তেজনা কাজ করছে দীপার ভেতরে!
একসময় ওরা গন্তব্যে পৌঁছোয়। দীপা ভেবেছিলো বন্ধুর বাসা বলতে বন্ধু-বন্ধুর বউ এরকম কিছু একটা হবে। কিন্তু গিয়ে দেখলো মহসীনের দুই বন্ধু একটা বাসা নিয়ে থাকে। দুজন ছেলে থাকলেই বাড়িঘর যে এলোমেলো হয় এই ধারণা ভুল প্রমাণ করলো এই বাসা। বেশ ছিমছাম পরিপাটি, একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এই পারিপাট্য সব সময়ের নয়। ওরা আসবে বলেই সাময়িকভাবে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়েছে দুই বন্ধু।
মহসীন এসেই হুকুম চালালো,
-দোকান থেকে চানাচুর সেভেন আপ নিয়ে আয়।
বাসার নীচের দোকান থেকে এসে গেলো সব। দীপা অবাক হয়ে দেখলো ওরা তিনটি গ্লাস নিয়ে বসেছে। দীপার কাজ হলো চানাচুর মেখে দেয়া। দীপা চুপচাপ তাই করলো। দু/তিন পেগ খাবার পর মহসীন ওদের দুজনকে কিছু টাকা ধরিয়ে বললো ,
– কাবাব আর নান নিয়ে আসবি ভালো রেস্টুরেন্ট থেকে।
ওরা বেরিয়ে গেলে মহসীন এগিয়ে আসে দীপার দিকে, বলে-‘
-তুমি একটু ট্রাই করবে?
দীপার আগ্রহ থাকলেও একটু উদাসীনভাবে বলে,
-কী হবে খেলে?
– তুমি রিলাক্স করতে পারবে, মুখে হাসি ফুটবে।  জানো আমি ওদের সামনে কেন তোমাকে অফার করিনি? আমি চাইনি আমার হবু বৌকে নিয়ে কেউ খারাপ ধারণা রাখুক।
বলে মহসীন দীপাকে জড়িয়ে ধরে গভীরভাবে একটা চুমু দেয়। দীপা চাইছে এই মুহূর্ত থমকে থাকুক। কী অসম্ভব ভালোলাগায় ভালোবাসায় ভরে যেতে থাকে ওর শরীর মন! একটা গ্লাসে ওকে ভদকা সেভেন আপ মিশিয়ে দেয় মহসীন। দু’একটা চুমুক দেওয়ার পরই মহসীন ওকে আবারও জড়িয়ে ধরে। আদরে আদরে অস্থির করে তোলে। বাধা দেবার কথা মনেও আসে না দীপার। প্রচণ্ড সুখে ডুবে যেতে থাকে, ভেসে যেতে থাকে ওরা দুজন।
৬.
বিয়েটা হয়ে যায় অনাড়ম্বরভাবেই। সমুদ্রের পাড়ে উচ্ছল কদিন পার করে আসে দীপা আর মহসীন। সংসার শুরু করে প্রবল উৎসাহে। হাসি, গানে, গল্পে মুখর দুজন রাতদিন। দীপার চোখে পড়েইনা মহসীনের দ্বিতীয় সত্ত্বা। বিয়ের কয়েক মাস পরে হঠাৎ একটি অপ্রিয় প্রসঙ্গ দীপাকে সুখস্বপ্ন থেকে হ্যাঁচকা টানে বাস্তবতায় নামিয়ে আনে। মহসীন চাইছে দীপা ওর নামের শেষে মহসীনের নাম ব্যাবহার করুক। কিন্তু দীপার বক্তব্য,
– আমার নাম, আমার পরিচয়, বিয়ে করে আমি আমার পরিচয় বদলাবো কেন?
কথা-বার্তার এক পর্যায়ে ভালো যুক্তি দেখাতে না পেরে মহসীন হঠাৎই হাত তোলে দীপার গায়ে। অভিমানী দীপা না খেয়ে অপমানে আর ঘটনার আকস্মিকতায় কেঁদে কেঁদে রাত পার করে, রাতে গেস্ট রুমে গিয়ে শোয় দীপা, গেস্ট রুমের দরোজা খুলে দুপুরের দিকে বেরিয়ে এসে দেখে, মহসীন খাবার ঘরে একগাদা ফুল আর চমৎকার একটি নতুন শাড়ি নিয়ে বসে আছে।
দীপা ভেবেছিলো কাপড় পাল্টে আপুর ওখানে চলে যাবে। মহসীনকে উপেক্ষা করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে দীপা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মহসীন এসে ওর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বলতে থাকে,
– আমি খুবই দুঃখিত দীপু , জানিনা কেন এরকম হলো। তুমি আমাকে মারো শাস্তি দাও, কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেওনা, তুমি না থাকলে আমি বাঁচবো না।
অনেক চেষ্টা করেও দীপা এড়াতে পারে না মহসীনকে। অভিমানে ঠোঁট কাঁপছে দীপার। কথা বলতে পারছে না ও। মহসীন দাঁড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। দীপার রাগ অভিমান সব ভেসে যায় ওর আদরে। অনুতপ্ত মহসীন দীপাকে ভালোবাসায় আদরে ভুলিয়ে রাখে। কয়েক সপ্তাহ কেটে যায় এভাবেই ।
মহসীনের কিছু বন্ধু আসে একরাতে, খাওয়া আর বেশ মদ্যপানের পরে ওরা চলে যায়। দীপা গ্লাস ধুচ্ছিল, মহসীন হঠাৎ ওর পাশে এসে তীব্র কণ্ঠে বলে,
-তুমি শফির দিকে এতো ঘন ঘন তাকাচ্ছিলে কেন?
দীপা আকাশ থেকে পড়ে,
-মানে?
মহসীন তীব্রতর কণ্ঠে বলে ,
– ন্যাকামি করিস না, তোর চরিত্র আমার জানা আছে, বিয়ের আগেই তুই অবলীলায় আমার সাথে শুয়েছিস, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার নামে বেলেল্লাপনা করেছিস, চাকরি করতে গিয়েও কাহিনী ঘটিয়ে এসেছিস, এসব আমি জানিনা ভেবেছিস?
রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়তে চায় দীপা। কিন্তু মহসীন এখন আর মানুষ নেই, ওর হাত থেকে গ্লাস পড়ে ঝনঝন শব্দে ভেঙে যায়, দীপাকে জোর করে  টেনে বিছানায় নিয়ে যায় মহসীন, আহত অপমানিত দীপা ধর্ষিতা হয় নিজের বিছানায়, নিজের স্বামীর কাছে। কাঁদার শক্তিও আর নেই ওর।
কদিন পর পরই এরকম ঘটতে থাকে। দীপা মুক্তি খোঁজে। এভাবে দুই বছর কেটে যায়। কারো কাছে অভিযোগ করতে ইচ্ছে করেনা দীপার, একদিন অত্যাচার চরমে ওঠে, সহ্যের সীমা পার হয়ে যায় দীপার, পরদিন দীপা খুব সহজ স্বাভাবিক থাকে মহসীনের সাথে, আবদার করে,
– চলো আজ আমরা দুজন খুব ড্রিংক করবো। দুটো গ্লাসেই  নিজের হাতে মেশায় ঠাণ্ডা পানি আর বরফ। দীপার মুখটা উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। সতেরো তলার বারান্দায় গ্রিল নেই। বেশি মদ্যপান করে চিৎকার করার অভ্যাস তো মহসীনের আছেই। আশেপাশের কেউ তো কখনো উঁকি দিতেও আসেনি! মাতাল হয়ে বারান্দা থেকে ঝাঁপ দেয়াটাও মহসীনের জন্যে অসম্ভব কিছু নয়। শুধু ঝাঁপ দেয়ার সাথে সাথে দীপাকে উদভ্রান্তের মতো পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে সাহায্য চাইতে হবে। থানায় ফোন করতে হবে, হ্যালো…আমার স্বামী মাতাল হয়ে বারান্দা থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়েছে…! উঃ এই মৃত্যুর একটু পাশেই অপেক্ষায় আছে দীপার জীবন। শুধু একটা ধাক্কা! আর কিছুই না.. মহসীনের চোখ ঘোলাটে হয়ে আসছে..দীপা আদুরে কন্ঠে বলে,
– এই, চলো না বারান্দায় গিয়ে বসি! কী চমৎকার রাত!
দুজন বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। আসলে দীপা এগিয়ে যায় জীবনের দিকে।

(শেষ)

আগের দুটো পর্বের লিংক:
শেয়ার করুন: