ধর্ষক ও ধর্ষক পরিবারকে বয়কট করুন

অজন্তা দেবরায়: 

‘আপনি হয়তো অবশ্যই জানেন তেঁতুল খাইতে হয় না! দেখলেই সবার জিহ্বা পানি আসে।’ – বনানীর ধর্ষণ ঘটনা নিয়ে লিখেছেন আলী হোসেন নামের একজন।

‘আমি ধর্ষিতা বা ধর্ষকের পক্ষে নই। হওয়ার প্রশ্নই আসে না। শুধুমাত্র একটা প্রশ্ন মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে, সংবাদপত্র পড়ে যেটুকু জেনেছি রাত নয়টার সময় ঐ দুই তরুণী হোটেলে গিয়েছিলো । আমার প্রশ্ন, ঐ সময় কোন ভদ্রলোকের ভদ্র মেয়ে অভিভাবক ছাড়া একটা হোটেলে যায় ?’- লিখেছেন রাজু আচার্য।

‘ধর্মীয় অনুশাসন না মানার কারণে আজকের সমাজের এই অবস্থা,,,কোনো ধর্মই উলঙ্গপনা আর বেহায়াপনাকে সমর্থন করে না,,,,ভাল বীজ হতে ভাল ফল আশা করা যায় …নষ্ট বীজ থেকে নয়! ভার্সিটিতে পড়ুয়া মেয়েরা ধর্ষিতা হয় বেশি,,, এর কারণ খোঁজা লাগে না, ওদের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কেন? কৌটার মাঝে মধু রেখে ঢাকনা না লাগিয়ে মাছিকে ফাঁসির ভয় দেখিয়ে লাভ কি? আপু আপনার লেখা পড়ে মনে হলো সৃষ্টি কর্তা আপনার চেয়ে কম বুঝেন তাই নারীদের পর্দা ফরজ করেছেন ….’ – লিখেছেন মোহাম্মদ জিয়া নামের একজন।

– বিগত কয়েকদিনে আমার ফেসবুকের ওয়াল থেকে কয়েকটা মন্তব্য তুলে দিলাম। এই মন্তব্যগুলো পড়লে কি মনে হয় না যে এই লোকগুলো উল্টো মেয়েদেরকেই দোষ দিয়ে ধর্ষণকে জায়েজ করার চেষ্টা করছেন? কতটুকু অধঃপতন হলে মেয়েদেরকে ‘তেঁতুল’ বা কৌটার মধুর সাথে তুলনা করা যায়, ভাবতেও ঘেন্না লাগছে। এমন চিন্তা-ভাবনা যে সমাজের মানুষ রাখে, সে সমাজে ধর্ষণ বন্ধ হবে কিভাবে? বনানীর ধর্ষকগুলো এখনো গ্রেফতার হয়নি। অনেক টাকার খেলার কথা হাওয়ায় ভাসছে।

পারিপার্শ্বিক লোকজনের কথাবার্তা শুনে মেয়েগুলো শেষপর্যন্ত বিচার পাবে কিনা সে নিয়ে ভাবনা আমার অনেকটাই উড়ে গেছে, মেয়েগুলোকে ই আবার পুরো ঘটনার দায়ে দোষী করে দেয়া হয় কিনা সেটা নিয়েই আমি শঙ্কিত। আমাদের সমাজে সবই সম্ভব। এখানে নির্ভয়া ধর্ষণ মামলার মতো আন্দোলন করে আসামিদের ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত আমরা নিয়ে যেতে পারি না, সেই কবে কুমিল্লার তনুর জন্য জেগে উঠেছিল দেশ, কিন্তু বিচার কি শেষ পর্যন্ত হয়েছিল? হয়নি।

এদেশে ধর্ষণকে তো অনেক মানুষ অপরাধ হিসেবেই এখনো মানতে শেখেনি, বিচার হবে কোত্থেকে! ‘আমিও রাজাকারের বিচার চাই, কিন্তু….’ ওলাদের কথা মনে আছে আপনাদের? যারা ‘ইনিয়ে বিনিয়ে যত কথাই বলুন না কেন, তাদের অবস্থান যেমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধার দেয়াল তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে, ঠিক তেমনি ‘ধর্ষকদের বিচার চাই, কিন্তু…..’ নামক গোষ্ঠী চোখে পড়ছে এখন আমাদের চারপাশে। যারা ধর্ষণের জন্য ধর্ষকদের চাইতে ধর্ষিতাদেরই দোষ বেশি খুঁজে পান। 

যেখানে ৫ মাসের শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউই ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পায় না সেখানে ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাকে দায়ী করেন কোন মুখে আপনারা? আপনারা কি জানেন আমাদের দেশে প্রতি বছর কি পরিমাণ শিশু ধর্ষিত হয়? বাংলাদেশ শিশু ফোরামের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ থেকে ১০১৭ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজারেরও বেশি শিশু ধর্ষিত হয়েছে শুধু আমাদের দেশেই। মাদ্রাসায় আরবি পড়তে গিয়ে আরবি শিক্ষকের হাতে ধর্ষিত হচ্ছে, মসজিদের ভেতরে ডেকে নিয়ে এক ইমাম একজন কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে, ১৩ বছরের ছেলে ৬ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, ৮০ বছরের বৃদ্ধা ধর্ষিত হয়েছেন -এইগুলোর জন্য দায়ী কি ধর্ষিতার পোশাক? চালচরণ? চলাফেরা?

সত্যিই বলিহারি যাই আপনাদের মন মানসিকতার! কোনো ‘কিন্তু’ কোনো ‘Excuse’ নাই। ধর্ষণের একমাত্র কারণ হচ্ছে ধর্ষক নিজে। ধর্ষকের বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা। ও – তে ওড়না শেখ ছেলেটাই মেয়েদের ওড়না ধরে টান মেরে বিকৃত আনন্দ পায়। ‘মেয়েদের একা কোথাও যাওয়া ঠিক না’ বা ‘রাতে বাইরে বের হওয়া ঠিক না’ এই ধ্যান ধারণায় বেড়ে ওঠা সমাজেই একা মেয়ে বাইরে বের হয়ে নিরাপদ বোধ করে না। হাজারও ধর্ষক চোখ তাকে তাড়া করে বেড়ায়। এই সমস্ত ধ্যান ধারণা থেকে সমাজ যতদিন বের হয়ে না আসবে, যতদিন পর্যন্ত সমাজে এই শিক্ষা দেয়া না হবে যে ‘ছেলে আর মেয়েতে কোন তফাৎ নাই , যার যা ইচ্ছা কাপড় পরার, যেখানে যখন ইচ্ছা যাবার পূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে’ – ততদিন পর্যন্ত বিকৃত মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা ছেলেদের চোখ মেয়েদের মুখের দিকে না গিয়ে বুকের ওড়নার দিকে যাবেই।

অভিভাবকদের সচেতন হবার সময় এসেছে। মেয়েদের কেমন কাপড় পরা উচিত কি উচিত না, কাদের সাথে কিভাবে চলাফেরা করা উচিত কি অনুচিত, কোথায় কখন যাওয়া ঠিক না বেঠিক, এইসব নিয়ে গবেষণা না করে নিজেদের ছেলেদেরকে শেখান মেয়েদের কী করে সম্মান করতে হয়! ধর্ষন রোধের একমাত্র উপায় এটাই। এ সমাজ ধর্ষণের শিকার মেয়েদেরকে লজ্জিত করে। কিন্তু কেনো তা হবে? এই কারণেই তো অপরাধ করেও অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। বীরদর্পে তা আবার রেকর্ডও করে রাখার সাহস পায়। ভাবে, ধর্ষিতারা সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে তা কাউকে বলতে পারবে না।

এই পরিস্থিতির পরিবর্তন খুবই জরুরি। সবার বোঝা জরুরি যে, এমন ঘটনায় ধর্ষিতার কোন দায় নাই, কোনো লজ্জা নাই। সকল দায় ও লজ্জা ধর্ষকের। লজ্জা আমাদের, একুশ শতকে এসেও আমরা আমাদের মানসিকতা বদলাতে পারিনি। সুতরাং ধর্ষককে , ধর্ষকের পরিবারকে সামাজিকভাবে বয়কট করুন। নির্যাতিত মেয়েটির পাশে দাঁড়ান। কোনো অমানুষের কারণে যেনো তাদের বাকি জীবনটা নষ্ট না হয়! রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব নিতে হবে। দায়িত্বশীল হতে হবে সমাজের প্রতিটি মানুষকে।

ধর্ষণবিরোধী কঠোর আইন ও তার বাস্তবায়ন, তৃণমূল পর্যায়ে ধর্ষণবিরোধী প্রচারণা, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির পদক্ষেপ, টেলিভিশনে ধর্ষণ বিরোধী সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন, সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার বিকাশ এখন সময়ের দাবি। এইবারের ঘটনাটা আমাদের সকলের বিবেক জাগ্রত করুক। তনু, আফসানারা বিচার পায়নি। এইবার যেনো তা না হয়। অন্তত এই বার জোরেশোরে একটু আওয়াজ তুলুন এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে।

শেয়ার করুন: