শিল্পী জলি:
পাঁচ বছরের অশিক্ষিতা, নাবালিকা পূজার যখন রেপ হয়েছিল তখন সে চরম ভয় পেয়েছিল, ব্যথা পেয়েছিল, চলতে পারতো না, খেতে পারতো না, কিন্তু সে লজ্জা পায়নি। কেননা সমাজ তখনও তার ব্রেনওয়াশ করতে সক্ষম হয়নি যে এটা তোমার লজ্জা, তোমার পরিবারের জন্যে লজ্জা, তোমার ভবিষ্যতের জন্যে লজ্জা, তোমাকে আর বিয়ে করা যায় না— তোমাকে পরপুরুষ ছুঁয়েছে, তুমি আর সেই শিশুটি নেই….।
কেননা সে তখন সমাজের এসব ভাবনাকে থোড়াই কেয়ার করতো।
সমাজও জানতো, এখানে তেড়িবেড়ি করে লাভ নেই— এই মেয়ে মানবে না। তাই তার পোষাক–আষাক এবং চলনবলন নিয়ে সে আর গলা ফাটায়নি। কেননা কথায় আছে, মানলে তালগাছ, না মানলে #ালগাছ !
শিশুরা ধর্ষণের শিকার হলেও তারা জানে এবং মানে, তারা অপরাধী নয়। তারা কোনো অন্যায় করেনি। তবে, তারা আহত, তারা ক্ষতিগ্রস্ত, এবং সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখানে লজ্জিত হবার কোনো কারণ নেই।।
যে কোনো মানুষই ধর্ষণের শিকার হতে পারে। শিশু হতে পারে, তরুণী ধর্ষণের শিকার হতে পারে, যৌনকর্মী ধর্ষণের শিকার হতে পারে, গৃহবধূ হতে পারে, আবার একজন পুরুষও ধর্ষণের শিকার হতে পারে।
কিন্তু সমাজে আসল আঘাতটি হানা দেয় ঠিক লিঙ্গে গিয়ে, একেবারে সুবিধামতো বেছে নিয়ে —ভিকটিম যদি নারী হয়, তার আর রক্ষা নেই।
বিবাহিতা নারীকে স্বামী জোর করে সেক্স করলে সেটাও ধর্ষণ।
আমাদের আশেপাশে অহরহ অনেক বধূই এই ধর্ষণের শিকার হয়। তারা কষ্ট পায়, তাদের মন আহত হয়, শরীর খারাপ লাগে, কিন্তু তারা লজ্জা অনুভব করে না। কেননা তাদেরকে আগেই কানপড়া দেয়া হয়েছে, সমাজ বলে দিয়েছে এতো তোমার স্বামী—এটা আবার ধর্ষণ নাকি, আরে দূর…!
তাই তারা আর মনে করে না এতে তার পরিবার অসম্মানিত হয়েছে, তার নিজের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে, তার সামাজিক অবস্হান হেয় হয়েছে, সে একজন অচ্ছুৎ।
অর্থাৎ সমাজ বলে দেয়, কোন ধর্ষণ লজ্জার, কোনটিতে লজ্জা পাবার কোনো কারণ নেই! একই ঘটনায় নানাবিধ বিচার ব্যবস্হা—ভেদাভেদ সুস্পষ্ট। উদ্দেশ্য, সুপরিকল্পিত।
এখানেও সমাজে মানুষের লৈঙ্গিক এবং অবস্হানগত ভেদাভেদ করে অদৃশ্য তত্ত্ব তৈরির মাধ্যমে অঙ্গুলি দ্বারা নির্দেশের পাঁয়তারা চলে— পুরুষ ধর্ষিতা হলে লজ্জার নয়, গৃহবধূ স্বামী দ্বারা ধর্ষিতা হলে লজ্জার নয়, শুধু নারীর জন্যে বিষয়টি লজ্জাজনক তখনই যদি সে একজন বেগানা পুরুষ দ্বারা ধর্ষিতা হয়।
পরোক্ষভাবে সমাজ ‘একই ধর্ষণের‘ ভিন্ন সংজ্ঞা ক্রিয়েট করে, যেনো নারী ভিকটিম অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার পরিবার চাপে থাকে, লজ্জায় একেবারে সিঁটকে যায়, বিচারের আশায় আদালতে না ছোট,…. এক কথায় ধর্ষকের নিরাপওা বিধান করা হয়।
ফলে যে অপরাধী সে সমাজে বুক ফুলিয়ে হাঁটে, আর ধর্ষিতা নারী দিন দিন কোণঠাসা হতে থাকে।
