আজাদের মা কি আজ একটু শান্তি পাবেন?

azad
মাঝের সুদর্শন ছেলেটাই আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘আজাদ’

আনিসুল হক: আজাদের মা আজকে কি একটু শান্তি পেতেন? রুমির আম্মা জাহানারা ইমাম, শহীদ জুয়েলের মা, শহীদ বদির মা, শহীদ আজাদের মা–তারা নক্ষত্রের মতো আকাশ থেকে তাকিয়ে আছেন বাঙলাদেশের দিকে?
বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা. এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা। স্বর্গ কি হবে না কেনা। বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না এত ঋণ?
১১ জুলাই আজাদের জন্মদিন। ঢাকার সবচেয়ে বড় লোক পরিবারের ছেলে মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদ। তাদের বাড়িতে হরিণ ছিল, সরোবরে সাঁতার কাটত ধবল রাজহাঁস, মশলার বাগান থেকে ভেসে আসত দারুচিনির গন্ধ। (ডাকে পাখি খোলো আঁখি, এই গানটার শুটিং হয়েছিল তাদের বাড়িতে)। আজাদ ক্লাস সিক্সে পড়ে, সেন্ট গ্রেগরি। ১৯৬০ এর দশক। আজাদের বাবা আরেকটা বিয়ে করবেন। আজাদের মা বললেন, তুমি বিয়ে করবে না, যদি করো, আমি একমাত্র ছেলে আজাদকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব। আজাদের বাবা আরেকটা বিয়ে করলে আজাদের মা সাফিয়া তার বালকপুতের হাত ধরে ওই রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ করেন এবং একটা পর্ণকুটীরে আশ্রয় নেন। ছেলেকে লেখাপড়া শেখান। আজাদ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করে।
তার বন্ধুরা যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, ফিরে এসেছে আগরতলা থেকে, ট্রেনিং নিয়ে। তার ঢাকায় গেরিলা অপারেশন করে। বন্ধুরা আজাদকে বলল, চল, আমাদের সাথে, অপারেশন করবি। তুই তো বন্দুক পিস্তল চালাতে জানিস। তোর আব্বার তো বন্দুক আছে, পিস্তল আছে, তুই সেগুলো দিয়ে অনেকবার শিকার করেছিস।
আজাদ বলল, এই জগতে মা ছাড়া আমার কেউ নেই, আর মায়েরও আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মা অনুমতি দিলেই কেবল আমি যুদ্ধে যেতে পারি।
মাকে আজাদ বলল, মা, আমি কি যুদ্ধে যেতে পারি?
মা বললেন, নিশ্চয়ই, তোমাকে আমার প্রয়োজনের জন্য মানুষ করিনি, দেশ ও দশের জন্যই তোমাকে মানুষ করা হয়েছে।
আজাদ যুদ্ধে গেল। দুটো অপারেশনে অংশ নিল। তাদের বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হলো। গেরিলারা আশ্রয় নিল।
১৯৭১ সালের আগস্টের শেষে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘেরাও করল ঢাকার ২১/২২ টি মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয়-বাড়িতে।
আজাদদের বাড়িতে গোলাগুলি হলো, কাজি কামাল (বীর বিক্রম, গত বছর মারা গেছেন) গুলি করে পালিয়ে যেতে পারলেন, কিন্তু আজাদ, ক্রিকেটার জুয়েলসহ অনেকেই ধরা পড়ল।
আজাদের মা আজাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন রমনা থানায়। বললেন, কী অবস্থা?
ছেলে বলল, খুব মারে, ভয় হচ্ছে কখন সব স্বীকার করে ফেলি।
মা বললেন, শক্ত হয়ে থেকো বাবা, কোনো কিছু স্বীকার করবে না।
‘মা, কত দিন ভাত খাই না। আমার জন্য ভাত এনো তো। খুব ভাত খেতে ইচ্ছা করে।’
মা ভাত নিয়ে গেলেন রমনা থানায়, গিয়ে দেখলেন, ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনোদিনও ফিরে আসেনি, এবং এই মা ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, এই ১৪টি বছর তিনি কোনোদিনও ভাত খাননি।
জুরাইন গোরস্তানে এই মায়ের কবর এখনও আছে, আর তাতে উৎকীর্ণ আছে– শহীদ আজাদের মা।
(আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাস থেকে কিয়দাংশ)

শেয়ার করুন: