বাদল সারেংয়ের ঘরে ফেরা

মনিজা রহমান:

কোনো এক বাদলা দিনে জন্ম হয়েছিল বলে মা তার নাম রেখেছিল ‘বাদল’। সে সময়ের কথা বলছি, তখন নাম শুনে বোঝা যেতো না সে হিন্দু নাকি মুসলমান? মানুষ তখনও এতো সচেতন হয়নি। ইসলামি বই দেখে নাম খোঁজার রেওয়াজ তখনও ছিলনা! বাদল, রতন, মানিক, ঝর্ণা, পুতুল, রত্না… যে কারো নাম হতে পারতো!

আমরা তাকে ডাকতাম বাদলদা। শীর্ণকায়, ছোটো খাটো একজন মানুষ। পুরো নাম বাদল সারেং। পোষাক আশাকে ফিটফাট থাকার চেষ্টা করতেন তিনি সবসময়। মাথায় ক্যাপ পরে থাকতেন ক্রমহ্রাসমান কেশ ঢেকে রাখার জন্য। কথা বলতেন খলবলিয়ে, অতি দ্রুত, সরল মানুষরা যেভাবে বলেন। কোনো মেকি ভাব, কায়দা তিনি জানতেন না।

বাংলার সাধারণ পরিবেশ থেকে উঠে আসা একজন সাধারণ মানুষ আমাদের বাদলদা। ভিনদেশে ব্যস্ততম নগরীতে থেকেও কখনও কেউ তাকে নামাজ কাজা করতে দেখেনি। তিনি হলেন প্রকৃত ধার্মিক, যে কারণেই একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ! জ্যাকসন হাইটসে বাঙালীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যেতো তাঁকে। একদম পিছনের সারিতে বসে দেখতেন মঞ্চের মানুষগুলোকে। কখনও তাঁর মঞ্চে উঠার ইচ্ছে হতো না। সেই সব অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যে দেখা হয়ে যেত আমার সঙ্গে। হাত তুলে জানিয়ে দিতেন, তিনি আছেন।

১৭ বছর এই শহরে একা একা কাটিয়ে দিয়ে অবশেষে বাদলদা ফিরলেন বাংলাদেশে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলো। সেইদিনও ছিল বাদলা দিন। সকাল থেকে টানা বর্ষণে বিপর্যস্ত নাগরিক জীবন। বৃষ্টিমুখর এক অপরাহ্নে যাত্রা করলেন বাদল সারেং।

এক-দুই বছর নয়, ১৭ বছর অপেক্ষা করেছেন বাদলদা একটা চিঠির জন্য। মনে মনে কত ভেবেছেন, একটা সোনালী সকালের কথা। জায়নামাজে বসে খোদার কাছে কতভাবে ফরিয়াদ জানিয়েছেন! শয়নে স্বপনে জাগরণে কতভাবেই না ডেকেছেন! কিন্তু সেই চিঠি আর আসেনি। আমেরিকার কোন প্রেসিডেন্ট তাঁকে এই দেশে বৈধভাবে থাকার অনুমতি দেয়নি।

অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে কাগজপত্রহীন বাদল সারেং ফিরে গেলেন পরিবারের কাছে। সন্তানের কাছে। যে সন্তানকে দেখে এসেছিলেন শিশু, সে এখন যুবক। বাবা, তাদের কাছে ছবিতে দেখা একজন মানুষ মাত্র। বাদল সারেং বিবাহিত জীবনের ৩০ বছরের মধ্যে ২২ বছরই কাটিয়েছেন বিদেশে। ১৯৮৭ সালে বিয়ের দুই বছর পরে জাপানে যান। সেখানে ছিলেন পাঁচ বছর।

বাদল সারেংয়ের জীবনে সাত সংখ্যাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জন্মেছিলেন ১৯৫৭ সালে। বিয়ে করেন ১৯৮৭ সালে। আর আমেরিকা ছাড়লেন ২০১৭ সালে। তাও আবার নি:সঙ্গ পরবাসের ১৭ বছর পরে।

আজ থেকে ৬০ বছর আগে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার কলুকাঠি গ্রামে জন্ম বাদল সারেংয়ের। সাধারণ মানুষের জীবন এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় না, যা ছিল তাঁর। স্বাধীনতার পরে তরুণ বয়সে ঢাকা থেকে রনরঙ্গীনি ও নারীকণ্ঠ নামে দুটি পত্রিকা বের করেছেন। কন্ট্রাক্টটরি করেছেন আর্মি, পুলিশ, বিডিআরে। মডার্ন হারবালের মালিক বড় ভাই আলমগীর মতি’র বিভিন্ন উদ্যোগে পাশে থেকেছেন। সবকিছু পিছনে ফেলে ভাগ্য অন্বেষণে এলেন নিউইয়র্কে। ভেবেছিলেন পরিবারের সবাইকে আনতে না পারলে কয়েক বছরের মধ্যে ফিরে যাবেন দেশে!

