চলুন, মগজে জমে থাকা বস্তাপচা ধারণাগুলো পাল্টাই

সুমু হক:

ধর্ষণ কিংবা ধর্ষকামিতা একটি বিশেষ ধরনের মানসিকতা, যা কিনা আমাদের সমাজ এবং সংস্কৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে।  সামাজিক কাঠামো, ধর্ম এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আইনের সীমাবদ্ধতাও এই প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে রাজনীতির নোংরা চাল হিসেবে এর ব্যবহারে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।  

আমাদের সমাজ এখনো নারীর শরীর, সেই শরীরের ওপর ব্যক্তি হিসেবে তার নিয়ন্ত্রণের অধিকারকে মেনে নেবার মত  সভ্য তে শিখলোনা। তাই আজও আমাদের চরিত্রের কিংবা বলা ভালো মরালিটির বিচার হয় একজন নারীর পোশাক, কোন একজন বিশেষ পুরুষের সাথে তার সম্পর্কের সংজ্ঞায় কিংবা সাধারণভাবে পুরুষসমাজের দৃষ্টির সামনে তার আচরণের ব্যাখ্যায়।

ভার্চুয়াল জগৎটাতেও তো ঘুরে বেড়াচ্ছে এই মানুষগুলোই, তাই না!

তাই আজও সমাজ এবং এই সমাজের প্রতিনিধিরা তাদের প্রতিটি আচরণে নারীকে বিচার করতে এবং প্রয়োজনে তারচরিত্রহনন করতে সমাজের ধর্ষকামী লেন্সটিকেই ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।

বাংলাদেশের সরকারি ক্ষমতাসীন দল এবং এই দলটির সমর্থক এবং কর্মীদের রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে সাইবার বুলিয়িংএর সাহায্য নেয়ার ঘটনা খুব আকস্মিক কোনো বিষয় নয়! গত কয় বছরে অসংখ্যবার এমনটা ঘটেছে, এর শিকার হয়েছেন উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদক সুপ্রীতি ধর এবং এই পোর্টালে যারা লেখেন, তাদের অনেকেই।

শুধু তাই নয়, শাহবাগ আন্দোলন এবং রামপাল প্রকল্পবিরোধী আন্দোলনসহ আরো অনেক আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে সরকারপক্ষের সমর্থকেরা অসংখ্যবার এমন সাইবার বুলিইং করে গেছেন।

তবে এবারকার ঘটনাটি মাত্রা ছড়িয়ে গেলো কারণ এর সাথে জড়িয়ে পড়লেন একজন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য।  ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে খুব ন্যক্কারজনকভাবে ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী তার দলবলসহ ঝাঁপিয়ে পড়লেন লেখিকা মুনমুন শারমিন শামসের ওপর।

তার পরের ঘটনা আমরা জানি। এও  জানি, যে সমালোচিত হবার পর এবং খুব সম্ভবত আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে পারেন এই ভয়েই ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী মুনমুনকে উদ্দেশ্য করে, মুনমুনের অনুমতি না নিয়ে তাঁর ফেসবুক একাউন্ট থেকে ছবি নিয়ে তৈরি করা নোংরা পোস্টগুলো তার দেয়াল থেকে সরিয়ে ফেলেছেন।

অনেককেই আক্ষেপ করতে শুনছি, একজন নারী হয়ে আরেক জন নারীর প্রতি ফজিলাতুন্নেসার এই আচরণ নিয়ে। না, সে নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই।

নেই, তার কারণ, নারী কেন, ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পীকে একজন বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবেও ভাবা যাচ্ছে না তার এই আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে। একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল এজেন্ডা সামনে এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে একটি দাবার গুটি হিসেবেই তিনি ব্যবহৃত হয়েছেন মাত্র।

ফজিলাতুন্নেসার এই আচরণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় চালিত হতে থাকা একটি রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রতিনিধির আচরণমাত্র।

বিশেষ করে যখন স্বয়ং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও এই ছকের বাইরে এসে নারীর অধিকারের পক্ষে এসে দাঁড়াতে পারেননি, তখন ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী তো কোন ছাড়!

আমরা প্রতিনিয়ত অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে এইরকম সাইবার বুলিইং এর শিকার হই।  

উইমেন্ চ্যাপ্টারে একটা লেখা প্রকাশিত হলো কিংবা জিন্স কী অন্য কোন পাশ্চাত্যের পোশাকে প্রোফাইল ছবি আপলোড করা হলো, তো সঙ্গে সঙ্গে ইনবক্স ভোরে যায় অশালীন আগ্রাসী প্রস্তাবে, আর ফিল্টার্ড হয়ে আদার ইনবক্সে জমা হওয়া ম্যাসেজগুলোর কথা না হয় নাইবা বললাম। সেগুলোর ৯৯% ভাগ কিন্তু আসে কোনো বাঙালি কিংবা দক্ষিণ এশীয় পুরুষের কাছ থেকেই।  

কিন্তু তাই বলে কিছু নোংরা মানুষের নোংরা মানসিকতার কারণে আমি কেন আমার স্বভাবের বাইরে আচরণ করবো!

শরীর আমার। আমি কখন সেটাকে ঢাকবো, কখন ঢাকবো না সে বিচার করবে এই নোংরা মানুষগুলো?

কেন?

কেন শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে যোগাযোগ করা সম্ভব বলেই বন্ধুত্ব নয়, সরাসরি অশ্লীল যৌনগন্ধী প্রস্তাব নিয়ে হাত বাড়াবে পুরুষেরা?

কেন আমার ব্যক্তিগত জীবনবোধ, লেখা, আমার ক্যারিয়ার কিংবা অন্য যেকোন অর্জন ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠবে আমার আমার শার্টের হাত, গলার ক্লিভেজ কিংবা স্কার্টের দৈর্ঘ্য ?

কেন শুধুমাত্র নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার সাথে সাবলীলভাবে মিশলেই একজন নারীকে সরাসরি অশালীন প্রস্তাব দেয়াটাকেই স্বাভাবিক আচরণ বলে ধরে নেবে সমাজ?

এমনকি একজন নারী একা কিংবা অবিবাহিতা বলেই ব্যক্তিগত বোঝাপড়া না থাকলে যে তাকে যথেচ্ছা সেক্সটিং করা যায় না, যাচ্ছেতাই প্রস্তাব দেয়া যায় না, এই বোধ কবে জন্মাবে আমাদের?

তাই বলছি, এইরকম শুধু বলবার জন্যেই ধর্ষণ এবং যৌন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা না বলে, চলুন, আগে নিজেদের মগজে জমে থাকা বস্তাপঁচা ধারণাগুলোকে পাল্টাই। সমাজ আপনিই পালটে যাবে।

নারীর চরিত্রকে শুধুমাত্র শরীরসর্বস্ব একটা ধারণা নিয়ে বিচার না করলে রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোন আক্রোশ বা উদ্দেশ্য চরিতার্থে তাতে কাদা ছিটানোরও সুযোগ থাকবে না আর !

আমার চরিত্র, সততা এবং ইন্টেগ্রিটির পরিচয় আমার কাজে, প্রজ্ঞায়, মননে। আমার ক্লিভেজ, উন্মুক্ত হাত কিংবা খোলা পায়ে নয়।

ধন্যবাদ!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.