পুরুষতন্ত্রের আতসি কাঁচের নিচ থেকে মুক্তি পাক নারীর জীবন

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:

কিছু কথা থাকে যা বলা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে অথচ বলা হয়ে ওঠে না। কিছু কষ্ট থাকে যা বললে মনটা হালকা হয়, কিন্তু চারপাশে এতো মানুষের ভিড়েও বলার মতো কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন কিছু ব্যথা থাকে যা জমতে জমতে বুকটা হয়তো পাথর হয়ে যায়। তবু সেই পাথর বুকে বয়ে বেড়াতে হয় অনন্তকাল।

হ্যাঁ, আমাদের  বিশেষ করে মেয়েদের, কথা, কষ্ট, ব্যথা, সংগ্রাম, মান – অপমান, বিশ্বাস থেকে বিশ্বাস ভঙ্গ,  হোঁচট খাওয়া, ফের উঠে দাঁড়ানো,  হেরে যাওয়া থেকে জয়ী হওয়া বা না হওয়া পর্যন্ত এমনিভাবে এক জীবনের আড়ালে আরেক জীবন সমান গল্প জমা হয়ে যায়।

সেই জমে থাকা জীবনের গল্পগুলো চোখের পানিতে ভাসিয়ে, বুকের পাথরটাকে আরো শক্ত করে বেঁধে, মেনে ও মানিয়ে নিয়ে , কিল খেয়ে কিল হজম করে,  সুনিপুণ দক্ষতায় নিজেকে সংসারে সঁপে দিয়ে কন্যা – জায়া – জননীরূপে জীবন পার করার মধ্যেই সার্থকতার মুখ দেখে নারীজন্ম। অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই, চাওয়া – পাওয়া নেই , বক্তব্য নেই , আঘাত – যন্ত্রণা- নির্যাতন – বঞ্চনা নীরবে সয়ে কেবল বুক – পিঠ – বাহু দিয়ে সংসার আগলে রাখবে – সেই তো আদর্শ নারী জীবন! পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এভাবেই দেখতে অভ্যস্ত নারীদেরকে।

সেই চিরাচরিত নিয়মের শৃংখল ভেঙে মেয়েরা বেরিয়ে এলেও তাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত হবে পুরুষতন্ত্র দ্বারা – এটাই যেন নিয়তি! এর অন্যথা কিছুতেই হতে দেবেনা সমাজ । তা হলে যে পৃথিবীটাই বদলে যাবে! বদলে যাবে সহস্র বছরের ইতিহাস!

তাই তো বলতে গেলে, চলতে গেলে, সামনে এগোতে গেলে এতো ” বাধার বিন্ধ্যাচল “। 
 
ভালোবাসায় নাকি পৃথিবী বদলায়! যে মেয়েটি ভালোবেসে কারো হাত ধরার পর সেই বিশ্বস্ত হাতের সাহায্যেই বেহাত হয়ে যায় পতিতালয়ে বিক্রি হয়ে, কখনো কী আমরা ভেবেছি কীভাবে বদলে যায় তার চেনা পৃথিবী? সে কী আদৌ চেয়েছিলো এই বদল?

ভালোবেসে সংসারে ডুবে যায় মেয়েটি। ভালোবাসতে বাসতে নিজের অস্তিত্বই ভুলতে বসে একদিন। জীবন পার করে দেয় ত্যাগের মহিমায়। জীবন তাকে এতোটাই বদলে দেয় যে পৃথিবীর অপার সৌন্দর্যের কিছুই তার দেখা হয়না। এই তার ভালোবাসায় বদলানো পৃথিবী!

মেয়েগুলো পৃথিবীতে এসে শাসন – শোষণ, বিধি- নিষেধের বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাবে, শিক্ষিত – অশিক্ষিত নির্বিশেষে নিয়ন্ত্রিত হবে তার নখ থেকে চুল, পোশাক থেকে পরিচয় – এমনকি প্রতিবাদের ভাষা পর্যন্ত! সে শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতিত হবে, অত্যাচারিত হবে, আগুনে – এসিডে দগ্ধ হবে, ধর্ষণের শিকার হবে, এমনকি কখনো তার চোখ উপড়ে ফেলা হবে, আঙুল কেটে নেয়া হবে, ব্লেডে চেরা হবে শরীর – তবুও নারীকে তার কোমলতা বজায় রাখতে হবে! তবুও ভালোবাসায় ভরাতে হবে পৃথিবী! নারীর কাছে আর কত ভালোবাসা চায় এ বিচিত্র পুরুষতন্ত্র?

জগতের অনাচার সয়ে যাওয়ার নামই নারীজন্ম। বলতে গেলেই যত বিপত্তি। জন্ম, রক্তের সম্পর্ক সব নাকি তার পর হয়ে যায় বিয়ে নামক সামাজিক প্রথায়! সেখানে শুরু হয় তার আরেক জীবন – সেই  মেনে আর মানিয়ে নেয়ার জীবন।

উইমেন চ্যাপ্টারের সাথে আমার লেখালেখির যোগাযোগটা বছর খানেকেরও কম সময়। তার আগে পড়া হতো মাঝেমধ্যে। এখন এটা অনেক  ভালোবাসার জায়গা। এখানে যাঁরা লেখেন তাঁরা জানেন এটা তাঁদের কাছে যত না লেখার প্ল্যাটফর্ম তারচেয়ে অনেক বেশি মন খুলে কথা বলার, হারিয়ে যাওয়া নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সবুজ এক টুকরো পথ – যার মাথার ওপরে এক চিলতে খোলা নীলাকাশ। এখানে লেখাগুলো গলা ছেড়ে উচ্চস্বরে হাসে, কাঁদে, প্রতিবাদ করে, আক্রোশে ফেটে পড়ে , মাথা উঁচু করে মানুষ হয়ে বাঁচতে শেখায়, জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়।

মেয়েদের জীবনের ক্ষয়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়ার গল্পগুলোর মধ্যে দিয়ে একদিন ঠিক ঘুরে দাঁড়াতে শিখে যাবে আমাদের মেয়েরা – খুঁজে নেবে মানুষ হিসেবে বাঁচার স্বাধীনতা। সেদিন কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হবে না, যৌতুকের বলি হবে না। কথা বলতে গেলে কেউ তার কণ্ঠরোধ করবেনা। সেদিন সত্যিই সমতা আসবে। নারী- পুরুষ বলে কিছু থাকবেনা – মানুষে – মানুষে সমতা। ভালোবাসায় সমতা।

পুরুষতন্ত্রের আতসি কাঁচের নিচ থেকে মুক্তি পাক নারীর জীবন। তার জন্য যদি শত বছর সময় লাগে তবে উইমেন চ্যাপ্টার টিকে থাকুক শত বছর।
অভিনন্দন। শুভেচ্ছা। ভালোবাসা, উইমেন চ্যাপ্টার।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.