ধর্ষণ কি শেষ হয় ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড শাস্তিতে?

ঋতুপর্ণা মণ্ডল:

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা এতো অগ্রগামী, তবুও শারীরিক চাহিদার জন্য মানুষ তার হিংসরূপ বের করতে পিছপা হয় না। একসময় যে মানুষ জানোয়ার থেকে উত্তরণ থেকে হয়েছে তা ভুলতে পারে কী করে?

ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেই বা ধর্ষকের মানসিকতা আদতে কতটা পরিবর্তন হয়েছে? কথায় আছে, ‘অন্যায়কে ঘৃণা করো, অন্যায়কারীকে না’। এই সমাজের ব্যাধি অনেক গভীর আর ক্ষতগুলো যে আরও দগ্ধযুক্ত। সামান্য একটা প্রাণ নিয়ে এ রোগ সারবে না।

একজন নারী আর পুরুষের মধ্যে বিভাজন করে এই প্রচলিত সমাজ। একটি কন্যা সন্তানের যখন জন্ম নেয়ার পর থেকেই সেই পরিবারে দায়িত্ব শুরু হয়ে যায় তাকে নারী হিসেবে গড়ে তোলা। অন্যদিকে একই ক্ষেত্রে পুত্র ঘরে এলে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখানো হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। কোনো ভুল বললাম? একটা মেয়ের জন্য কিনে দেওয়া হয় পুতুল আর সংসার সংসার খেলার সরঞ্জাম। অন্যদিকে একটি ছেলেশিশুকে কিনে দেওয়া হয় ব্যাট, বল আর শুরু হয় তাকে ‘পুরুষ’ করে তোলার প্রচেষ্টা। স্বাধীনতা পাবে একজন, আর বদ্ধ দশা শুরু হয় মেয়ের।

লিঙ্গের জন্যই মানুষ ভেঙে তৈরি হয় নারী আর পুরুষ? এই লিঙ্গ বৈষম্য তো তৈরি করে দিচ্ছে পরিবারই। ধর্ষণের জন্য প্রধানত দায়ী ধর্ষক, কিন্তু কোনো নারীর ওপর শোষণ এবং শাসন কেমন হবে, তা তো লিখে দেয় তার পরিবার তার পার্শ্ববর্তী পরিবেশই। তাহলে কি ওই ধর্ষকের পরিবারও দায়ী নয় ধর্ষণের জন্য? 

একটা মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হয়, তখন তার সেই পিসি, মাসি, মা,বাবা, কাকুর খুব কষ্ট গলে পড়ে! করুণা হয় খুব, আর লজ্জাও লাগে। কিন্তু লজ্জা তো আপনাদের মানে ধর্ষকের পরিবারের হওয়া উচিত, কারণ এই পরিস্থিতি তো তৈরি করেছেন আপনারা! খুব যখন ঘৃণা হয় পুরুষ জাতির প্রতি তখন মনে হয়, পুরুষ জাতি ‘কুকুরের’ (স্যরি কুকুর বলাতে) থেকেও খারাপ। তাহলে এই মানুষ থেকে পুরুষ, তারপর কুকুর তৈরি করেছে কে? আমাদের এই সমাজ। তাই না কি! 

ধর্ষণের শিকার মেয়ের জন্য তাদের কষ্ট হয় না, কষ্টটা আসে মেয়ের যে আর ‘সতীত্ব’ নেই, এই ভেবে। এবার বিয়ে কীভাবে হবে! সমাজ কী বলবে, পরিবার পরিজন কী বলবে! কিন্তু sarcastically তাদের সমাজই দায়ী এসবের জন্য। কিন্তু উল্টা আজ তার দায় তুলে দেবে নারীর পোশাক আর আচরণের ওপর।

আর বিয়ের পর যখন একজন নারী একজন অজানা মানুষের সাথে দিনের পর দিন যৌন হেনস্থার শিকার হতে থাকে, তখন ধর্ষণ কি এর থেকে কম কিছু? আজও আমাদের দেশের মেয়েদের নিজের পছন্দ জীবনসঙ্গী চাওয়াটা অপরাধ। দু’দিনের চুক্তির মধ্য দিয়ে একজন নারীকে পুরুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়, আর হয় মহাউৎসব। তখন কোনদিনও কি ভাবে তাদের সন্তানের মানসিক, শারীরিক চাহিদা কী? তা শুধু প্রশ্নই থেকে যায়।
আসলে এই আমাদের সমাজ নামে জিনিসটাই আমাদের প্রতিবন্ধী করে রাখে।

শুধু যে ধর্ষণকারীর মৃত্যু হলেই এই সমাজের পরিবর্তন হবে, তা না। এজন্য সমাজের নৈতিকতার দরকার হয়। আমরা পশ্চিমী দুনিয়ার custom (প্রথা) র দিকে ঝুঁকলেও সমাজের ভিত্তি যে ভিন্ন তা মনে রাখা দরকার। যখন কোনো শিশুর বয়ঃসন্ধিকাল আসে তার মধ্যে তখন যৌন চাহিদা আর কৈশোরত্বের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব চলে। এসময় অশালীন ছবি আর যৌন চাহিদাকে কেন্দ্র করে নিজেরাই ডুবে যায়, আর তৈরি হয় আর এক মানুষ। তাই নৈতিক শিক্ষা আর মনীষীদের জীবনী জানাটা খুব দরকার এসময়, কারণ কূলের প্রয়োজন পড়ে দিকভ্রান্ত নাবিকের।

দ্বিতীয়ত, পুরুষ আর নারীর মধ্যে ভেদাভেদ পরিবারই তৈরি করে। পুত্র সন্তান মানে সিংহ আর কন্যা মানে মিনি বিড়াল শেখানো বন্ধ হওয়ার দরকার। সমাজের তো এই ভাবে ধর্ষকের খোলা বাজার তৈরি করার কোনো অধিকারই নেই। তা একজনের যৌনাঙ্গ কাটলে আর মৃত্যুদণ্ড দিলেও এই দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না। শুভ বুদ্ধিসম্পন্নরাই পারে ধর্ষণ নামে ব্যাধি নাশ করতে। মানসিকতার পরিবর্তন দিয়ে সমাজ পরিবর্তন তা দিয়ে তৈরি হবে সুরক্ষিত প্রজন্ম।

শেয়ার করুন: