শামীম আহমেদ:
যেকোনো ধ্যান ধারণা, চিন্তা ভাবনাই সার্বজনীন এবং চিরকালীন নয়। সমাজের বিকাশের সাথে সাথে ধারণা বদলায়, বিশ্বাস বদলায়। বদলায় রীতি নীতি। সমাজের উন্নতি ও বিকাশের প্রয়োজনেই এসব বদলায়। সমাজের উন্নতি ও বিকাশে আসলেই যে পুরনো ধ্যান ধারণা চিন্তা-ভাবনা বদলানোর প্রয়োজন হয়, আজকের একটি ঘটনা আমাকে ভাবতে বাধ্য করলো।
গুলশান চৌরাস্তার মোড়ে ট্রাফিক সিগনালের লাল বাতি জ্বলতেই বাস থেমে গেল। অনেকক্ষণ বসে আছি বাসে। সিগনাল ছাড়ার খবর নাই। আমার পাশে সিটে বসা একটি ছেলে ফোনে কথা বলছে। বয়স ১৮-১৯ হবে। গালে হালকা দারির রেখা ফুটে ওঠেছে। বাসের আলোয় বুঝা যাচ্ছে তার উঠতি বয়সের দারির রেখা। ছেলেটির ফোনালাপ- “….দোস্ত ভুলটা আমারই। কিন্তু অর কাছে গিয়া কেমনে মাপ( মাফ) চাই? পোলা মানুষ না অইলে কাইন্দা গিয়া কইতাম মাপ কইরা দেও। অহন না পারতেছি কানতে, না পারতাছি মাপ চাইতে। কিন্তু দোস্ত অনেক কষ্ট লাগতাছে…” আমি জানি না তার এই কথোপকথন কী বিষয়ে? কী নিয়ে? তবে যেটুকু বুঝলাম সে, ছেলে মানুষ হওয়াতে তার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে লজ্জা পাচ্ছে। এমনকি তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে, তাও সে পারছে না।
এই প্রথম আমার মাথায় আসল যে আমরা ছেলে মানুষষেরও অনেক কিছু আছে যা করতে চাইলেও পারি না। আমরা মেয়েদের মতো কাঁদতে পারি না। আমাদের খুব শক্ত হতে হয়। আমাদের মেয়েদের মতো এতো আবেগ ঠিক না। কোন কোন ক্ষেত্রে মেয়েদের কাছে কিছুতই হার মানা চলে না। আমরা মাকে, স্ত্রীকে গৃহস্থালি কাজে সাহায্য করতে চাইলেও পারি না। ওটা নাকি মেয়েলিপনা! আমাদের কোমল হৃদয় থাকতে পারে না। থাকলে নাকি আমাদের পৌরুষে সমস্যা হয়। আমাদের আচরণে একটু উদ্ধত প্রকারের কিছু থাকা চাই। আমাদের হার মানতে নেই। আমাদের ক্রোধ থাকা চাই। প্রতিশোধ পরায়ণ হওয়া চাই। আরো কতো কি? আমাদেরকে আমাদের পৌরুষ বজায় রাখতে হয়। অথচ আমরা কি ভেবে দেখেছি নিজেদের পরুষত্ব বজায় রাখতে গিয়ে কি অন্যায় নিজের উপর করছি, কী অন্যায় অন্যের উপর করছি?
আমার ধারণা সমাজে পুরুষত্বের গুণাবলী নামক যে সব বৈশিষ্ট্য ছোটবেলা থেকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় তা আমাদেরকে তথাকথিত পুরুষ করলেও মানুষ কিন্তু হতে দেয় না। বরং এসব বৈশিষ্ট্য সমাজের নানা অন্যায় অবিচারে ভূমিকা পালন করে। ধরুন আমি কোন মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব করলাম এবং মেয়েটি আমার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। সেক্ষেত্রে আমার পুরুষত্বের গুণাবলী বজায় রাখতে গিয়ে আমি মেয়েকে যে কোন উপায়ে পেতে চাইব। অবশেষে না পেলে প্রতিশোধ হিসেবে তার একটা ক্ষতি করে দিব।
আমার মনে হয় সমাজে এ ঘটনার উদাহরণ অসংখ্য হবে। এমনকি আমাদের চলচ্চিত্রগুলো বা হিন্দি চলচ্চিত্রগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখবেন। নায়ক ছবির নায়িকাকে পছন্দ করে। তার পিছন ঘুর ঘুর করে। নায়ক প্রথম পাত্তা পায় না। তখন তার জেদ চাপে যে করে হোক এই মেয়েকে তার চাই-ই চাই। শেষে নায়িকাকে জয় করে। এই যে নায়কের এমন জয় আমাদের কি শেখায়? কখনো কি চলচ্চিত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ভেবে দেখেছেন? আমাদের পারিবারিক জীবনে দেখুন মায়েদের বোনদের দুঃখ কষ্ট ভাগ করে নেয়ার একটা প্রবণতা আছে। একজন আরেকজনকে মনের কথা বলছে। ব্যথা বুকে চেপে রাখছে না। অবশ্য একক পরিবার বৃদ্ধির কারণে এর আঙ্গিক পরিবর্তিত হয়েছে কিছুটা।
কিন্তু পুরুষের? স্ত্রীর সাথে সবকিছু ভাগাভাগি করে নেবার সম্পর্ক থাকলে হয়তো শেয়ারিং হয়,কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয় না। পুরুষ তার ব্যথা ভুলে মদের বোতলে অথবা কোন পতিতার খদ্দের হয়ে। এবং এ প্রবণতা শেখায় আমাদের চলচ্চিত্র, গল্প উপন্যাস। আমি অনেক স্বামীকে দেখেছি ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। অর্থ হারানোর ব্যথা কাউকে বলে হালকা হয়নি। মন খারাপ করে করে বসে থেকেছে। কোন কোন সময় সে ব্যাথাকে ক্রোধে রূপান্তরিত করে তার ঝাল মিটিয়েছে স্ত্রীর উপর একদম অহেতুক কারণে।
ছোটবেলায় যখন কোন কারণে কষ্ট পেতাম। তখন কেঁদে দিলে আত্মীয় স্বজন ঠাট্টা-তামাসা করতো- “আরে এই পোলা দেখি মাইয়াগো মতো কিছু হইলেই কাইন্দা দেয়!” এই যে ছেলেদের কষ্ট পেলে কাঁদতে নেই, আবেগ দেখাতে নেই ছোটবেলা থেকে যে শিক্ষা দেয়া হয় তা আসলে ছেলেটির আবেগ অনুভূতিকে হত্যা করেই দেয়। মোটা দাগে বললে আসলে তাকে পাষাণ হতে উৎসাহ যোগায়।
আমার মনে হয় দিন বদলাচ্ছে। আমাদের চিন্তা ভাবনা বদলাতে হবে। তথাকথিত পুরুষত্বের যে বীজ শৈশবে সমাজ বুনে দিয়েছে আমাদের কোমল হৃদয়ে তা বিষাক্ত বীজ। আমাদেরও কোমল হৃদয় আছে। আমাদেরও আবেগ আছে। আমাদেরও কাঁদতে ইচ্ছে হলে মন খুলে কাঁদার অধিকার আছে। পুরুষত্বের যে ভয়ংকর গুণাবলী আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তা আমাদের মানুষ করে তোলেনি। বরং অমানবিক করে তুলেছে।
তাই পুরুষ এ সমাজে হয়ে আছে আবেগহীন পাথরসম পাষাণ। যা আমাদেরকে সমাজ হানাহানি, কাটাকাটি হিংস্রতা ও অন্যান্য নেতিবাচক কাজের নিয়ামক করে তুলেছে। সময় এসেছে পুরুষত্বের সংজ্ঞা বদলাবার। সময় এসেছে পুরুষের আবেগী কোমল হৃদয়ের মানুষ হবার।