মলি জেনান:
অফিস থেকে ফিরেই খবরটা পেলাম, তখন ঠিক চারটা বাজে। আমার বাবা মারা গেছেন।
আমার বাবা, যাকে শেষবার দেখেছিলাম আজ থেকে আট বছর আগে। ঢেউ খেলানো হাফ কোঁকড়া চুল, মুখে গোঁফ, ক্লিন সেভে আমার শিক্ষক বাবা ছিলেন আপাত দৃষ্টিতে সাদামাটা, কিন্তু অনন্য দৃঢ় ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ।
ঘরে ঢুকতেই মিনা বললো-
আপা, আপনার ছোট ভাই এসেছে; উপরের গেস্ট রুমে আছে।
এতোদিন পর কে এসেছে বুঝতেই পারছিলাম না। এটা একটা অভূতপূর্ব বিষয়! গত সাত বছরে আমার কাছে আমার পরিবারের কেউ আসেনি। অবশ্য শেষবার ইফতিকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর,, আমিও আর যোগাযোগের চেষ্টা করিনি।
কে এসেছে?
আপনার ছোট ভাই, অনেকক্ষণ হলো এসেছে।
ঠিক আছে।
আমি ঘড়ি দেখলাম সাড়ে তিনটা বাজে। এক অফিস কলিগের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা থাকায় আজ একটু আগে-ভাগেই অফিস থেকে ফিরেছি। বাথরুমে ঢুকলাম ফ্রেশ হওয়ার জন্য। মিনা দাঁড়িয়েই ছিল, ও হয়তো আমার মুখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছিল।
ছোট্টু আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। হঠাৎ ছোট্টু, কোনো খারাপ খবর নয়তো? শেষবার ইফতি এসেছিল সেও আজ থেকে সাত বছর আগে। তখন আমর চরম দু:সময়! বাবা-ই হয়তো পাঠিয়ে ছিলেন আমাকে ফিরিয়ে নিতে; চন্দন চলে যাওয়ায় ভেবেছিলেন তাঁর শর্ত হয়তো আমি পুরণ করতে পারবো। সহস্র সমুদ্রের ঢেউ আমার ভেতরে আছড়ে পড়লেও বুঝতে দিইনি, ইফতিকে ঠাণ্ডা মাথায়ই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।
-আপুনি, অনেক হয়েছে এবার বাসায় চলো। এখানে একা এভাবে কার জন্য পড়ে থাকবে?
-ইফতি, চন্দন আমায় ছেড়ে গেছে আর কখনোই ফিরবে না, তার মানে এই নয় যে আমি তোদের শর্ত পুরণ করতে পারবো; তোদের শর্ত রাখতে না পারলে কী করে যাই? আমার জন্য ভাবিস না, আমি ভালো থাকবো। তুই বাসায় যা।
তারপর থেকে আজ পর্যন্ত কেউ কখনো আমায় অস্থির হতে দেখেনি। কিন্তু আজ হঠাৎ খুব অস্থির আর অসহায় লাগছে- বাবা, মা, ইফতি সবার মুখ এক এক করে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমি ভুলেই গেছিলাম যে, আমার কেউ আছে; এতো প্রিয় মুখ। কোনো ভাবে হাত মুখ ধুয়ে উপরে ছুটলাম। গেস্ট রুমের দরজায় গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম, সোফায় মাথাটা নিচু করে অবসন্ন হয়ে যে বসে আছে তাকে কিছুতেই ছোট্টুর সাথে মিলানো যায় না। আট বছর কি অনেক দীর্ঘ সময়? ভেতরে ঢুকতেই ও উঠে দাঁড়ালো, হ্যাঁ ছোট্টুই তো, ডান ভ্রুতে কাটা দাগটা জ্বলজ্বল করছে। ও যেন কথা হারিয়ে ফেলেছে। আমি কাছে গিয়ে ওর দাগটাতে হাত বুলিয়ে বললাম-
-তুই কত বড় হয়ে গেছিস অথচ দাগটা আগের মতোই আছে। ইফতি, ইফতি কেমন আছে?
-ভাইয়ার একটা মেয়ে হয়েছে, ঠিক তোমার মতো।
-ইফতি বাবা হয়ে গেছে, বাহ! মা-মা কেমন আছে? আর আব্বু?