তার চিন্তা তাকে অপরাধী করে, সমাজ তাকে হেয় ভাবে দেখায়, সে ক্ষণে ক্ষণে লোকের মনের ভাষা পড়ে, সমাজের চোখে নিজেকে দেখতে শুরু করে, অতঃপর এক সময় নিজের মন এসব না মানলেও একটু একটু করে সে গুটিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার জীবন, পিছিয়ে যায় তার পথচলা,
যোগ্য হলেও পলে পলে অযোগ্যতার সীল পড়ে যায় তার জীবনে।
কেননা সে একজন নারী ধর্ষিতা,পরপুরুষ দ্বারা তার বিশেষ অঙ্গটি জোরপূর্বক ছোঁয়া হয়েছে, যদিও অঙ্গটি এখনও অনেকটা আগের মতই আছে, তবুও ছিনতাই হয়ে যায় আস্ত মানুষটিই— সব শেষ।
দুণিয়ায় তার আর কিছু করার নেই— সে একজন অচ্ছুৎ !
আসলেই কি তাই ?
সে অপরাধী নয়, সে কারও ক্ষতিও করেনি। সে একটি দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে মাত্র। তার অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, অনিচ্ছায় তার ভার্জিনিটি হারিয়েছে— সে আহত, সে ক্ষতিগ্রস্ত, সে ভীত, কিন্তু এর বেশী কিছুতো নয়। মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া অন্য দুর্ঘটনাগুলোর মতই এটিও একটি— সে এখনও খোয়া যায়নি, আগের মানুষটিই রয়েছে। জীবন নিয়ে এখনও তার স্বপ্ন আছে, সমাজকেও এখনও তার দেবার আছে অনেক কিছু ,পরিবারকে দেবার আছে, বুক ফুলিয়ে চলার অধিকার আছে।
মুভি স্টার হতে গিয়ে রণবীর কাপুরও ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। সেই কথা বলতে গেলে এখনও সে আগের সেই পেইন অনুভব করে, নিমিষেই তার চোখ ভিজে যায়, কিন্তু সে সমাজে দাপটের সাথে চলে। কেননা সে জানে এবং মানে, ধর্ষণ তার পথরোধ করতে পারবে না, তার ভবিষ্যত নষ্ট করতে পারবে না, সে করতে দেবে না, কেননা সে অপরাধী নয়। সে আরও জানে সমাজে তার অবস্হান— ধর্ষণের শিকার হলেও সে যে একজন ছেলে। সমাজ রয়েছে তার সাপোর্টে—সমাজ পুরুষের ভার্জিনিটি নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কেননা সমাজ তাকে নারীর মতো ভোগ্যপণ্য বলে আখ্যা দিয়ে অঙ্গুলি নির্দেশ করেনি। তাই সেও ভার্জিনিটির তোয়াক্কা করে না, মানেও না।
সমাজে পুরুষ ধর্ষক বা ধর্ষিতা যাই হোক না কেন এটা পুরুষের জন্যে লজ্জাজনক নয় কেননা এটা তাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। তাই তারা অপরাধী হলেও তেমন লজ্জা পাবার কিছু নেই?
পুরুষের আবার লজ্জা কী?
তারা রেপ করবে, খুন করবে, ছিনতাই করবে, ঘুষ খাবে…. কিন্তু লজ্জা পাবে না। কেননা সমাজ তাদের হাত ধরে রেখেছে, তাই তারা আর বদনামের তোয়াক্কা করে না, এমনকি অপরাধী হলেও না।
অথচ নারী অপরাধ না করেও লজ্জা পায়, অন্যের অপরাধের বোঝা নিজের কাঁধে নিয়ে হাঁটে, বেঁকে যায় তার পথ চলা। কেননা সমাজ বুঝিয়ে দিয়েছে, নারী সেতো পুরুষের অধম— মানুষ নয়, সে শুধু একটি গোপণঅঙ্গ।
সমাজ, সমাজকে বুঝিয়ে দিয়েছে, তাকেও বলে দিয়েছে, খবরদার, ঐ অঙ্গটি যেনো…!
সেও পুরুষের চাপিয়ে দেয়া নীতির কাছে নত শিরে বশ্যতা শিকার করে নিয়েছে— মেনে নিয়েছে নারীজীবন এবং নারীজীবনে বেগানা লোকের যোনিতে হস্তক্ষেপই তার পরাজয়, অসন্মাণ, তার বর্তমান এবং ভবিষ্যত ক্ষতির ধারক এবং বাহক। জীবন নির্ধারক। সে পুরুষের হাতের পুতুল।
কেননা পুরুষ তাকে শিখিয়ে দিয়েছে, কিভাবে চিন্তা করতে হবে, কার সাথে সেক্স করতে হবে, কখন করতে হবে, কোন সেক্স উপভোগ করতে হবে, কোন সেক্স লজ্জার হবে, ধর্ষণের দায় কার, ধর্ষণের লজ্জা কার, এবং ধর্ষণের নিরাময় পদ্ধতি ( ধর্ষককে বিয়ে)।
এই অবস্হান থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ধর্ষিতাকেই প্রথম সমাজের চাপিয়ে দেয়া ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কেননা ধর্ষিতা জানে সে অপরাধী নয়, সমাজ তাকে সুরক্ষা দিতে পারেনি, সে কারও ক্ষতি করেনি, এটা তার অপরাধ নয়, অসন্মান নয়,তার কোন আত্মগ্লানি নেই—সে কেন এর দায় নেবে?
যে সমাজে ধর্ষক বুক ফুলিয়ে হাঁটে, ধর্ষণের বিচার হয় না, ধিক্ সে ধর্ষকের, ধিক্ সে সমাজের— সে সমাজ নারীকে কী জাজ করবে?
তার সেই যোগ্যতা কোথায় ?
আমেরিকাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে একটি ২১/২২ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করার পর একাধিকবার শুট করা হয়। অতঃপর মৃত ভেবে তাকে ফেলে রাখা হয়েছিল একটি নির্জন মাঠে। সে বেঁচে যায়।
মেয়েটির বাবা বিশাল ধনী, বিখ্যাত, জাঁদরেল সাংবাদিক, প্রাইভেট জেট নিয়ে ছুটে আসেন মেয়ের রেপের খবর শুনে।
ফোনে বাবার প্রথম প্রশ্নটি ছিল, বেঁচে তো আছে সে?
কেননা মানুষের বেঁচে থাকাই মুখ্য, বাকি সব গৌণ।
বাবার হাতেই মেয়েটির রেপের খবর লেখা হয়।
প্রথম দিকে পত্রিকার নিয়ম অনুযায়ী ধর্ষণের শিকার মেয়ের নাম প্রকাশ করা হতো না।
মেয়ে বলেছিল, ‘বাবা আমার নাম কেন প্রকাশ হবে না?
আংশিক খবর কেন যাবে—এতে কারও তো তেমন উপকার হবে না?
মানুষের বিবেক তো জাগ্রত হবে না !
ধর্ষণ কেন ধর্ষিতার লজ্জা হবে—আমি তো অপরাধী নই ?’
অতঃপর পত্রিকাটির আইন পরিবর্তন করে বিস্তারিত খবরসহ মেয়েটির নাম ছাপানো হয়। বাবা-মেয়ে মিলেই সে কাজ করে।
ধর্ষণ ধর্ষিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও সমাজ পাশে থাকলে আবার দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে পথ চলা সম্ভব। শুধু মানুষকে মুক্ত হতে হয় সমাজের বেঁধে দেয়া চিন্তার প্যাটার্ন থেকে, যা নারীকে পদে পদে বেঁধে রাখে, আর পিছিয়ে যায় পথচলা।