মালবিকা লাবণি শীলা:
কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধু হঠাৎ করেই ইনবক্সে নক করেছেন। আমি জানি খুব সমস্যায় না পড়লে আমাকে তাঁর নক করার কথা না। দেশে তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। বন্ধুটি অনন্যোপায় হয়েই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, পাশের বিল্ডিং থেকে শব্দ ভেসে আসছে, ভদ্রলোক (?) তার স্ত্রীকে পেটাচ্ছে। মহিলার কান্নার শব্দের সাথে সেই পিশাচের অকথ্য গালিগালাজের সাথে ক্রুদ্ধ হুকুম ভেসে আসছে, স্ত্রীকে বিছানায় যাবার। অর্থাৎ গালিগালাজ শুনে, মার খেয়ে মহিলাটিকে ধর্ষণের শিকার হতে হবে।
এক্ষেত্রে বন্ধুটির করণীয় কি? উনি কি পুলিশে খবর দেবেন? নিজে গিয়ে বাধা দেবেন? অথচ ওই বাড়িতে ওই লোকের বাবা, মা, ভাইবোন উপস্থিত, কেউ বাধা দিচ্ছে না।
পরশুদিন আমার এক ভাতিজি আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমার পরিচিত কেউ ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কাজ করে কি-না। আমি জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ওর খালার বাসায় বেড়াতে গিয়ে ও শুনে এসেছে, পাশের বাড়িতে এক লোক তার বউকে পেটাচ্ছে। আমি জানতে চাইলাম সেই অত্যাচারিত মহিলা নিজে সাহায্য চাইছেন কি-না। এটা আমার ভাতিজির জানা নেই। মহিলা এসেছেন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে, দুটো বাচ্চা আছে। নিজের কোনো সোর্স অফ ইনকাম ছাড়া বাচ্চা দুটোকে নিয়ে কোথায় যাবেন তিনি?
লোটাকম্বল উপন্যাসে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, এক লোক তার বউকে পেটাচ্ছিলো, তাকে ফেরাতে গেলে অত্যাচারিত বউ নিজেই তেড়ে এসেছিলো, আমার স্বামী আমাকে মারুক, ধরুক আপনাদের কী? রম্যরচনা হলেও এই বিষয়টি একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো না। প্রথমে নির্যাতিতাকেই ঠিক করতে হবে তিনি এই অ্যাবিউসিভ রিলেশন থেকে বের হয়ে আসতে চান কি-না।
কিল খেয়ে কিল হজম তো অনেকেই করে যাচ্ছে! এর পেছনে যেগুলোকে আমার মূল কারণ বলে মনে হয়,
১) মেয়েদের অর্থনৈতিক পরাধীনতা।
২) যৌতুক অথবা “উপহার” দেওয়া নেওয়ার নিয়ম।
৩) বিয়ের পর বাবামায়ের সমর্থন সরিয়ে নেয়া।
৪) স্বামীর পরিবারের উদাসীনতা।
৫) রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থার অভাব।
৬) জনসচেতনতার কমতি।
ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সন্তানকে শিক্ষিত করে তাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। মেয়েরা যাতে নিজেকে পরাশ্রয়ী লতা মনে না করে একজন মানুষ হিসেবে পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্রের একটি অবশ্যম্ভাবী অংশ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে। বিয়ে যেন কারো জীবনের একমাত্র মোক্ষ অথবা লক্ষ্য না হয়। সাথে বিয়েতে যৌতুক অথবা উপহারের নামে মেয়েদের অপমান করা বন্ধ করতে হবে।
স্বামীর সাথে সমস্যা হলে মেয়ের সাথে কথা বলতে হবে, সমাজের ভয়ে জোর করে মানিয়ে নেবার কথা বলে অত্যাচারী স্বামীর কাছে যেতে বাধ্য করা যাবেনা। নিজের পরিবারের সমর্থন মেয়েটির জীবনে সবসময়েই থাকবে। স্বামী যদি অত্যাচারী হয়, অন্তত সেই পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে উদার হতে হবে। অত্যাচারীর সঙ্গীরা চুপ থাকলে নিজেরাও একই অপরাধে অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে।
অশিক্ষিত, বেকার, দরিদ্র মেয়েদের অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে বাঁচাতে আইন এবং রাষ্ট্রকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাদের কারিগরি ও প্রায়োগিক শিক্ষার মাধ্যমে দেশের সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা যাবে। একা, কম উপার্জনশীল মায়ের সন্তানদের শিক্ষার দিকটা রাষ্ট্রকেই দেখতে হবে। কেউ আইনি সহায়তা চাইলে তাকে সহযোগিতার পাশাপাশি তার নিরাপত্তার দিকটাও দেখতে হবে।
গৃহকর্মীদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। আপনি অফিসে কাজ করেন, তার বিনিময়ে আপনার অফিস অথবা বস আপনাকে বেতন দেয়। কাজে গাফিলতি হলে কেউ কি আপনার গায়ে হাত তোলে? তাহলে বাসার কাজের মেয়ের মাথা আপনি কিভাবে কিনে নিলেন? এসব দেখে বড় হলে আপনার সন্তানও ভবিষ্যতে অবলীলায় কারো গায়ে হাত তুলবে। অফিসের অশান্তি ঘরে স্ত্রীর ওপর ঝাড়বেন, স্ত্রী ঝাড়বে কাজের লোকের ওপর, এইসব অনাচার বন্ধ করতে হবে।
বেশিরভাগ সময়েই ভবিষ্যতের আলো না দেখতে পেয়ে, কারো সাহায্য না পেয়ে অনেক নারী আত্মহনন করেন। সামগ্রিক সচেতনতার অভাবে আমরাই কিন্তু এদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। চাইলে আমরাই বন্ধ করতে পারি ডমেস্টিক ভায়োলেন্স। আমরাই রুখে দিতে পারি অত্যাচারীর অত্যাচার। আসুন, আমরা গৃহ নির্যাতনকে “না” বলি।