স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সুস্পষ্ট জবাব চাই

আরিফ জেবতিক:

আমার বড় মেয়েটার বয়স এখন ৮ বছর। ছোটবেলা সে আমাদের সঙ্গে ঘুমাতো। মাঝরাতে তাঁর বালিশ থেকে উঠে এসে আমার বালিশে ঠেলে মাথা গুজে দিতো, তারপর গুটিশুটি হয়ে এমনভাবে আমার সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করত যে কখনো কখনো ঘুমের ঘোরে ধাক্কা খেয়ে আমার নিজেরই বিছানা থেকে পড়ে যাওয়ার জোগাড়। আমার মেয়ে দুটো আমার শরীরের অংশ, তাঁরা দিনমান আমার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকে। তাঁদের গায়ের ঘ্রাণ, চুলের গন্ধ, আমার গলায় পেচিয়ে ধরা তাঁদের ছোটছোট আহ্লাদি হাত-এগুলো দিনমান আমার সঙ্গে থাকে।

গাজীপুরের হযরত আলী সরকারের মেয়ে আয়েশা আক্তারও আমার মেয়ের সমবয়েসী। সেই ছোট মেয়েকে কয়েকটা ধর্ষক ধর্ষণ করেছে। অসহায় হযরত আলী আর তাঁর স্ত্রী হালিমা বেগম সেই বিচার চাইতে থানায় গেছেন। তাঁরা থানার বারান্দায় সারাদিনমান বসে ছিলেন, এই অফিসারের পা জড়িয়ে ধরেছেন, ঐ অফিসারের পা জড়িয়ে ধরেছেন। তাঁরা বিচার পাননি। তাঁরা সঙ্গে মিডিয়া পাননি, ফেসবুকের এক্টিভিজম পাননি।

অসহায় হযরত আলী তারপর তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের মেয়েকে নিয়ে ছুটন্ত রেলের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বাড়ি থেকে যাওয়ার পথে বলেছিলেন, ‘মেয়েটাকে নিয়েই যত চিন্তা। ‘

আমি হযরত আলী আর আয়েশা আক্তারের এই হত্যাকাণ্ডের খবর নিয়ে কিছু লিখিনি। আমি বাড়ি ফিরে শক্ত করে আমার আয়েশা আক্তার মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলাম। আমি লিখিনি, কারন অবচেতন মনে আমি এই খবরটি এড়িয়ে যেতে চেয়েছি। এই নিঠুর নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার কখনোই নেই, কোনো পিতারই থাকে না।

একই ঘটনা আবার বনানীতে ঘটেছে। এবারও ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে ৪৮ ঘন্টা দুটো মেয়ে আর তাঁদের পরিবারকে বনানী থানায় বসে থাকতে হয়েছে। এবার মিডিয়ায় কিছু জানাজানি শুরু হওয়ার পর বনানী থানা ৪৮ ঘন্টা পরে মামলা রেকর্ড করেছে। তদন্তের নামে যেটা হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে, তা একেবারেই বিচার প্রার্থী দুই তরুণী আর তাঁদের সহমর্মী সাধারন মানুষের সঙ্গে তামাশা।
পুলিশ বলছে ধর্ষক বাসায় নেই, যেখানে ধর্ষকের বাপ বলছে ধর্ষক বাসায় ছিল মামলার পরের দুইদিন। তদন্ত কর্মকর্তা ঐ হোটেলে গেছে, মালিকের সঙ্গে চা-বিড়ি খেয়ে হাসাহাসি করে চলে এসেছে-এমন খবরও দেখলাম একটা পোর্টালে।
যেন দেখানো, আমরা এই ধর্ষকদের বাঁচাবই, তোমরা আমাদের ালও ছিড়তে পারবে না।

আমরা অবশ্যই এসব ধর্ষকদের বিচার চাই। কিন্তু একই সাথে আমি জানতে চাই আমাদের থানাগুলো কেন সরাসরি ধর্ষকদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে, কেন নির্যাতন মামলা রেকর্ড করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে আমাদের! আমাদের টাকায় পালিত পুলিশ কেন আমাদের কন্যা-জায়া-জননীর নির্যাতকদের রক্ষা করছে?

উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমি সুস্পষ্টভাবে স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চাই, ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা এড়াতে সরকার কোনো নির্দেশ জারি করেছে কী না? আমি জানতে চাই, বিচারপ্রার্থী হযরাত আলী থেকে বনানীর ঘটনা-দায়ী পুলিশদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নিয়েছে কীনা!
একক ধর্ষক নয়, পুরো ধর্ষক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই জারি রাখতে হবে।
দুইলক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে দেশ, সেই দেশে আর কোনো নারীর সম্ভ্রম যেন হুমকির মুখে না পড়ে সেটা দেখা আমাদের দায়িত্ব।
আমি সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান জানতে চাই।

আমি আমার মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তান, বোনের আচলে ঘাম মুছে বড় হওয়া ভাই, বুকে দুই কন্যা নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া পিতা। আমাকে তাই গোটা ধর্ষক সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, বিচ্ছিন্ন একক ধর্ষক গ্রেফতারের নাটকে আমার খুশি হওয়ার পথ নেই, আমার পক্ষে অল্পতে তুষ্ট হওয়ার উপায় নেই।

শেয়ার করুন: