জীবনের লক্ষ্য যদি হয় জাজমেন্টাল হওয়া 

পৃথা শারদী:

আমার সাদা জামা পছন্দ, পাশের বাসার মেয়ের পছন্দ লাল জামা, শুধু লাল নয়, আগুন লাল! এমনই রঙের সে লাল! দেখলে আমার গা জ্বলে। ব্যস! পাশের বাসার মেয়ের রুচি খারাপ, সে খারাপ, কিছু শিখে আসতে পারেনি! হ্যান ত্যান ………… এই যে না জেনে না বুঝে নিজের মতো করে অন্যকে বিচার করা …………এসব মেন্টালিটিকে কি মেন্টালিটি বলে জানেন? জাজমেন্টাল মেন্টালিটি!

আচ্ছা কোথায় লেখা আছে যে , আপনার যা পছন্দ হতে হবে তা আমারও পছন্দ হতেই হবে , আপনি যা ভালবাসেন বা আর দশজন যা ভালোবাসে তা আমাকে ভালোবাসতেই হবে, আমরা তো একে অন্যের ক্লোন নই !
কোন মেয়ে একাধিকবার বিয়ে করেছেন, সাথে সাথে এই সমাজের সবাই বলা শুরু করলেন, মেয়ে খারাপ। এতোদিন সেই মেয়ে কিলগুঁতা খেয়ে সহ্য করে থাকা পর্যন্ত এই সমাজ তাঁকে বলেছে, তুমি ভালো মেয়ে, বসে বসে সহ্য করছো, আজ যেই কিনা মেয়েটি গণ্ডির বাইরে গিয়েছেন, সমাজের হোমরা চোমরা থেকে শুরু করে রাস্তার মানুষটিও না জেনে শুনে মেয়েটির ব্যাপারে জাজমেন্টাল হচ্ছেন।

একজন ডিভোর্সী, সিংগেল মাদার নিজে সব কাজ করে রাত করে ঘরে ফেরেন, সাথে সাথে পাড়া প্রতিবেশীর কানাঘুষা, মহিলা মনে হয় অন্য কোন কাজ (!) করেন! এতোই যখন বোঝেন, মেয়েদের রাতে বাইরে থাকা নিরাপদ নয়, তো করে দেন মহিলার ব্যাংকের কাজ, বাজার সদাই ! তা তো করবেন না!

দু’জন মানুষ মানসিক দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছে আসছেন, দুজনেরই সংসার আছে, সংসারে সব আছে, সুখ নেই , শান্তির জন্য তারা পাশাপাশি আছেন। হ্যাঁ, থাকতেই পারেন! আপনি সেখানে তাদের কথা শোনানোর কে ভাই! আপনাকে কে তাদের বিচার করার ভার দিয়েছে? যখন তাদের সংসারে চরম অশান্তি ছিল, আপনি গিয়েছিলেন ঠিক করে দিতে? তখন তো মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসেছেন। আজকে দু’জন মানুষ যদি দু’জনের প্রতি সৎ থেকে সম্পর্কে স্বচ্ছতা রেখে নিজেদের মতো ভালো থাকে তো আমি কি জানতে পারি আপনাদের জাজমেন্টাল মেন্টালিটির কী হেতু?

কোন মেয়ে ছোটো জামা পরলো, কোন মেয়ে কার সাথে ঘুরলো, কোন মেয়ে একদম কালো, তবে তার প্রেমিক কিংবা স্বামীর গায়ের রং দুধে আলতা, এমন কালো মেয়ে কেন একজন ফর্সা ছেলে পাবে, এসবও এখন আলোচনা! এসব একান্তই তার ব্যাপার! আপনারা কোথাকার কোন সমাজপতি হয়েছেন যে একজনের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে জাজমেন্টাল হচ্ছেন?

