ফারজানা আকসা জহুরা:
ইমিগ্রেশন আসতেই নামটা আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। প্রশ্ন করতেই ভদ্রলোক আমার ছবি আর পাসপোর্ট দেখে নিশ্চিত হলেন। না, জহুরা আহমেদ খান আমি। কিছু বুঝলাম না। এটা তো আমার স্বামীর নাম। আমার নামটা কই?
এরপর যতোগুলি প্রশিক্ষণে গিয়েছি ততবার নামটা হারিয়েছি। কেউ লিখেছে, আকসা আহমেদ খান, কেউ লিখেছে, ম্যাদাম আহমেদ খান। একবার একজনকে অনুরোধ করলাম সম্পূর্ণ নামটা লিখতে। ফলে সার্টিফিকেটে প্রদত্ত নামটা দাঁড়ালো এমন, “ফারহানা আহমেদ খান জহুরা আকসা”। এতো বড় নাম দেখে আমি আর নাম নিয়ে টানাটানি করিনি। যে যাই লিখেছে, তাতেই উই (oui) উই (oui), হ্যাঁ, হ্যাঁ করেছি।
এই দেশের আইন অনুযায়ী আমার আলাদা কোনো নাম নেই, আছে স্বামীর উপাধি! কারণ, আমি বিবাহিতা ! এটাই আমার একমাত্র পরিচয়!
আমার একটা প্রিয় নাম ছিল। আনেকদিন হলো সেই নামে কেউ ডাকে না। এইদেশে সবাই সবাইকে ভাবী ভাবী বলেই সম্বোধন করে। প্রথম প্রথম এই ভাবী ডাকের প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিলাম। তখন একজন বয়স্ক মহিলা বলেছিলেন, এইদেশে আবার কেউ আপা আছে নাকি? সবাই সবার ভাবী! তাই আমি আর এইগুলি নিয়ে তর্ক করিনি। তবে ঐ ভাবী ডাকের সাথেই সবার নাম জুড়ে দিয়েছি।
যদিও খুব বেশি মানুষের সাথে পরিচয় নেই আমার। তবুও রাস্তা-ঘাটে যখন যেখানে নতুন কারোর সাথে পরিচয় হয়েছে, তখনই তাদের অনুরোধ করেছি আমাকে যেন তারা আপু ডাকে। প্রথম প্রথম আমাকে তাদের আপু বলতে সমস্যা হতো, কিন্তু এখন তাদেরও অভ্যাস হয়ে গেছে।
নতুন দেশ, নতুন সমাজ ও নতুন পরিবেশ! আর উদ্ভট আবহাওয়া! এরই মাঝে নতুন মা হওয়া! প্রথম প্রথম বাচ্চা পালতে খুবই কষ্ট হতো। ঘরের কাজ, ডাক্তার দেখানো, অফিসিয়াল টুকটাক কাজ, কাগজপত্র জমা দেয়া, এই সব কাজ করতে গিয়ে নাজেহাল হতে হতো। তাই বাকিটা সময় ঘরেই থাকতাম।
স্বামী বেচারা ভোরে কাজে যেত, আসতো মধ্যরাতে। কাছের মানুষ বলতে আর কেউ ছিল না। বাবা-মা’হীন এই জীবনটাকে অর্থহীন বলেই মনে হতো। কোথাও আমি, আমি ছিলাম না! না আমার নাম ছিল! না অন্য কোথাও আমার অস্তিত্ব! জীবনের একসঙ্গে নতুন অভিজ্ঞতায় কাতর হয়ে পড়েছিলাম।
দ্বিতীয়বার বাচ্চার হওয়ার সময়ে গর্ভকালীন মানসিক বিষন্নতা আরও জটিল আকার ধারণ করে। শারীরিক অসুস্থতায় আরও বেশি ঘায়েল হয়ে পড়ি। যদিও বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করতাম। কিন্তু সেটা আর কতক্ষণ? বাসায় বসে বসে কিছুটা বিরক্তি চলে আসে তখন।
যদিও বাংলাদেশে থাকতে আমি তেমন একটা ফেসবুক ব্যবহার করিনি। কিন্তু প্রবাসে একাকিত্ব জীবন আর প্রসব পরবর্তী প্রচণ্ড ডিপ্রেশনের কারণে ফেসবুকই হয়ে পড়ে আমার একমাত্র বন্ধু, গল্প পড়া আর বলার সাথী। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি ফেসবুকের লেখাগুলি পড়তাম।
আমি আমার ডিপ্রেশন কাটিয়েছি শুধুই মাত্র মানুষের লেখা পড়ে। কখনও কখনও নিজের দু:খের গল্প নিজেই লিখার চেষ্টা করেছি। ঠিক ঐ সময়ে উইমেন চ্যাপ্টার এর সাথে আমার পরিচয় হয়। এই চ্যাপ্টারের লেখাগুলিতে নিজেদের খুঁজে পেতাম। তাই উইমেন চ্যাপ্টার ছিল আমার খুব কাছের ‘মানুষ’। খুব প্রিয় একটি অধ্যায়।
এই চ্যাপ্টারে যারা যারা লিখতেন, কেন জানি সবাইকে আমার খুব আপন বলেই মনে হতো। আমার মা, আমার বোন, আমার বান্ধবী! যদিও অনেক সময় তাদের চিন্তা-বিশ্বাস আমার বিশ্বাস থেকে আলাদা হতো। তবুও আমাদের সকলের একটা বড় মিল ছিল, আর এখনো আছে। আমরা সকলেই নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। মানবতায় বিশ্বাসী। পরিবর্তনে ব্যাপারে আশাবাদী। নারীর সম- অধিকার আর মানবতার প্রশ্নে আমরা হয়তো এক।
আমি আগে কখনো কোনদিন লেখালেখি করিনি। তাই হয়তো গুছিয়ে সুন্দর করে লিখতেও পারি না। কিন্তু ইতিহাসের ছাত্রী ছিলাম। তাই প্রতিটি ঘটনাকে পর্যালোচনার ক্ষমতা আছে আমার। ছোট থেকে বাবা-মা’র কল্যাণে দেশ-বিদেশও ঘুরেছি অনেক। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ হয়েছে। জীবনের এক পর্যায়ে চরম বাস্তবতা দারিদ্রতাও দেখেছি। দেখেছি খুব কাছ থেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত বাংলাদেশের চিত্র।
চাকরি জীবনে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানোর আর মানুষ নিয়ে গবেষণা। এরপর এমফিল করতে গিয়ে নতুন স্বপ্ন বোনা। সব মিলে জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ছিল প্রচুর। তাই লেখার বিষয়বস্তুর অভাব হয়নি কখনও। অভাব শুধু সময় আর দক্ষতার। যা হয়তো এখনো নেই।
কোনো এক সকালে, অসম্ভব ভালোলাগার একজন মানুষের ম্যাসেজ পেয়ে ছিলাম। দুই বছর পরে সেদিন নিজের নামটা উইমেন চ্যাপ্টারে দেখে খুব কেঁদে ছিলাম। এর পরে আর পিছু আর ছাড়িনি আপুটার! আমার খারাপ লেখাগুলি দিয়ে দিয়ে বলেছি, আপু প্লিজ একটু দেখে দিয়েন।
উইমেন চ্যাপ্টার আমার হারিয়ে যাওয়া নামটি ফিরিয়ে দিয়েছে। আমায় দিয়েছে নতুন এক পরিচয়। আমিও নতুন করে নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। আমার মতো অনেকেই হয়তো উইমেন চ্যাপ্টারে নিজেকে খুঁজে নিতে চেষ্টা করে। নিজের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন কুড়িয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়। জীবনে এই ছোটো খাটো খুশি আছে বলেই হয়তো জীবনটা এখনো হারিয়ে যায়নি। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাসি কুড়িয়েই তো আমাদের মতো নারীদের বেঁচে থাকা।
ধন্যবাদ আপু সুপ্রীতি ধরকে। ধন্যবাদ আমাদের প্রিয় উইমেন চ্যাপ্টারকে। নারীদের এই পথ চলা শুভ হোক।
(গত ২০ মে ছিল উইমেন চ্যাপ্টার এর চতুর্থ বার্ষিকী। চার বছর পেরিয়ে পোর্টালটি পাঁচ বছরে পা দিয়েছে।)