ছোট্টু আর নিজেকে ধরে রাখতে রাখতে পারলো না, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে কোনোভাবে আমার হাতটা ধরে বললো-
-আপুনি, তুমি বাড়ি চলো-
বুঝতে পারছিলাম বড় কোনো অঘটন ঘটেছে, মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত নিচে নেমে গেল। নিজেকে কোনো ভাবে শান্ত রেখে ছোট্টুকে সোফায় বসিয়ে দিলাম। ওর পায়ের কাছে বসে মুখটা দুই হাত দিয়ে ধরে বললাম-
-কী হয়েছে আমায় বল। আমি দেখলাম যন্ত্রণায় ওর মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল-
-আব্বু আর নেই-!
তিনটি শব্দ অথচ এত ভারী! আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ও আরও কী কী যেন বলছিল, আমি শুনতে পেলাম না- শেষবার দেখা বাবার মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে, দৃঢ প্রতিজ্ঞ একটা মুখ। সেদিনের কথাগুলো কোন সুদূর থেকে ভেসে আসছে-
তোর সামনে এখন দুটো পথ-
‘যা ঘটেছে, যাই ঘটেছে তা ভুলে সবকিছু পেছনে ফেলে আমাদের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করা এবং সব সময় যেমন ছিলি, তেমনি আমাদের সবার মাঝে আনন্দের উৎস হয়ে বেঁচে থাকা। অন্য পথটা হলো আমাদের সবাইকে পেছনে ফেলে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে তোর নিজের আনন্দ খুঁজে নেওয়া। এক্ষেত্রে তোর পড়াশুনা, থাকা-খাওয়া, টাকা-পয়সা কোনো ব্যাপারে আমাদের কোনো দায়িত্ব থাকবে না।’
আমি বাবার পায়ের কাছে বসে পড়লাম।
কতক্ষণ অমন ছিলাম জানি না, এক সময় ছোট্টু জোরে কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বললো–
-আপুনি তাড়াতাড়ি চলো, বেশি সময় নেই।
-কী হয়েছিল আব্বুর?
-তেমন কিছু না, কিছুদিন ধরে ঠাণ্ডা জ্বর ছিল। শেষের দিকে কাউকে সহ্য করতে পারতো না, শুধু ইমু ছাড়া।
-ইমু?
-ইফতির মেয়ে।
আমার অমন কঠিন ব্যক্তিত্বের বাবা জ্বর এলেই কেমন যেন ছেলেমানুষ হয়ে যেতেন। আদা-মরিচ দিয়ে ঝাল করে কখনো চাল ভাজা, কখনো চিড়া ভাজা আবার কখনো মুড়ি খেতে চাইতেন আর জোরে জোরে গান গাইতেন- “মনের কথা মনেই জানে তোমার জন্য সকল গেল” কিংবা “মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে আমি আর বাইতে পারলাম না।” আর আমাকে থাকতে হতো তার কাছে একটু না দেখলেই হইচই বাঁধিয়ে দিতেন।
-একদিন জ্বরের ঘোরে তোমায় ডাকছিলেন, কিন্তু মা যেই বললো, “ইফতিকে একবার পাঠাই” মার দিকে এক পলক তাকিয়ে ‘না’ বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। এর পর আর কারো সাথে কথা বলেননি।
আমি উঠে দাড়াঁলাম, মুহূর্তেই মাথার ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। আমার বাবা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আমায় ক্ষমা করতে পারেননি, আমাকে ক্ষমা করতে না পারার কষ্ট নিয়েই তাকে চলে যেতে হলো। কাউকে ভালোবাসা কি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ! যে সন্তানকে মানুষ অনেক স্বপ্ন আর ভালোবাসা দিয়ে ধারণ করে, তারপর পৃথিবীতে এনে তিল তিল করে বড় করে শুধু কাউকে ভালোবাসার অপরাধে তাকে পথে ছুঁড়ে ফেলা যায়? তাকে ক্ষমা না করতে পারার কষ্ট নিয়ে চলে যাওয়াটা কি অন্যায় নয়! সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে সহজ রাখার চেষ্টা করছি-
-আপুনি, চলো বেশি সময় নেই-
-হুম, তোর এখনই রওনা দেওয়া উচিত। আর দেরি করিস না্।
-তুমি!
-না ছোট্টু, আমি আব্বুর প্রাণহীন দেহটা দেখতে চাই না। কী হবে দেখে? আয় তুই এক্ষুণি রওনা দে।
-আপুনি!
-ছোট্টু, বেঁচে থাকতে যাকে দেখার, ডাকার অধিকার হারিয়েছি, মৃত্যুর পর তাঁর কাছে কী করে যাই? আমার (প্রাণবন্ত) বাবা আমার কাছে বেঁচে থাকুক। চল তোকে উঠিয়ে দিই-