আর তার পাশাপাশি সমপ্রেম, অসম প্রেম, পরকীয়া, সমকামিতা এসব ব্যাপারেও সবাই আজকাল জাজমেন্টাল। সেদিন সমকামিতার জন্য এদেশে কয়েকজনকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হোল! কী অবাক কাণ্ড! এখন কে, কার সাথে কীভাবে ঘুমাবে, কীভাবে থাকবে, এটাও দেশের অনুমতি নিয়ে করতে হবে? সমকামিতা বিকৃত রুচি? আরে ভাই, সমকামি মানুষজন সাধে হয় না সবসময়। দয়া করে এটা নিয়ে পড়ালেখা করেন।

লেখক হুমায়ুন আহমেদ যখন তাঁর থেকে বয়সে বেশ ছোট শাওনকে বিয়ে করলেন, তখন আমরা সবাই বলেছি, মেয়ের বয়সী একজনকে বিয়ে করেছেন! আরে তাতে আপনার কী! ইদানীং অনেক মানুষই এমন করছেন। অনেক মেয়েও তাঁর থেকে বয়সে ছোট অনেক ছেলেকে বিয়ে করছেন। বাইরের দেশে এটা খুবই স্বাভাবিক। মনের মিল তো সবার সাথে সবার নাও হতে পারে। একটা সময় গিয়ে মনেই হতে পারে সম্পর্কটা আগের মতো নেই, সেক্ষেত্রে বের হয়ে নতুন করে শুরু করাই ভালো।

অসম প্রেমে যদি ভালো থাকা যায়, তাতে অন্যদের কী সমস্যা! যেখানে সম্পর্কের বৈধতা আছে, যেখানে মানসিকভাবে দুজন দুজনের সুজন হয়ে সুখী, সেখানে আমরা কেন তাদের বিচার করতে যাই? এবং আমাদের সেই বিচারে কেন বারবার করে বলা হয়, মেয়েটাই নষ্ট! মেয়েটাই খারাপ! মেয়েটাই ফুসলিয়ে সংসারী লোকটাকে বিবাগী করেছে! আমরা বলার কে আসলে? এসব কথা বলা কি আমাদের মানায়?

আমরা সবাই জাজমেন্টাল হয়ে গেছি । আমাদের পাশে কেউ আমাদের পছন্দমতো না হলেই তাঁকে আমরা সার্ফ এক্সেল দিয়ে ধোলাই করা শুরু করি, কালে কালে অনেক বেলা হয়েছে, এবার থামেন। এসব জাজমেন্টাল মেন্টালিটির অধিকারী হয়ে কোনও লাভ নেই, আপনাকে কেউ হাইকোর্ট কিংবা জজকোর্টে জাজ হতে বলবে না।  এমনও তো হতে পারে আপনার অনেক ব্যাপার নিয়ে অনেকে অনেক জাজমেন্টাল? আপনার পেছনে অনেকে আপনাকে নিয়ে, আপনার পরিবার নিয়ে অনেক বাজে কথা বলে?

অন্যকে নিয়ে গসিপ করা থামান, মানুষকে ভালো থাকতে দিন, পৃথিবীতে আমরা সবাই ভালো থাকতে এসেছি, কেউ যদি আপনার ক্ষতি না করে তাঁর মতো করে ভালো থাকে, তাতে আপনার কী?

যদি তার কাজ খারাপ হয় তো দস্যু রত্নাকরের মতো একদিন তিনিও বদলে গিয়ে রামায়ন রচয়িতা বাল্মিকী মুনি হবেন! আর যদি তা না হোন তো তাঁর ফল তিনি ভোগ করবেন, এর আগ পর্যন্ত তার জীবনটা তার মতো করেই কাটাতে দিন।
কে তীক্ষ্ম ছুড়ির ওপর হাঁটে, আর কে যে ফুলের ওপর হাঁটে, দূর থেকে আমরা কীভাবে বুঝি, বলুন! 

শেয়ার করুন: