প্রথমত অন্যায়ভাবে, কোন যুক্তিছাড়া, মানবতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাহাড়িদের গ্রামে অগ্নিসংযোগ, সেটাকেও ছাপিয়ে যে কারণটা বড় হলো, সেটা হচ্ছে আমার প্রাণপ্রিয় মাতার লংগদুতে তার বাপের বাড়িতে অবস্থান।
এক মুহূর্ত দেরি না করে মাকে ফোন দিলাম, ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই মায়ের কান্নাজড়িত কন্ঠ, আর অসহায়ের মতো বলতে লাগলো, “সেটেলাররা অলরেডি কয়েকটা পাহাড়ি গ্রামের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, এখনো এদিকে আসেনি, আমরা খুব ভয়ে আছি, খুব থমথমে পরিস্থিতি ” বলেই ফোন কেটে দিল।
আমিও অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম, আমি কী করতে পারি? না, আমার কিছু করার সামর্থ্য নেই, ক্ষমতা নেই। আমার হাত, পা, মাথা যেন থেকেও নেই। মানবতা যেখানে পরাজিত, সেখানে আমি তো নস্যি।
আর সম্বল শুধু নিউজ ফিডের দিকে তাকিয়ে থাকা।
এবার আসি মূল ঘটনায় (ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত)
>কোন এক বিশেষ (!!!) সেটেলার মারা গেছে,
>কে বা কারা খুন করেছে তাও কেউ নিশ্চিত নয়, প্রমাণ তো নেই,
>আর শুধু সন্দেহের বশে ক্ষোভ গিয়ে পড়লো পাহাড়িদের উপড়, যার ফলাফল হলো পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে হামলাসহ অগ্নিসংযোগ…. …
বিশেষ না বলে পারা গেল না, বিশেষ না হলে কী আর তার জন্য কোন কারণ ছাড়া পাহাড়ি গ্রামে আদিবাসীদের বসতভিটায় হামলা করে অগ্নিসংযোগ করে? যার জন্য সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি পুড়ে, যার জন্য সাধারণ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়েও নিরাপত্তা খোঁজে?
(শুনেছি, তিনি নাকি যুবলীগেরও কর্মী, ভালো তো, এমনেই সেটেলারদের যন্ত্রণায় আদিবাসীরা পারে না, তার উপড় আবার রাজনৈতিক প্রভাব!)আচ্ছা মানলাম খুন হয়েছে, কেউ না কেউ করেছে, তা কি আইনের সহায়তা নিয়ে অপরাধীকে খুঁজে বের করে কি শাস্তি দেয়া যায় না? আদিবাসীরা সবাই মিলে কি খুন করেছে যে তাদের সবার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে উল্লাস করে মানসিক শান্তি খুজঁতে হবে? ভাই, (থুক্কু…. কী বলতে যে কী বলে ফেলি, আপনারা আমাদের ভাই হবেন কীভাবে? আপনারা আমাদেরকে মানুষই মনে করেন না) খুব জানতে ইচ্ছে করে, আপনাদের রক্তে কোন জাতের হাইব্রিড উগ্রতা বিদ্যমান, যার দরুণ ন্যায় অন্যায়, যুক্তি তর্ক সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এই নারকীয় উল্লাসে মেতে উঠেছেন? রোজার মাসে এই আপনাদের সংযম? এটাই আপনাদের সংযমের নমুনা? (ভালোই তো আপনাদের সংযমের মহিমা আগুনের ফুলকি দিয়ে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে দিচ্ছেন!)
আসলে ব্যাপারটাই এমন, পাহাড়ে কোন সেটেলারের লাশ পাওয়া গিয়েছে তো হত্যা যেই করুক না কেন, তার দায়ভার যেন পাহাড়িদেরই, প্রমাণ হোক বা না হোক তার দায়ভার পাহাড়িদের উপর চাপানো হবেই, শুধু চাপাচাপির মধ্যে থাকলে অন্য কথা, এর সাথে চলতে থাকে ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ, হত্যা আরও যা যা পারা যায়, মোট কথা মানবতাকে সেন্ডেলের তলায় পিষে মারার জন্য যা যা করা দরকার তার কিছুই বাদ যায় না।
যাই হোক, এরপর যখন মায়ের সাথে আরেকবার কথা হয়, কী পরিস্থিতি জানতে চাওয়ার প্রতি উত্তরে অনেকটা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, আমরা জিনিসপত্র (জিনিসপত্র বলতে কাপড়চোপর) নিয়ে রেডি হয়েছি, আমি বললাম, কই যাবা? মা বললো, আপাতত জানি না, হয়তো পাহাড়ের ভেতর গহীন জঙ্গলে, এখানে থাকলে তো ঘরবাড়ির সাথে প্রাণটাও যাবে।
নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল, যে মা ছোটবেলায় তার মেয়ে ভয় পেলে চোখের পানি মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলতো, ভয় নেই মা আমি তো আছি, আর আমি এতোটাই অভাগা সেই মাকে জড়িয়ে ধরে অভয় দিয়ে বলতে পারছি না, মা তুমি ভয় পেয়ো না।
সেটেলাররা, তোমরা আর কী চাও? এটাই তো চেয়েছিলে নাকি? আজ মায়ের কাছে সন্তান অসহায় আর সন্তানের কাছে মা অসহায়, এখানেই তো আমরা পরাজিত, শুনেছো তোমরা?
আমরা তোমাদের কাছে পরাজিত হয়েছি ।
মানবতা হেরেছে তোমাদের কাছে।
সভ্যতা হেরেছে তোমাদের কাছে।
তোমরা জিতেছো…. তোমরাই জয়ী….।.
রাষ্ট্র, তুমি কি কিছু দেখেছো? দেখোনি তো না ? কিছু দেখার আগেই চোখে কালো কাপড় বেঁধে রাখো, হ্যাঁ?