নিয়তি তাকে যেতে দিল না। নিউইয়র্কে আসার দুই বছরের মাথায় ব্রেন স্ট্রোক করেন তিনি। কোমায় চলে যান। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে ফিরে এলেও ডাক্তারের কড়া পর্যবেক্ষণে থাকতে হতো সবসময়। নিয়মিত টেস্ট, চেকআপ করতে হতো। অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে পরিবারের জন্য আবেদন করেন বাদল সারেং। কারণ তখন তাঁর শাখের করাতের অবস্থা। না পারেন বাংলাদেশে ফিরে যেতে। না এখানে থিতু হতে। বাংলাদেশে চলে গেলে তো আমেরিকায় আর ফিরতে পারবেন না। হারাবেন উন্নত দেশের চিকিৎসার বিনামূল্যে সুযোগ সুবিধা।

অসুস্থ বলে ফুড স্ট্যাম্প নিয়ে, সরকারি সুযোগ সুবিধা নিয়ে চলেননি বাদল সারেং। কাজ করে খেয়েছেন। ফাইভ গাইজ বার্গার চেইনশপের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন যাবার আগে দশ বছর। জ্যাকসন হাইটস থেকে ব্রুকলিন, ভোর পাঁচটায় বাসা থেকে বের হতেন। ছয়টা থেকে দুইটা পর্যন্ত কাজ। তুষারপাত, তুষারঝড়, বৃষ্টি, কুয়াশা- যাই হোক, সময় মতো কাজে পৌঁছে যেতেন। যে কারণে আমেরিকান মালিকরা তাকে পছন্দ করতেন।

বাদল সারেং প্রথম যে দোকানে কাজ করতেন, সেখানকার শ্বেতাঙ্গ মালিকের খুব প্রিয় ছিলেন তিনি। পরে দোকানটা বন্ধ হয়ে যায়। ওই মালিক বাদলদার চিকিৎসার জন্য অন্য আরেকজনের কাছে পাঁচ হাজার ডলার রেখে যান। অথচ সেই মালিকের সাথে কোনদিন আর দেখাও হয়নি তাঁর। ভালোবাসার প্রতিদান বুঝি একেই বলে!

বাদল সারেং ছিলেন সময়নিষ্ঠ, সৎ ও সত্যবাদী। স্পষ্টভাষণে অভ্যস্ত। আমেরিকা দেশটা তাই তাঁর পছন্দ ছিল। এখানে কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলায় না। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। নিজের দেশে স্পষ্টবাদী স্বভাবের কারণে সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারতেন না। প্রায়ই নানা জনের সাথে ঝগড়া লেগে যেত। কী আর করবেন! ১৭ বছর চেষ্টার পরেও এই দেশে বৈধ হতে পারলেন না। স্ত্রী-সন্তানদের আনতে পারলেন না। জীবনের অমূল্য ১৭টি বছর কাটিয়ে অবশেষে এক সুটকেস ওষুধ নিয়ে উড়াল দিলেন জন্মভূমিতে।

এই আকাশ ছোঁয়া ভবন আর পত্রে-পুষ্পে শোভিত শহরে কতজন ঘুরে বেড়ান এই বাদল সারেংয়ের মতো, কে তার খবর রাখে! ভিনদেশে অর্ধেক জীবন পরিবার-স্বজনহীন অবস্থায় কাটিয়ে দেবার পরে, হয়তো ফেরেন নিজের ঘরে। বাদল সারেংও সেভাবে ফিরে গেলেন। যাবার আগে ‘সবার উপরে’ সিনেমায় ছবি বিশ্বাসের সেই কালজয়ী সংলাপের মতো হয়তো বলতে পারতেন- ‘ফিরিয়ে দাও আমার সতেরটি বছর?’ বলবেন কার কাছে? কে আছে শোনার?

শরীয়তপুরের একটা জায়গা আছে, নাম সারিয়াকান্দি। ধারণা করা হয়, ওখানে অনেকগুলি পরিবার বংশ পরস্পরায় লঞ্চ-স্টিমার চালাতো। ওদেরকে বলা হয় সারেং। জাহাজেও কাজ করতো কেউ কেউ। আমাদের বাদলদার পূর্ব পুরুষরা এসেছিলেন সেই সারিয়াকান্দি থেকে। তাই তাদের বংশপদবী হয়েছে সারেং।

সারেংরা যখন নীল দরিয়ায় ঘুরে বেড়ায়, তখন একেলা নি:সঙ্গ রাত জাগে সারেং বৌ। বিবাহিত জীবনে ত্রিশ বছরের মধ্যে বাইশ বছরই স্বামী কাটিয়েছেন পৃথিবীর নানা বন্দরে। দুই সন্তানকে নিয়ে একা লড়াই করেছেন সারেং বাড়ীর বৌ। জীবনের শেষভাগে এসে অসুস্থ-রুগ্ন বাদল সারেং ঘরে ফিরলেন অবশেষে।

(ঈষৎ সংক্ষেপিত)

শেয়ার করুন: